ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

লন্ড্রিতে কাপড় ধোলাই হয় কেজি হিসেবে!

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৩, ১৩ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
লন্ড্রিতে কাপড় ধোলাই হয় কেজি হিসেবে!

(ভিয়েতনামের পথে: ১৭তম পর্ব)
ফেরদৌস জামান : আগের রাতে আগেই শুয়ে পরেছিলাম, তাই ঘুম ভেঙেছে ভোরে। আজকের লক্ষ্য ওয়াট মে ইয়েন, কারেন ভিলেজ এবং মে ইয়েন। প্রথমটা বৌদ্ধ মন্দির, তারপর অলঙ্কার পরা লম্বা গলার কারেন জনগোষ্ঠীর বসতি এবং সব শেষেরটা ঝরনা।

বেরুতে বেরুতে সাতটার কম নয়, আর এখন বাজে সবে সাড়ে পাঁচটা। অতএব, এই লম্বা সময় ধরে বিছানায় শুয়ে চিৎকাত করার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া, ঘুম শেষে বিছানায় গড়াগড়ির অভ্যাস আমার নেই। মাঝেমধ্যে তো মনে হয় জীবনে ঘুমের দরকার না থাকলে কতোই না ভালো হতো। দেখার জন্য, জানার জন্য আরও কত কত ঘণ্টা পাওয়া যেত! বাস্তবতা হলো, এই অমূলক আক্ষেপ নিয়েই দিন শেষে প্রকৃতির নিয়মে আরামের ঘুমে তলিয়ে যেতে হয়।



ভোরের আলো ফুটে বেরিয়েছে। পাখির ডাক কানে না এলেও মোরগের ডাক কানের কোটরে এসে ঠিকই করকর করে বেজে উঠল। সুজিতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো অনুচিত মনে হওয়ায় একাই বেরিয়ে পরলাম। পথে মানুষ নেই। বাড়িগুলোর সামনে নানান নকশা করে স্থাপন করা ফুল আর পাতাবাহার। সারা রাতের অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়ে ভোর যখন কেবল আলো ছড়ানো শুরু করলো গাছে গাছে তখন খুশির ফোয়ারা। সারাটা পথ নিজের বলে কল্পনা করতে বেশ ভালো লাগলো। নীরবতা এসে জাপটে ধরলো, যেন কত কাল ধরে এই বেশুমার নীরবতা কেবলই একজন পথিকের প্রতীক্ষায় ছিল! সোজা গিয়ে সামান্য বামে মোড় নিলে খানিক এগিয়ে অবারও ডানে মোড়। এ পথেই আমাদের সেই খাবারের দোকান। পাই আসার পর থেকে যেখানে একেক বেলায় একেক রকমের খাবার চেখে দেখছি। দোকানটা সবে খুলেছে। অল্পক্ষণ পরেই খদ্দের এসে ভিড় জমাতে শুরু করবে। আমরা অবশ্য সকাল বেলার নাস্তাতে পাকা কলা, পাউরুটি আর মাখনেই আছি। সেভেন-ইলেভেন নামে চেইন দোকান এই ছোট্ট পাইতেও কয়েকটা শাখা বিস্তার করে বসেছে। জেনেছি থাইল্যান্ডের হেন শহর নেই যেখানে এর শাখা পাওয়া যাবে না। এখান থেকে পাউরুটি, মাখন আর চলতি পথে সংগ্রহ করা বুনো কলা, তাতে সকালের নাস্তাটা মন্দ চলছে না। ওদিকে পথে প্রান্তরে তো এই খাবার আমাদের পরম বন্ধুর ভূমিকা রেখে চলেছে। দুই চাকা রুটির গায়ে খানিকটা মাখন মেখে মাঝে একটা কলা, তারপর হাতের তালুতে রেখে মাঝাড়ি একটা চাপ, ব্যাস হয়ে গেল স্যান্ডুইচ্।

