ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

যেখানে দালালই ধান বিক্রির মাধ্যম

বিএম ফারুক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:০১, ২২ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যেখানে দালালই ধান বিক্রির মাধ্যম

গত ২৭ মে শার্শার নাভারণ খাদ্য গুদামে বোরো ধান সংগ্রহের উদ্বোধন করেন সংসদ সদস্য আলহাজ শেখ আফিল উদ্দিন

যশোর প্রতিনিধি: যশোরের শার্শা উপজেলায় কৃষকরা সরাসরি তাদের ধান উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিসে বিক্রি করতে পারছে না। ধান বিক্রি করতে দালালই এখানের মাধ্যম। ফলে প্রকৃত মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কৃষক।

শার্শা উপজেলায় গত ২৬ মে থেকে সরকারিভাবে বোরো ধান সংগ্রহ শুরু হয়েছে এবং ধান ক্রয় চলবে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।

শার্শা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৌতম কুমার শীল বলেন, আমার দায়িত্ব শুধু প্রকৃত কৃষকদের নামের তালিকা তৈরি করা। সে হিসাবে আমি ৯ ধাপে প্রায় ৩ হাজার ২০০ কৃষকের তালিকা খাদ্য অফিসে পাঠিয়েছি। ৬৫২ মেট্রিকটন ধান ক্রয়ের কথা কিন্তু তারা এ পর্যন্ত ১৫০ মেট্রিকটন ধান ক্রয় করেছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে গিয়ে ধান ক্রয়ের কথা কিন্তু তারা ইউনিয়ন পর্যায়ে যাচ্ছেন না।

সূত্র জানায়, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইন্দ্রজিৎ সাহা, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান ও নিরাপত্তা প্রহরী হারুনের সহযোগিতায় প্রতি ইউনিয়ন থেকে কয়েকজন ধান ব্যবসায়ী (আড়ৎদার) ও সরকারি দলের প্রভাবশালী কিছু লোকের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট চক্রের সদস্যরা কৃষকদের নানা কথায় ম্যানেজ করে তাদের ভর্তুকির কৃষি কার্ড সংগ্রহ করছে। কৃষকের নিকট থেকে কমমূল্যে ধান কিনে ওই কৃষি কার্ড ব্যবহার করে সরকারি খাদ্য গুদামে মণ প্রতি ১ হাজার ৪০ টাকা দরে বিক্রি করছে। কার্ড প্রদানকারী সহজ-সরল কৃষকদেরকে ওই সিন্ডিকেট সান্ত্বনা স্বরুপ দিচ্ছে ৩০০/৩৫০ টাকা। সিন্ডিকেটের বাইরে কোন কৃষক ধান বিক্রি করার জন্য খাদ্য গুদামে গেলে কর্তৃপক্ষ সাফ জানিয়ে দিচ্ছে ধান কেনা শেষ হয়ে গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শার্শা উপজেলায় চলতি মৌসুমে বোরো ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৬৫২ মেট্রিক টন এবং প্রতি কেজি ২৬ টাকা দরে তালিকাভূক্ত কৃষকদের নিকট থেকে মাঠ পর্যায়ে সরাসরি ধান কেনার কথা। একজন প্রকৃত কৃষকের নিকট থেকে সর্বোচ্চ ৩ মেট্রিক টন ধান কেনার বিধান থাকলেও এ দপ্তর ঘোষণা দিয়েছে প্রতি কৃষকের কাছ থেকে মাত্র ১৫ মণ ধান কেনা হবে। সরকারিভাবে বোরো ধান সংগ্রহ করা হবে ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষকের দ্বারে দ্বারে যেয়ে কিন্তু এ দপ্তরের কর্তা ব্যক্তিরা তা মানছেন না। তালিকাভূক্ত কোন কৃষক ধান নিয়ে গেলে এ ধানে ময়েশ্চার বেশি, চিটা আছে বলে ফেরত দিচ্ছেন কিন্তু ওই কৃষক পরক্ষণে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ধান জমা দিলে অফিস ধান নিচ্ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে একজন কৃষক ১৫ মণ ধান বিক্রি করে যে টাকা লাভ করবে, সেই লাভের টাকা দিতে হবে ধান আনার জন্য ট্রলি বা ভ্যান চালককে। যদিওবা ধান গুদামে দিতে পারে, আর না নিলে যা হবার তাই হয়। অথচ সিন্ডিকেট সদস্যরা অফিসের সহযোগিতায় বাজারের কৃষকের নিকট থেকে সাড়ে ৫’শ টাকা দিয়ে হীরা ধান কিনে কোন প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই সরকারি গুদাম ভর্তি করছে। মে মাসের প্রথম দিকে সরকারি গুদামে যদি ধান কেনা হতো তাহলে কৃষকরা লাভবান হতো।

এদিকে আবহাওয়া ভাল থাকায় কৃষকেরা বোরো ধান কাটা ও মাড়াই আগেই শেষ করেছে। জমি চাষ, সেচ, সার, কীটনাশক ও ধান কাটার খরচ মেটাতে তারা বাধ্য হয়ে কম দামে ধান বিক্রি করে রীতিমতো হিমশিম খেয়েছেন। সরকারি দাম ভালো থাকলেও সঠিক সময়ে সংগ্রহ শুরু না হওয়ায় তারা ধান দিতে পারেনি।

