ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

শতাব্দীর বিরলতম কবি বিনয় মজুমদার

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শতাব্দীর বিরলতম কবি বিনয় মজুমদার

রুহুল আমিন : আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমিষেই

গলাধঃকরণ তাকে না ক’রে ক্রমশ রস নিয়ে

তৃপ্ত হই, দীর্ঘ তৃষ্ণা ভুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে।

অনেক ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণে

জেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে, কাকে বলে নীল-

 

আকাশের হৃদয়ের; কাকে বলে নির্বিকার পাখি।

অথবা ফড়িঙ তার স্বচ্ছ ডানা মেলে উড়ে যায়।

উড়ে যায় শ্বাস ফেলে যুবকের প্রাণের উপরে।

আমি রোগে মুগ্ধ হয়ে দৃশ্য দেখি, দেখি জানালায়

আকাশের লালা ঝরে বাতাসের আশ্রয়ে আশ্রয়ে।

আমি মুগ্ধ; উড়ে গেছ; ফিরে এসো, ফিরে এসো, চাকা,

রথ হয়ে, জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো।

আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন

সুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথীবীর সব আকাশে। (আমার আশ্চর্য ফুল)

কিংবা ‘মুকুরে প্রতিফলিত’ কবিতার শেষ লাইন, ‘মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়!’ এমন অসংখ্য বোধ, বিমূর্ত ছবি তৈরি করেছেন শব্দ দিয়ে, সৃষ্টি করেছেন নিজস্ব জগত। বলছি কবি বিনয় মজুমদারের কথা। আজ ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪ সালের  এই দিনে বাবার কর্মস্থল তখনকার বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) তেতো শহরে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা কবিতার শক্তিমান কবি বিনয় মজুমদার।

মৌলিক কবিতার রূপকার বিনয় মজুমদারের পক্ষেই কেবল বলা সম্ভব ‘ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?’ শতাব্দীর বিরলতম কবি বলে অনেকে।  বলা হয় বাংলা কাব্যের প্রথম সফল বৈজ্ঞানিক কবিও।

বিনয় মজুমদারের পৈতৃক নিবাস গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার (পূর্বনাম টেংরা খোলা) বহুগ্রাম ইউনিয়নের তারাইল গ্রামের মৃধাবাড়ী। তাদের বংশপদবি ছিলো মৃধা। পরে 'মজুমদার' পদবি ধারণ করেন। তারাইল গ্রামের বিপিন মৃধার (বিপিন বিহারী মজুমদার) ছেলে তিনি। তার মায়ের নাম বিনোদিনী দেবী। বাবা বিপিন মজুমদার বৃটিশ-ভারতের নৌবাহিনীতে চাকরি করতেন।

১৯৪২ সালের শেষের দিকে তাদের পরিবার  তৎকালীন ফরিদপুর জেলার (বর্তমান গোপালগঞ্জ) আদিবাস তারাইল গ্রামের মৃধাবাড়ী চলে আসেন। সেখানে তারাইলস্থ গ্রাম্য পাঠশালা থেকে বিনয় প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। পরে তিনি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার বৌলতলী ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে একবছর পড়ার পর তিনি ফরিদপুর জেলা স্কুলে চলে যান। পরে দেশবিভাগের কিছুকাল আগে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং ১৯৪৭ সালের প্রথম দিকে কলকাতার মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন।  ১৯৪৮ সালে তিনি প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। পরে ওই কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে আইএসসি পরীক্ষায় পাস করে ১৯৫১ সালে শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন।

১৯৫৭ সালে ওই কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। ওই কলেজে পড়ার সময়ই অগ্রজ কবি বিষ্ণু দে এবং বিমল চন্দ্র ঘোষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।  তারও আগে ১৩ বছর বয়সে ফরিদপুর জিলা স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কবিতা লেখা শুরু করেন তিনি।  কবি বিষ্ণু দে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত প্রমুখের সমসাময়িক ছিলেন বিনয়।