এসে গেছি এই রাস্তার শেষ প্রান্তে। চওড়া রাস্তা, দেখেই বোঝা যায় অনেক দূরে চলে গেছে। দু’পাশের ঘরবাড়ি আর যাবতীয় আয়োজন বলে দেয় এখানকার মানুষের প্রধান পেশা পর্যটন নির্ভর। হোটেল, মোটেল, রিজোর্ট বা গেস্টহাউজ, বার, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি তো আছেই। এছাড়াও যানবাহণ, দোকানপাট, বাজার যাই বলা হোক না কেন সব কিছুই পর্যটন ঘিরে। এমনকি যে কোন রাস্তায় দু’পা হাঁটলেই মিলে যায় লন্ড্রির দোকান। তা-ও এই পর্যটন নির্ভর করে। সাইনবোর্ডে সুন্দর করে লেখা থাকে- প্রতি কেজি কাপড় বিশ বা ত্রিশ বাথ। অর্থাৎ, এখানে লন্ড্রিতে কাপড় ধোলাই বা ইস্ত্রি হয় কেজি হিসেবে। যদিও আমাদের ক্ষেত্রে কোনো লন্ড্রি দোকানের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন পরেনি। কারণ ওই কাজটা আমরা নিজেরাই সেরে নিতে পেরেছি।  রাস্তার শেষ প্রান্ত মানে শেষ হয়ে যাওয়া নয় বরং ঢুকে গেছে তুলনামূলক বড় রাস্তায়। এখন সিন্ধান্ত নেয়া দরকার ডানে না বামে যাব?



বাম দিকটা বেছে নিলাম। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে খরস্রোতা পাই নদী। ঘোলা পানির পাই নদী পাহাড়-পর্বতের বুক ভেঙে গড়িয়ে যাচ্ছে উপত্যকার মাঝ দিয়ে। হয়তো কিছু দূর এগিয়ে পুনরায় ঢুকে পরেছে কোনো অরণ্যঘেরা পাহাড়ের ফাকফোকড়ে! অফুরন্ত সময় থাকলে নদীর কোন এক পাড় ধরে হেঁটে যাওয়ার ইচ্ছা করা যেত। যদিও ইতিমধ্যেই হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চেলে এসেছি। একেবারে নদীর বুকে সেতুর উপর। যাবাহণের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। বেশিরভাগ মোটর সাইকেলের সাথে জুড়িয়ে দেয়া অতিরিক্ত অংশ। এতে শুধু মালপত্রই তোলা হয় না, মানুষও চড়ে বসে। ডালার মত অতিরিক্ত এই জায়াগাটুকুতে কেউ কেউ বৌ-বাচ্চা তুলে নিয়ে দিব্বি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা করেছে।