প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চক্রের ভয়ে ভীত নাম প্রকাশ না করার শর্তে দক্ষিণ বুরুজ বাগানের কৃষক বলেন, ‘সরকার ঘোষণা করেছে যে সকল কৃষকের ভর্তুকির কার্ড আছে তাদের নিকট থেকে ১ হাজার ৪০ টাকা মণ দরে ধান সংগ্রহ করা হবে। নিয়ম অনুযায়ী আমি অফিসে গেলে লেবার ও কর্মকর্তারা বলেন ধান নেওয়া শেষ হয়ে গেছে। তাই আমাকে ফিরে যেতে হল। আমি ধান দিতে পারি নাই কিন্তু এখনও ধান নিচ্ছে।’

কন্দর্পপুর গ্রামের কৃষক জানান, ১ হাজার ৪০ টাকা দরে অফিসের সহযোগিতায় এক শ্রেণির সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ধান কেনা হচ্ছে। অফিসের লোকজন ও দালালের মাধ্যম ছাড়া এসব সম্ভব না।

নিজামপুরের একজন কৃষক জানান, যাদের কোন জমিজমা নেই কিন্তু ভর্তুকির কার্ড আছে। এই কার্ড এক শ্রেণির লোক সংগ্রহ করে অফিসে ধান দিচ্ছে। নাভারণ গুদামে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ধান যাচ্ছে।

গত ১৩ জুন শার্শা উপজেলা মাসিক সভায় ইউনিয়ন পর্যায়ে যেয়ে ধান না কেনা নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান অভিযোগ করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে উপজেলা মাসিক সভার কিছু কথোপকথন তুলে ধরা হল:

নির্বাহী কর্মকর্তা: ইউনিয়নে যেয়ে এখন ধান কেনা হচ্ছে কিনা?
খাদ্য নিয়ন্ত্রক: না।

নির্বাহী কর্মকর্তা: ইউনিয়নে যান।
খাদ্য নিয়ন্ত্রক: এমনি আমার দপ্তরে জনবল কম আছে। এখন যদি আমাদের ইউনিয়ন পর্যায়ে যেয়ে ধান কিনতে হয় তাহলে এদিকে সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।

নির্বাহী কর্মকর্তা: এছাড়া আপনার অফিসে কাজ কি? বর্তমানে ধান কেনা ছাড়া আপনার আর কোন কাজ নেই?
খাদ্য নিয়ন্ত্রক: না স্যার আছে। প্রত্যেক দপ্তরে কিছু কাজ আছে।

নির্বাহী কর্মকর্তা: ধান কেনা ছাড়া আর কি কাজ?  ধান কেনাইতো আপনার কাজ।

খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কথায় উপস্থিত সকলের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
খাদ্য নিয়ন্ত্রক: প্রথম পর্যায়ে ইউনিয়ন থেকে কিছু ধান কিনেছিলাম। 

উপজেলা চেয়ারম্যান: সরকার চাচ্ছে মাঠ পর্যায় থেকে ধান কিনতে। সেখানে না কিনলে সরকারের উদ্দেশ্য সফল হবেনা। ফুড গোডাউনে যা করা হচ্ছে তা সাকসেসফুল হবেনা। নাভারণে কিছু সিন্ডিকেট আছে এবং কে কে থাকে কারা নিরুৎসাহিত করে আমি নাম জানি এবং দীর্ঘদিন যাবৎ তারা এগুলো করে আসছে। সিন্ডিকেট সদস্যরা কৃষকদের বলে- সরকারি গোডাউনে আপনারা ধান সাপ্লাই দিতে পারবেন না, কেন ঝামেলায় যাবেন। এ ধরনের ব্যবহার করে, আমি জানি। আমার কাছে রিপোর্ট আছে।   

নির্বাহী কর্মকর্তা: এখন আমার মনে হয় আপনাদের ভাল হবে মাঠ পর্যায়ে যেয়ে ধান সংগ্রহ করা। আমরা প্রতিটা ইউনিয়নে যাই। যে ইউনিয়নে যেটুকু বাকি আছে সেই ইউনিয়ন থেকে সেটুকু সংগ্রহ করি। না হলে আপনার এখানে এসে ওই কৃষক কি ধান দেবে। আমরা যদি মাঠ পর্যায়ে না যাই তাহলে ওই কৃষককে যদি ৩ টনও দিতে বলি তা দেবে আরেকজন এটা আমি জানি।
খাদ্য নিয়ন্ত্রক: ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেম্বাররা যদি সহযোগিতা করে কৃষকদের বলে ১৫ মণ করে দুই/তিন জন একটা ট্রলিতে করে নিয়ে আসলে এই সমস্যাটা আর থাকবে না।

নির্বাহী কর্মকর্তা: সমস্যা আপনার ওই টা না। সমস্যা হল আপনার এখানে আসলেই সিন্ডিকেট হচ্ছে।
খাদ্য নিয়ন্ত্রক: সিন্ডিকেট বলতে অনেকের হয়ত আত্মীয়-স্বজন আছে।

নির্বাহী কর্মকর্তা: আমরা সিন্ডিকেট হতে দেব না।

উপজেলা চেয়ারম্যান: সিন্ডিকেট যাচ্ছে না। তারা লাস্ট মোমেন্টের জন্য বসে আছে, তখন তারা এসে এগুলো চাপায় দিবে এবং বিগত দিনে তারা এগুলো করেছে।




রাইজিংবিডি/যশোর/২২ জুন ২০১৯/বি এম ফারুক/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়