ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ পদ্ধতি নিয়ে কিছু কথা

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪৫, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ পদ্ধতি নিয়ে কিছু কথা

মাছুম বিল্লাহ : সরকার প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি কলেজ জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতিমধ্যে তিন দফায় ২৮১টি কলেজ জাতীয়করণের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন। অর্ধশত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও জাতীয়করণ প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এসব স্কুল ও কলেজ জাতীয়করণ করতে গিয়ে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে।

 

অভিযোগ উঠেছে ‘চাকরি সরকারী হবে’ এমন কথা বলে শিক্ষকদের কাছ থেকে দেড় থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। অনেকটা প্রকাশ্যেই এ টাকা তুলছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানপ্রধান, বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ ও গভর্নিং বডি। আবার জাতীয়করণের সম্মতি পাওয়ার আগে ও পরে পেছনের তারিখ দিয়ে পদ ছাড়াই অতিরিক্ত শিক্ষক নেওয়া হয়েছে কিছু জায়গায় টাকার বিনিময়ে। ফলে জাতীয়করণের তালিকায় থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে! অনেক উপজেলায় দীর্ঘদিনের পুরনো ও যোগ্য প্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে জাতীয়করণের তালিকা করা হয়েছে। এতে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে অসন্তোষ। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া কলেজ জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীর আন্দোলনে পুলিশি বাধার মধ্যে পড়ে মারা গেছেন ওই কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ ও পথচারী সফর আলী। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বেশ ক’দিন লেখালেখিও হয়েছে।

 

শিক্ষার ভিত্তি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা তথা প্রাথমিক বিদ্যালয়। তাই জাতীর জনক প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে। এটি ছিল একটি যুগান্তকারী এবং সঠিক দেশনায়কোচিত পদক্ষেপ। তারপরের সরকারগুলোর দরকার ছিল মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্তু ৩১৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে সরকারী করণের মধ্য দিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষায় এক বিরাট বৈষম্য সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে বহু বছর ধরে। পরের সরকারগুলো প্রতিটি উপজেলা বা ক্রমান্বয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের প্রক্রিয়া শুরু করে কিন্তু শিক্ষক সমিতিগুলো তাতে বাঁধা দেয়। তাদের দাবি হয় একসাথে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারী করতে হবে নয়তো একটিও না।

 

এর যুক্তি আছে। বেছে বেছে কিছু স্কুল জাতীয়করণের অর্থ হচ্ছে শিক্ষায় এক ধরনের ইচ্ছাকৃত বৈষম্য সৃষ্টি করা। দেশ স্বাধীন, সরকার জনগণের ইচ্ছাপূরণ করবে। ধীরে ধীরে শিক্ষার সুযোগ সুবিধা সম্প্রসারণ করবে সকল প্রতিষ্ঠানের জন্য; নির্দিষ্ট করে নয়, সাধারণ জনগনের জন্য; একটি-দুটি প্রতিষ্ঠান নয়, জনমানুষের সকল প্রতিষ্ঠান। যেহেতু কাজটি অনেক কঠিন তাই ধীরে ধীরে সকলের জন্য অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধি করা যেত। যেমন ২০ শতাংশ সরকারী অনুদান থেকে শিক্ষকদের আন্দোলন ও সরকারের সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে আজ তা শতভাগে উন্নীত হয়েছে। এভাবে ধীরে ধীরে সকল প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় সুবিধার আওতায় আসবে- এটি কাম্য ছিল। কিন্তু বাছাইকৃত কিছু বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা মানে বৈষম্য সৃষ্টি করা এবং এটি একটি অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি।

 