চলে এসেছি অনেকটা পথ। আর এগোনো ঠিক হবে না। সুজিত বোধহয় ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুত হয়ে আছে। গেস্ট হাউজে ফিরে দেখি ঠিক তাই। নাস্তা খেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পিঠে চাপিয়ে বের হলাম। ওয়াট মে ইয়েন-এর পথ যে ভোরবেলা ঘুরে যাওয়া আমার সেই পথেই হবে তা জানা ছিল না। দেখতে দেখতে মানচিত্রটা আবারও সেদিকটাতেই নিয়ে এলো। হাতে একটা মানচিত্র থাকলে পথ চলা তেমন কষ্টের নয়। ভ্রমণ সহায়ক এমন মানচিত্র এখানে সহজেই পাওয়া যায়। টুর অপারেটর অথবা হোটেল-মোটেল থেকে বিনা পয়সাতেই সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এযাবৎ ব্যাঙ্কক, মে হং সন বা পাই কোনোখানেই অত্যান্ত প্রয়োজনীয় এই জিনিসটা পেতে সমস্যা হয়নি। হাতে একটা মানচিত্র থাকার অর্থ উক্ত জায়াগায় সুদক্ষ ও পরিচিত একজন পথ প্রদর্শক সাথে থাকার মতো। পরিচিত পথ পেয়ে ভালো লাগল। এখনকার চিত্র অনেকটাই ভিন্ন, গাড়িঘোরা ও মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে। দোকানপাটও খুলতে শুরু করেছ। ভোরের সেই নীরবতা আর বিরাজ করছে না। ভোরের অভিজ্ঞতা থেকে দুই-চার কথা বলতে চাইলে সুজিতের চেহারায় তা শোনার কোনো আগ্রহ খুঁজে পেলাম না। তারপরও বলতে ইচ্ছা হচ্ছে। সেতুর ধারে মোটর সাইকেলের পরিত্যাক্ত যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি ভাস্কর্য কর্মটি দেখে অনেকক্ষণ বুঝতেই পারিনি যে, ওটা একটা শক্তিমান মানবসদৃশ্য শিল্প কর্ম। যেন যন্ত্রাংশের একটা স্তুপ মাত্র। ভাস্কর্যটা প্রমাণ করে স্থানীয়দের জীবনে মোটর সাইকেলের গুরুত্ব কতটা। সুজিতের এসবে বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই, হন হন করে কেবল হাঁটছে। হোক না অদক্ষ হাতে তৈরি, জঞ্জালের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা, তবুও ভাস্কর্য বলে কথা। সেই গল্প তুলতে গিয়ে দুই-তিন লাইনেই একাধিকবার গল্পের তার ছিঁড়ে গেল। অতএব, চেষ্টায় খান্ত দিয়ে একই গতিতে হাঁটা উপযুক্ত মনে করলাম।



পথটা ডান দিকে বাঁক নিয়ে চলে গেছে গতকালের দেখা সেই উপত্যকার মাঝে, যেখান দিয়ে ধানের কচি ডগায় দুলে উঠেছিল সবুজ হাওয়ার স্রোত। মিষ্টি হাওয়ার কোমল পরশে গা ভাসিয়ে পাড়ি দিয়েছিলাম মাইলের পর মাইল। এখন আমরা ঠিক সেই ধান ক্ষেতের উপত্যকায়; যাচ্ছি গাঢ় সবুজ পর্বত সারির মাঝে, যেখানে ঘন অরণ্যে ঢাকা পর্বতের গায়ে মাথা উঁচু করে ধ্যান করছেন বকের পালকের মতো সাদা ধবধবে গৌতম বুদ্ধ। ওয়াট মে ইয়েন নামে বুদ্ধের এই ধ্যান স্থানই আজ আমাদের প্রথম গন্তব্য। পথের ধারে চমৎকার একেকটা গেস্ট হাউজ। গাছের গুঁড়ি, কাণ্ড ইত্যাদি দিয়ে শৈল্পিক করে তৈরি ঘরগুলো সৌখিন প্রজাতির পর্যটকদের জন্য উপযুক্ত থাকার যায়গা। মাচায় দাঁড় করানো সারি সারি কটেজের ধার থেকেই ধান ক্ষেতের শুরু। ছাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সেগুন পাতার আচ্ছাদন। প্রবেশ দ্বার থেকে শুরু করে ভেতর বাহিরে প্রতিটা জায়গায় কেবল শিল্প আর শিল্পেরই সমাহার। সস্তা জিনিসের সুদৃশ্য শিল্পকর্ম। এই যেমন নারিকেলের মালা, গাছের পুরনো মোথা, কাণ্ড, বাঁশ ইত্যাদি। মানচিত্র বলছে আমরা ওয়াট মে ইয়েনের কাছাকাছি চলে এসেছি। বসতি এলাকায় কোন মানুষের চিহ্ন নেই। সাতসকালে এরা কোথায় চলে গেছে, দু’একটা শিশু-কিশোরেরও কি দেখা মিলবে না? না, কেউ নেই, আমরা ছাড়া আর কেউ নেই।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ মার্চ ২০১৮/তারা  

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়