ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

লালখাতায় হালখাতা

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৯, ১০ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
লালখাতায় হালখাতা

ছবি : সানমুন আহমেদ

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : ‘আগে হালখাতায় অনেক আনন্দ হতো। দোকানে দোকানে প্লেটে করে মিষ্টি বিতরণ করা হতো। ক্রেতারা পুরোনো হিসাব পরিশোধ করতে আসতো। ক্রেতাদের জন্য দোকানে চা, মিষ্টি, সন্দেশসহ নানা আয়োজন থাকতো। মহাজনেরা দোকানে নতুন মাল দিতো, সেই মালে সিঁদুরের ফোঁটা দিত দোকানিরা। গদিতে উঠতো নতুন পাটি।’ আগের যুগের হালখাতার বর্ণনা করছিলেন পুরান ঢাকার নবাবপুরের হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী ধনরাজ বণিক (৭০)।

পয়লা বৈশাখে হালখাতা বাঙালি ব্যবসায়ীদের ঐতিহ্যবাহী অংশ হলেও বর্তমানে হালখাতা আর আগের মতো জমজমাট নেই। তবুও শহর গ্রামের অনেক ব্যবসায়ী হালখাতার রেওয়াজ ধরে রেখেছেন। ধনরাজ বণিক ৪০ বছর আগে যেমন হালখাতার আয়োজন করতেন, এখনও তার দোকানে হালখাতা করেন। তিনি বলেন, এখনকার হালখাতায় আগের মতো জৌলুস নেই। আনন্দ নেই। বর্তমান আধুনিক যুগে আদিকালের হালখাতা অনেকটা উঠে গেছে। তিনি আরো বলেন, এখন সবাই পয়সার চিন্তা করে। মানুষে মানুষে বিশ্বাসও উঠে গেছে। ১০ জনকে বাকি দিলে ৮ জন টাকা ফেরত দেয়, দুইজন হাওয়া হয়ে যায়।

‘হালখাতা’ শব্দটি শুনলেই চোখে ভাসে মোটা রঙের লালখাতা। দোকানিরা লাল খাতায় লিখে রাখেন পুরো বছরের বাকির হিসেব। বৈশাখের প্রথম দিন দোকানিকে বাকি শোধ করতে গেলে তারা আপ্যায়ন করেন। এটাই হালখাতার ঐতিহ্য। বেশ কয়েক ধরনের লাল রঙের হালখাতা চালু আছে বাজারে। এসব খাতার দামে যেমন পার্থক্য রয়েছে নামেও রয়েছে চমক। যেমন লালসালু টালির দাম ১২০ টাকা, জাবেদা খাতা ৩০০ টাকা, খতিয়ান খাতা ২০০ টাকা, হাতছিটা খাতা ১০০ টাকা, হাফ টালি ৫০ টাকা, স্পেশাল ব্রাউন বুক ১০০ টাকা।

দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে লালখাতা তৈরি করেন পুরান ঢাকার বাংলাবাজার এলাকার লোকনাথ বুক এজেন্সি। লোকনাথ বুক এজেন্সির মালিক সাইদুজ্জামান জানান, আগে হালখাতার ব্যাপক চাহিদা থাকলেও এখন তেমন চাহিদা নেই। হালখাতা বিক্রি হয় যৎসামান্য। তিনি বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে মানুষ আস্তে আস্তে হালখাতা ব্যবহার থেকে সরে আসছে। দিন যত যাচ্ছে হালখাতার ভবিষ্যত ততই অন্ধকার বলে তিনি মনে করেন।



হালখাতাকে ঘিরে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হচ্ছে বিশেষ হালখাতা কার্ড। যে কার্ড দিয়ে দোকানিরা ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানান হালখাতা উৎসবে। বাংলাবাজার এলাকার মান্নান প্রোডাক্ট দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে হালখাতার কার্ড তৈরি করেন। মান্নান প্রোডাক্টের কর্মচারী শ্যামলচন্দ্র দে জানান, বেশ কয়েক প্রকার হালখাতা কার্ডের প্রচলন রয়েছে। কেউ রেডিমেট কার্ড কিনে নেন, আবার কেউ কেউ অর্ডার দিয়ে কার্ড তৈরি করে নেন। তিনি জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানে কাপড় ব্যবসায়ী, স্বর্ণ ব্যবসায়ী, পান ব্যবসায়ী, কাঁচামাল ব্যবসায়ী, শুঁটকি মাছের আড়তদার, মুদি দোকানিরা সাধারণত হালখাতা কার্ডের অর্ডার দেন।

সদরঘাট এলাকায় ‘মনপুরা পান হাউজ’ নামে পানের আড়ত পরিচালনা করেন দুলাল সাহা। পয়লা বৈশাখে দোকানে হালখাতা করবেন তিনি। তাই চেনাজানা ক্রেতাদের হালখাতার কার্ড দিয়ে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। তিনি মনে করেন ‘আগের যুগে হালখাতা যেমন ছিল, এখনও হালখাতার প্রয়োজন কমেনি। বাংলা সংস্কৃতির অংশ হিসেবে হালখাতা টিকে থাকবে যুগের পর যুগ।’

মুঘল সম্রাট আকবরের সময় থেকে শুরু হয় পয়লা বৈশাখে হালখাতা উৎসব। হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিন ব্যবসায়ীদের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। সে সময় প্রজারা খাজনা পরিশোধ করতেন চৈত্র মাসের শেষ পর্যন্ত। পয়লা বৈশাখে জমিদাররা প্রজাদের মিষ্টিমুখ করানোর পাশাপাশি করতেন আনন্দ উৎসব। এ ছাড়া ব্যবসায়ী ও দোকানদার বৈশাখের শুরুর দিনে করতেন ‘হালখাতা’ অনুষ্ঠান। নিজ নিজ ধর্মের রীতি অনুযায়ী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ধর্মীয় আচার পালনের মধ্য দিয়ে শুরু করে বছরের প্রথম দিন।



অতীতে ব্যবসায়ীদের কাছে হালখাতা ছিল বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব। বৈশাখের প্রথম দিন গ্রামবাংলা, মফস্বল বা শহরে, ছোট-মাঝারি-বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আয়োজন করা হতো হালখাতার। পুরোনো হিসাবের খাতা বন্ধ ও নতুন খাতা খোলার আনন্দ-আয়োজন; আপ্যায়ন ও আনুষ্ঠানিকতার নামই হালখাতা।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ এপ্রিল ২০১৮/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়