দ্বিতীয়ত, দেশের প্রায় বিশ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩১৭টি পুরোপুরি সরকারী। বর্তমান সরকার আরও আঠারোটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারী করার ঘোষণা দিয়েছে, এখন শুনছি প্রায় অর্ধশত প্রতিষ্ঠানের কথা। এর সঠিক কোনো হিসাব এখনও আমরা জানি না। ধরে নিলাম অর্ধশতই; কিন্তু কেন? আবার ২৮১টি কলেজ সরকারী করার ঘোষণাই বা কেন? মাধ্যমিক শিক্ষা এড়িয়ে বা কম গুরুত্ব প্রদান করে হঠাৎ কলেজ জাতীয়করণের বিষয়টি একটু বেমানানই মনে হচ্ছে।  প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা যখন সবদিক দিয়ে সঠিকমানে পৌঁছাবে তখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোক জাতীয়করণ করে মান নিশ্চিত করতে হবে। মাধ্যমিক পর্যায়ে মান নিশ্চিত হলে কলেজ তথা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের বিষয় চিন্তা করা যেতে পারে। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার পরেই দেখা যায়, কলেজ জাতীয়করণ করা হচ্ছে। মাঝখানে শিক্ষার যে পর্যায়টি রয়েছে সেটির কী অবস্থা হবে? অবহেলিত থেকে যাবে? উচ্চশিক্ষার পুরো দায়িত্ব তো গরিব দেশের সরকার নিতে পারে না, তবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় সরকারের নজর ও গুরুত্ব বেশি বেশি থাকতে হবে। কিন্তু হচ্ছে ঠিক এর উল্টো।   

 

জাতীয়করণের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে শতাধিক কলেজ পরিদর্শন করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিদর্শক দল। তারা সরেজমিনে গিয়ে প্রায় প্রতিটি কলেজে সাম্প্রতিক সময়ে প্যাটার্নের চেয়ে অতিরিক্ত শিক্ষক থাকার প্রমাণ পেয়েছে। মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. এস এম  ওয়াহিদুজ্জামান জানান, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির পর সেই তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণলয় হয়ে আমাদের কাছে আসে। ওসব প্রতিষ্ঠানগুলোর কি অবস্থা আমরা তা সরেজমিনে তুলে ধরি। সেগুলো সরকারী হবে কিনা তা সরকারের ব্যাপার। আর প্রথমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হবে তারপর শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ হবে। এখন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই অতিরিক্ত শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে যা আমরা তুলে ধরেছি। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। একবারে যেহেতু অনেক শিক্ষকের চাকরি সরকারী হবে তাই আত্তীকরণ নীতিমালা সংশোধনের প্রস্তাব এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে।’

 

জাতীয়করণের তালিকায় ঢুকতে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু মানদণ্ড থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। একটি উপজেলার সবচেয়ে ভালো করা প্রতিষ্ঠানটির নাম আগে আসতে হবে। সেই সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণ অবকাঠামোগত সুবিধা থাকতে হবে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের বয়স, আয়তন, সম্পত্তি, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা, শিক্ষক সংখ্যা, উপকৃত জনসংখ্যার সংখ্যাও বিবেচনায় আনার কথা। অন্য সরকারী কলেজ থেকে জাতীয়করণের তালিকায় থাকা কলেজের দূরত্ব, নারী-পুরুষ শিক্ষার্থীর অনুপাত ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে।

 

জাতীয়করণের তালিকায় থাকা কলেজগুলো সরকারী হলে ১০ হাজার শিক্ষক সরকারী হবেন কিন্তু তাদের ক্যাডারে অন্তর্ভুক্তি ও জেষ্ঠ্যতা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার সমিতি জাতীয়করণকৃত কলেজের শিক্ষকদের নন-ক্যাডারে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়েছে। আর জাতীয়করণকৃত কলেজের শিক্ষকগণ পুরো সরকারী কলেজের সুযোগ-সুবিধা চাচ্ছেন। ক্যাডারভুক্ত কয়েকজন কর্মকর্তা জানান যে, এতদিন এমপিওভুক্তি ও শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ ছিল। বেশির ভাগ শিক্ষক টাকার বিনিময়ে নিয়োগ পেয়েছেন। চাকরি জাতীয়করণের পর যদি এসব শিক্ষকগণ সরাসরি ক্যাডারভুক্ত শিক্ষক হন এবং তাদের মতো সুযোগ-সুবিধা পান তাহলে মেধার কোনো মূল্য থাকবে না। বিসিএস পাস করা শিক্ষকগণ মেধাবী। তা ছাড়া বদলী ও পদোন্নতিতেও সমস্যার সৃষ্টি হবে যদি জাতীয়করণকৃত শিক্ষকগণ সরাসরি ক্যাডারভুক্ত হন। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সভাপতি বলেছেন, ‘আত্তীকরণ নীতিমালা-২০০০ সংশোধন করে আত্তীকৃত শিক্ষকদের নন-ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করা হোক।’

