ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

শিক্ষায় সরকারকে যেখানে গুরুত্ব দিতে হবে

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৮, ৮ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শিক্ষায় সরকারকে যেখানে গুরুত্ব দিতে হবে

মাছুম বিল্লাহ: ইউনিসেফ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেদারল্যান্ডসে প্রাথমিক স্কুলে শিশুদের কোনো বাড়ির কাজ দেয়া হয় না; হলেও খুব কম। লেখাপড়া করতে শিশুদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয় না। ১২ বছর বয়স পর্যন্ত তাদের গুরুগম্ভীর কোনো পরীক্ষায় বসতে হয় না। দেশটির শিশুরা সবচেয়ে বেশি সুখী জীবন কাটায়। শিশুদের জন্য এই সুখী জীবন নিশ্চিত করাটাই সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রোজকার হোমওয়ার্ক নিয়ে মাথা ব্যথা নেই ফিনল্যান্ডের শিক্ষার্থীদের। ষোল বছর বয়সে গিয়ে তাদের মাত্র একটি বাধ্যতামূক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। আর আমরা প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কী করছি? বিষয়টি নতুন সরকারকে গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের আলোকে নির্ধারণ করা হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের কর্মকৌশল। এ লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছে কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ। সেটি তৈরির জন্য একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে এরই মধ্যে কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের সভাপতিত্বে এক বৈঠকে ওই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে এসডিজি ও নির্বাচনী ইশতেহার-২০১৮ বাস্তবায়নের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে বলা হয়। ওই কমিটিকে প্রাথমিক শিক্ষা পাঠচক্রের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে বলা হয়। লক্ষ্যটি হবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা, জ্ঞান আহরণ এবং দেশ ও জাতির অবিকৃত সত্য ইতিহাস জানার অধিকতর সুযোগ সৃষ্টি করা। এ ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা, ভাষাজ্ঞান ও গণিত জ্ঞানের গুরুত্ব বিবেচনায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভাষা ও গণিত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা বৃদ্ধি। ভাষাজ্ঞান ও গণিত জ্ঞানের গুরুত্ব বিবেচনায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের ভাষা ও গণিত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে। তবে বর্তমানে শিক্ষাখাতে একাধিক প্রকল্প থকালেও তা শিক্ষার মান উন্নয়নে খুব একটা কার্যকর ভূমিকা যে রাখতে পারছে না সেটি নতুন সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। বৈঠকে আরো বলা হয়, সরকারের নানা কল্যাণমুখী ও যুগোপযোগী উদ্যোগ সত্ত্বেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন গ্রেডসহ শিক্ষা খাতের কিছু ক্ষেত্রে বৈষম্য এখনও রয়ে গেছে, সরকারের চলতি মেয়াদে তা ন্যায্যতার ভিত্তিতে নিরসনের উদ্যোগ নেয়া হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জনে সব শিশুকে প্রাক-শৈশব ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে হবে।

সব দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য প্রাথমিক স্তর থেকে তাদের উপযোগী পাঠ্য বই প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হবে। স্কুল ফিডিং কর্মসূচি সব গ্রামে আধা-মফস্বল শহরে এবং শহরের নিম্নবিত্ত এলাকার স্কুলগুলোর পর্যায়ক্রমে সার্বজনীন করা হবে। আমরা স্বাগত জানাই এই মহতী উদ্যোগকে। এভাবেই একদিন বাংলাদেশকে সম্পূর্ণভাবে নিরক্ষরতার অভিষাপমুক্ত  হবে। প্রাথমিকে স্তরে ঝরে পড়ার হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হবে। গত এক দশকে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ২০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে বলে জানানো হয়। উপবৃত্তি দেয়া অব্যাহত থাকবে। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের মানদণ্ড হবে মেধা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা। এই বিষয়গুলো যদি সত্যিকারভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে বাংলাদেশের শিক্ষা অবশ্যই তার স্বর্ণযুগে প্রবেশ করবে। একটি ব্যবস্থা সংস্কারের নেপথ্যে যারা থাকেন, তাদের  যোগ্য করে তুলতে হয়। ফ্রান্স যেমন স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি যোগ্য শিক্ষক বাছাই, শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করতে মনোযোগী। জাপানে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও বাছাই করার ক্ষেত্রে দেয়া হয় বিশেষ গুরুত্ব। ভুটান থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রয়েছে শতভাগ প্রশিক্ষিত শিক্ষক। এই রাষ্ট্রগুলো দায়িত্ব নিয়ে তাদের শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করেছে। অথচ এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান অনেক দুরে। ইউনেস্কোর গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং প্রতিবেদনে দেখা যায়- পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, মিয়ানমারে যেখানে ৮০-৯০ শতাংশেরও বেশি প্রশিক্ষিত শিক্ষক রয়েছেন, সেখানে বাংলাদেশে এই হার মাত্র ৫০। এই হারের প্রশিক্ষণও বাস্তবক্ষেত্রে যে কতটা প্রয়োগ করা হয় তারও কোনো হিসাব নেই। উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা অনুসরণ করে আমাদের প্রাথমিক-মাধ্যমিকের পাঠদান ব্যবস্থার ক্ষতগুলো সারিয়ে তুলতে হবে। প্রাথমিকের শেষ বছরে শিক্ষার্থীদের পিইসির মতো চাপযুক্ত পরীক্ষায় বসিযে দেয়াটা কতটা যুক্তিসঙ্গত, ভাবতে হবে। আমরা পরীক্ষা নামক অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হাতে গোনা কয়েকজনের সেরা হিসেবে বাছাই করে সমগ্র শিশুদের মনের ওপর অযথা চাপ তৈরি করছি। কারণ আমরা বড়রা জানি না, কীভাবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সৃজনশীল করা যায়। সৃজনশীলতার কথা বলে বলে আমাদের শিক্ষার্থীদের চরম অসৃজনশীল করে ফেলেছি। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

