ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শওকত আলীর লেখক হয়ে ওঠা

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ২৫ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শওকত আলীর লেখক হয়ে ওঠা

প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান: প্রত্যেক লেখকেরই লেখালেখিতে আসার পেছনে একটি গল্প থাকে। নিজের কথাগুলো বলতে তারা কাগজ-কলম নিয়ে বসেন। লেখা হয় গল্প, কবিতা, উপন্যাস। লেখা শেষে প্রকাশের স্পৃহা জাগে। এভাবে লিখতে লিখতে, পড়তে পড়তে আরো পরিণত হয়ে ওঠেন তিনি।

একজন লেখক সময়কে কলমের আঁচড়ে আঁকেন। জীবনের অনুভব, অভিজ্ঞতাগুলোকে পরিণত করেন শব্দশিল্পে। এভাবেই আমরা লেখককে তার সৃষ্টিসম্ভার নিয়ে পাঠকের সামনে উপস্থিত হতে দেখি। আমাদের সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কথাকার শওকত আলী। তার ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ বাংলা ভাষার বহুল আলোচিত উপন্যাস। তার লেখনী দীর্ঘদিন ধরে পাঠককে আবিষ্ট ও আচ্ছন্ন করে রেখেছে।  অন্য সবার মতো এ বরেণ্য লেখকেরও রয়েছে লেখক হয়ে ওঠার গল্প।

শৈশব থেকেই শওকত আলী ছিলেন কৌতূহলী। বইয়ের প্রতি আগ্রহ ছিলো প্রবল। স্কুল জীবনেই তিনি শরৎচন্দ্র ও বঙ্কিমচন্দ্রের আগ্রহী পাঠক ছিলেন। পত্রিকা পড়তেন, কখনো লাইব্রেরিতে যেতেন। বাড়িতে পারিবারিক আবহের কারণে প্রচুর বই পড়ার সুযোগ হয়েছে তার। শৈশবের পঠন-পাঠনের বিষয়ে শওকত আলী কবি মারুফ রায়হানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত বলেছেন। তার জবানীতে পাই, ‘বাড়ির কাছেই একটা পাবলিক লাইব্রেরি ছিল। সেখান থেকেও বই আনতেন বাবা। তিনি ইংরেজি, বাংলা দুই ভাষাতেই নানা বিষয়ের ওপর লেখা বই পড়তেন। আর মা পড়তেন শুধু বাংলা বই আর পত্রিকা। তার আকর্ষণের বিষয় ছিল গল্প আর উপন্যাস। স্কুলের সীমানা ছাড়ার আগেই বাংলা ভাষার লেখক-কবিদের নাম জানা হয়ে গিয়েছিল।’

অর্থাৎ স্কুলে থাকতেই তিনি বঙ্কিম, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, জসীমউদ্দীন, তারাশঙ্কর, বিভূতি, মানিক, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, বনফুল, সমরেশ বসু প্রমুখের লেখা পড়েছিলেন। সমবয়সী বন্ধুরা যখন খেলাধুলা করতো তখনও শওকত আলীর হাতে থাকতো বই। এই বইপ্রীতি থেকেই তিনি লিখতে শুরু করেন। তার ভাষ্যে: ‘ওই পড়তে পড়তেই আমার লিখতে ইচ্ছা করতো। তাই লিখতামও কিন্তু কোনোটাই শেষ হতো না। তার আগেই ছিঁড়ে ফেলে দিতাম। কেউ জানতো না আমার এই খাতার পাতা নষ্ট করে লেখা আর ছিঁড়ে ফেলে দেওয়ার কথা। তবে মায়ের নজর এড়াতে পারিনি। তিনি দেখতেন, কিন্তু কিছু বলতেন না। আমার চোখে চোখে তাকিয়ে থাকতেন।’

শওকত আলীর বাবাও কখনো তার সাহিত্যপাঠ ও লেখালেখির বাধা হয়ে দাঁড়াননি। বরং বাবা ও মায়ের বইপ্রীতি তাকে লেখক হতে আরো বেশি অনুপ্রাণিত করেছিলো। শওকত আলীর লেখালেখির সূচনা হয়েছিলো ছড়া-কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। তার ভাষায়, ‘প্রথম জীবনে আমি আবেগাক্রান্ত হয়ে বহু ছড়া-কবিতা লিখেছি। গল্প-টল্প লেখা ধরেছি তার অনেক পরে। স্কুলে আর আট-দশজনের মতো আমার ভেতরেও ‘ভাবে’র উদয় হতো। এই ‘ভাব’ উদয় হওয়ার ফলাফল ছিল ছড়া-কবিতা।’ স্কুল জীবনজুড়ে চলে তাঁর ছড়া-কবিতা চর্চা। তারপর কলেজে ওঠে তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এসময় তিনি গল্প লেখা শুরু করেন। সহপাঠী বন্ধুরা তার লেখা পড়তেন এবং এসব লেখা ঢাকা ও কলকাতার পত্রিকাগুলোতে পাঠাতে উৎসাহিত করতেন। তার প্রথম গল্প ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