 

প্রশ্ন হলো, ক্যাডারভুক্ত শিক্ষকগণ কেন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পারবেন না? সরকারী শিক্ষকগণের জাতীয় পরিচয় হচ্ছে তারা ক্যাডারভূক্ত শিক্ষক। তারা সরকারি কিংবা বেসরকারি যে কোন প্রতিষ্ঠানেই চাকরি করুক না কেন। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলে বরং অবহেলিত শিক্ষার্থীরা তাদের দ্বারা বেশি উপকৃত হবে। সরকারের এ উদ্যোগকে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বলে মন্তব্য করলেও বিষয়টির সাথে একমত হওয়া যায় না। সব বেসরকারী স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা আর্থিক ও পেশাগত মর্যাদায় বৈষম্যের যাতাকলে পিষ্ট। তবে, নতুন জাতীয় বেতন স্কেলের সাথে সংযুক্ত করায় এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অবস্থা আগের তুলনায় অনেকটা ভালোর দিকে গিয়েছে। তারপরও, আশা ছিল যে, সরকার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাকে জাতীয়করণ করবে। অর্থাৎ সব স্কুল ও কলেজকে আত্তীকরণের সিদ্ধান্ত একসাথে নেবে যাতে করে কোনো বৈষম্যের সৃষ্টি না হয়। কিন্তু হচ্ছেটা কী?

 

একই দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে এই দ্বিমুখী নীতি খুব ভালো ফল বয়ে আনবে বলেই মনে করি। এরশাদের মতো সরকার যদি এই কাজটি করতো তাতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। কারণ ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসে জনগণের কাতারে সামিল হওয়া সহজ কাজ নয়। কিন্তু যে দলটির জনগণের সাথে সম্পর্ক সেই পঞ্চাশ বছরের অধিককাল ধরে  সেই দলটি কীভাবে এমন জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে ভাবতে অবাক লাগে। সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও উপজেলার একটি প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করা মানে অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করা। সরকার যদি নতুন করে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করতো এবং সেখানে নতুনভাবে নতুন নিয়মে শিক্ষক নিয়োগ দিত তাহলে অসন্তোষ থাকতো না। এমনিতেই বিভিন্ন পেশজীবী বিভিন্ন কারণে বিভক্ত, শিক্ষক সমাজের মধ্যে আবার নতুন করে বিভক্তির রেখা এঁকে দেওয়া হলো এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে।

 

সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি এই জাতীয়করণের সাথে জড়িত সেটি হচ্ছে অবৈধ বাণিজ্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ ধরনের অবৈধ বাণিজ্য হতে থাকলে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যারা বের হবে তারা কী শিখবে? তারা জাতিকে ভবিষ্যতে কী দেবে? অবৈধ অর্থের বিনিময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নৈতিকতা কোন পর্যায়ের তা তো আমরা বুঝতেই পারছি। এই শিক্ষা বাণিজ্যের সাথে এলাকার জনপ্রতিনিধিদের যে গভীর সম্পর্ক সরকার বিষয়টি নিশ্চয়ই জানে। এতকিছু জেনেও কেন এই আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত বোধগম্য হচ্ছে না। বিষয়টি বরং আমাদের বিস্মিত করছে।

 

লেখক : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়