আরও কিছু ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের সাফল্যের আড়ালে। স্কুলের সমাপনী পরীক্ষায় পাস করে সন্তানের নতুন ক্লাসে ওঠা যে কোন বাবা-মা বা অভিভাবকের জন্য আনন্দের। তবে, দেশের কিছু এলাকাতে সন্তান পাস করে নতুন ক্লাসে ওঠার খবর পেলে অভিভাবকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। কারণ এসব স্কুলে নতুন শ্রেণিতে ওঠা মানে শ্রেণিবদলের জন্য হাজার হাজার টাকা ঢালা। একজন শিক্ষার্থী তার নিজের স্কুলেই নতুন ক্লাসে উঠতে ‘ভর্তি ফি’র নামে কেন এত টাকা দিতে বাধ্য হবে তার যৌক্তিক কোনো ব্যাখ্যা নেই। আর এই টাকা দিতে না পারলে মিলছে না বিনামূল্যে সরকারি বইও। ফলে শিক্ষাজীবন হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে অনেক অসচ্ছল পরিবারের শিশুদের। অথচ সরকার বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিচ্ছে। সম্প্রতি জাতীয় দৈনিকগুলোতে এসেছে- বরিশাল মহানগরী ও জেলা-উপজেলার কিছু স্কুলে নতুন বই পেতে তৃতীয় শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া শিশুদের অভিভাবকদের গুনতে হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা। নগরীর বিদ্যালয়গুলোত সর্বনিম্ন দু’হাজার থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নতুন ক্লাসে উঠতে। অভিভাবকরা জানান, সরকারি স্কুলের ভর্তিযুদ্ধে টিকে যাওয়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। কারণ সবাই সে রকম কোচিং করানো বা প্রস্তুতি নিতে পারে না। আর সরকারি স্কুলে সিট সীমিত। তাই বাধ্য হয়ে সন্তানকে এসব বেসরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে হয়। সরকার বিনামূল্যে বিতরণের জন্য এসব স্কুলে বই দিচ্ছে কিন্তু বিদ্যালয়ের নির্ধারিত রশিদে টাকা জমা না দেয়া পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীর হাতে সেগুলো দেয়া হচ্ছে না। ২৭ রকমের বিভিন্ন খাতের নামে এই টাকা নেয়া হচ্ছে।  অভিভাবকগণ এইসব ফি থেকে কিছুটা অব্যাহতি পাওয়ার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। এসব বিদ্যালয়গুলো সুচতুরভাবে তাদের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি করে উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা কিংবা এমন প্রভাবশালী রাজনীতিককে যাদের কাছে টাকা কমানোর সুপারিশ করতে যাওয়া সাধারণ অভিভাবকদের কাছে কল্পনার অতীত। অনেক অভিভাবক ফি কিছুটা কমানোর জন্য প্রধান শিক্ষকের সাথে দেখা করতে গেলে তারা সাক্ষাত দেন না। কোন কোন বিদ্যালয়ে বারোশ থেকে প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী। নতুন ক্লাসে ওঠার সময় সকল শিক্ষার্থীর কাছ থকে গলাকাটা ফি আদায় করা হলে তা লক্ষ লক্ষ এমনকি অর্ধকোটি টাকার উপর চলে যায়। এই টাকা খরচের হিসাব সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক ছাড়া আর কেউ জানেন না। ব্যাংক থেকে তাদের দুজনের যৌথ স্বাক্ষরে টাকা তোলা হয়। অভিভাবকদের অভিযোগ, প্রভাবশালী কাউকে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি করা হয় মূলত প্রতিবাদ এড়িয়ে সহজে গলাকাটা ফি আদায়ের জন্য। কোনো শিক্ষক এর প্রতিবাদ করলে তার চাকরি হুমকির মুখে পড়ে। এমন যে শুধু বরিশালে ঘটছে তা নয়। এই ধরনের ঘটনা দেশের সর্বত্রই বিরাজ করছে। নতুন সরকারের আমলে জাতি কি এই অনিয়ম থেকে রক্ষা পাবে?

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঠিক ম্যাপিং করা প্রয়োজন। অপরিকল্পিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে দেশের যত্রতত্র। এতে একদিকে প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবে কিছু এলাকায় শিশু ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় উপযোগী শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না। অন্যদিকে পাশাপাশি বিদ্যালয় স্থাপন করে রেষারেষি সৃষ্টি হচ্ছে। পাওয়া যাচ্ছে না শিক্ষার্থী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও একই কথা বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের এতগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন আছে কি? এ কথাগুলো ভেবে দেখতে হবে। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি-২০১০-এর সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ এক বক্তৃতায় বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের রেকর্ড খারাপ নয়। এর পরও তারা যে শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের কথা বলছে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষায় সংখ্যাগত উন্নয়ন হয়েছে। এবার মান বাড়াতে হবে। দুই মন্ত্রণালয়ের আরো সমন্বয় দরকার। শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন ও স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করা দরকার।’ তিনি চমৎকার কথা বলেছেন। আমি তার সঙ্গে পুরো একমত পোষন করছি যে, শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন ও স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করা এখন সময়ের দাবি।

লেখক: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ জানুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়