এছাড়াও কলেজ জীবনে তাঁর গল্প-কবিতা ঢাকার ‘ইত্তেফাক’সহ কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো। ফলে বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই তিনি গল্পলেখক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ছাত্রাবস্থাতেই তার গল্পের প্রশংসা করেছিলেন বরেণ্য লেখকরাও। এমনকি ভালো গল্প লেখার সুবাদে তিনি মুনীর চৌধুরী ও জিসি দেবের সুপারিশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নিয়ে পড়ার সুযোগ পান। ‘কালি ও কলম’-এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে শওকত আলী এ ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে আমার একটা মজার গল্প আছে। যেহেতু রেজাল্ট খারাপ তাই প্রথম দিন বাংলা বিভাগ আমাকে নিল না। মন খারাপ করে বেরিয়ে আসছিলাম। কলা ভবনের সামনে আসতেই জিসি দেব আর মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে দেখা। মুনীর চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন, মন খারাপ কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারিনি, মন কি আর ভালো থাকে? মুনীর স্যারকে জানালাম। মুনীর চৌধুরী তখন জিসি দেবকে বললেন, ও হচ্ছে শওকত আলী, ভালো গল্প লিখে। তখন জিসি দেব বললেন, ওকে তো আমি কলেজ থেকেই চিনি। তারপর জিসি দেব আর মুনীর চৌধুরী আমাকে নিয়ে গেলেন বাংলা বিভাগে। তারপরে, ভর্তি হয়ে গেলাম।’

শওকত আলী দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাস করেছিলেন। এমএ পড়ার জন্যে ঢাকা বসবাস শুরু করলে তার সাহিত্য চর্চা যেমন গতিশীল হয়েছে, তেমনি বেড়েছে তার পরিচিতিও। এসময় তিনি কবি আহসান হাবীব, হাসান হাফিজুর রহমান ও সিকান্দার আবু জাফরের সান্নিধ্য লাভ করেন। তারা শওকত আলীর লেখা গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করতেন। ছড়া-কবিতা, প্রবন্ধ ও গল্প লিখলেও শওকত আলীর প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ ছিলো উপন্যাস ‘পিঙ্গল আকাশ’। এটি ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয়। তখন শওকত আলীর বয়স ২৭। ততদিনে তিনি সুধী সমাজের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উন্মুল বাসনা’ প্রকাশিত হয় আরো পাঁচ বছর পরে, ১৯৬৮ সালে। একই বছর তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।

অন্যদিকে শওকত আলীর বিখ্যাত রচনা ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ আগে লেখা হলেও এটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৮৪ সালে। এই বইটি লেখার পেছনেও তার স্কুল জীবনের বইপাঠ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। সেসময়ে লাইব্রেরিতে বই পড়তে গিয়ে হঠাৎ তার হাতে পড়ে ‘শেখ শুভদয়া’ গ্রন্থটি। এ বইটির পাঠ শওকত আলীর মধ্যে নতুন চিন্তার সূচনা করে। সে চিন্তার প্রকাশ হিসেবেই লেখা হয়েছিলো ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’-এর মতো অমূল্য উপন্যাস। আর্টস বিডিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘ লাইব্রেরীতে পড়তাম। হঠাৎ একটা বই আমার চোখে পড়ে গেছে। সংস্কৃত বই। তখন তো মোটামুটি পড়তে পারি। ...সুতরাং ওই সময়ে বই পড়তে অসুবিধা হয়নি। ওই ‘শেখ শুভদয়া’ বইটি পড়েছি। ...শেখ শুভদয়ার বাংলা করলে দাঁড়ায় শেখের শুভ উদয়। মুসলমানদের ‘শেখ’ বলা হতো। বইটা পড়ে আমার মনে হয়েছিল, এবং এই পর্বটা নিয়ে আমার কৌতূহল ছিল। এটা নিয়ে আমি কল্পনাও করেছি। এর ফলে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ বইটি আমি লিখেছি।’

শওকত আলীর রচনাগুলোতে ঘুরেফিরে এসেছে নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন ও যাপন, দহন ও বেদনা, শোষণ ও বঞ্চনার কথা। এর পেছনে তার ছাত্রজীবনের প্রভাব রয়েছে। তিনি ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, একবার জেলও খেটেছিলেন। নিজের লেখায় নিম্নবৃত্ত মানুষের উপস্থিতির কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শওকত আলী বলেছেন, ‘ছাত্র ইউনিয়ন করার সুবাদে আমার একটা স্বভাব ছিল, আমি সবসময় শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে থাকতাম। তাদের সঙ্গে চলাফেরা করে আমি জীবনে অনেক কিছু শিখেছি। পরে এই সমস্ত মানুষ আমার গল্পে উঠে এসেছে নানা রূপে, নানা মাত্রায়।’ স্কুল জীবনের সেই বইপাগল ছাত্রটিই পরবর্তীতে আমাদের উপহার দিয়েছে ‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘উত্তরের খেপ’, ‘কুলায় কালস্রোত’-এর মতো গ্রন্থ। গল্প উপন্যাস মিলিয়ে শওকত আলী প্রায় ৪০টি গ্রন্থ লিখেছেন। অর্ধশতাব্দি ধরে সাহিত্য চর্চা অব্যাহত রেখেছেন তিনি। তার রচনা সমৃদ্ধ করেছে বাংলা সাহিত্যকে। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্যে সরকার ১৯৯০ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। আজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা গেলেন। বেশ কিছুদিন হলো বরেণ্য এই লেখক অসুস্থ হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন। আমরা তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

আরো পড়ুন : 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ জানুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়