কর্মজীবনে ১৯৫৮ সালে বিনয় মজুমদার অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন এবং পাবলিক হেলথে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটেও স্বল্পদিন চাকরি করেন। ত্রিপুরা গভর্নমেন্ট কলেজেও তিনি অধ্যাপনা করেন। দুর্গাপুরে স্টিলপ্ল্যান্টেও কিছুদিন কাজ করেন। একসময় তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে কাব্য সাধনাতে আত্মনিয়োগ করেন।

বিনয় মজুমদার বাংলা কবিতার জগতে এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। জীবিত অবস্থাতেই তিনি মিথ ও কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।আত্মমগ্ন এ কবি উত্তর চব্বিশ পরগনার ঠাকুর নগর স্টেশনসংলগ্ন শিমুলপুর গ্রামে এক জীর্ণঘরে আমৃত্যু নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেছেন-কবিতাকে সঙ্গী করে। অকৃতদার বিনয়ের কাছে কবিতাই ছিলো তার প্রেয়সী, বিশ্বস্ত বন্ধু, জীবনীশক্তি ও প্রেরণা। কবিতার সঙ্গেই তার বসবাস, চাষাবাস জীবনের।

বৌলতলি হাই-ইংলিশ স্কুলের ম্যাগাজিনে প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় তার। ত্রিপুরা গভর্নমেন্ট কলেজে অল্পকিছুদিন শিক্ষকতা করার পর স্থির করেন শুধুই কবিতা লিখবেন। লেখা শুরু করেন 'ফিরে এসো চাকা'। এই সময় তিনি দুর্গাপুর স্টিল প্লান্টেও কিছুদিন কাজ করেন। তখন থেকেই মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ দেখা যায়। ১৯৬৬ সালে লিখতে শুরু করেন 'আঘ্রাণের অনুভূতিমালা' ও 'ঈশ্বরীর স্বরচিত নিবন্ধ'। বিশটির মতো কাব্যগ্রন্থ রয়েছে তার। যার মধ্যে "ফিরে এসো চাকা" তাকে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি দিয়েছে।

এছাড়া নক্ষত্রের আলোয়, গায়ত্রীকে, অধিকন্তু, ঈশ্বরীর, বাল্মীকির কবিতা, আমাদের বাগানে, আমি এই সভায়, এক পংক্তির কবিতা, আমাকেও মনে রেখো-ইত্যাদি রচনা করেছিলেন। ১৯৬২-৬৩ সালে বিনয় মজুমদার হাংরি আন্দোলন-এ যোগ দেন এবং তার কয়েকটি কবিতা হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত হয়।

বিনয় মজুমদার ২০০৫ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান। এ ছাড়াও কৃত্তিবাস পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। কবি জীবনের শেষদিকে অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। তাকে দেখার কেউ ছিল না। রোগে-শোকে কাতর কবি বিনয় মজুমদার ৭২ বছর বয়সে ২০০৬ সালের ১১ ডিসেম্বর চবি্বশ পরগনার ঠাকুরনগরের শিমুলপুর গ্রামে বিনোদিনী কুটিরে মারা যান।মৃত্যুর পর  তার মৃতদেহ নিয়ে ঠাকুরনগরে বিশাল শোক মিছিল ও শবযাত্রা হয়। কলকাতার কবি বুদ্ধিজীবী ও কবি ভক্তরা তাতে অংশ নেন। পরে শিমুলপুরেই তাকে সমাহিত করা হয়।

বিনয় সম্পর্কে কিংবদন্তি বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক বলেছেন, ‘আমি সাম্প্রতিকালের এক কবির সম্পর্কে আশা রাখি, যিনি কবিতার জন্যে যথার্থ জন্মেছেন। আমার মনে হয় একালে বাংলাদেশে এত বড় শক্তিশালী শুভবুদ্ধি-সম্পন্ন কবি আর জন্মাননি। তিনি হলেন বিনয় মজুমদার।’

বিনয়ের কবিতার গভীরে পাঠে বোঝা যায়, তিনি ‘বিরহের জীবন’কে একটি সমীকরণে মেলাতে চেষ্টা করেছেন। বাস্তব আর বিরহকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে প্রেমের সত্যদর্শন খোঁজার চেষ্টা করেছেন। প্রেমের অভিভাষণ ভিন্নতর প্রকরণে উপস্থাপনে সক্ষম হয়েছেন তিনি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭/রুহুল/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