ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

শিপচর যেভাবে হয়েছে শিবচর

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৩, ৭ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শিপচর যেভাবে হয়েছে শিবচর

ফেরদৌস জামান : ঝাউ বনের সামনে বিস্তীর্ণ বালুকাবেলায় ঢালাই করা পায়ে হাঁটা পথ বেশ খানিকটা এগিয়ে নেয়া হয়েছে হেলিপ্যাড পর্যন্ত। জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কায় তা বেহাল হয়ে গেছে। উল্টে রয়েছে শত শত ঝাউগাছ। এই চরে বসতি নেই। মাছ অথবা কাঁকড়া শিকারে মাঝেমধ্যে জেলেদের আগমন ঘটে। হাঁটতে হাঁটতে দেখা হয় এক কাঁকড়া শিকারীর সাথে। বালুকাবেলার নিচে স্যাঁতসেতে পাড়জুড়ে পা ফেলার জায়গাটুকু নেই। লক্ষ লক্ষ কাঁকড়া পোনা বিরবির করছে। কাঁকড়াশিকারী আনোয়ার হেসেন জানান, ওদের প্রজনন মৌসুম চলছে। আকারে এতটাই ক্ষুদ্র যে, চোখ কাছে না নিলে অনুমান করা যায় না সেটা কাঁকড়া না অন্য কিছু।

চরের জঙ্গলে রয়েছে উন্মুক্ত মহিষ, হরিণ ও বানর। মহিষের আক্রমণে এখানে মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এমন দুঃসংবদে ভয় পেয়ে আশপাশে তাকাতেই বলল, চিন্তা করবেন না ওরা গভীর বনে বিচরণ করে। তাছাড়া, স্বাভাবিক বিচরণে কেউ বেঘাত না ঘটালে কিছু বলে না। মাঝেমধ্যে নাকি দূর থেকে লাশও এখানে ভেসে আসে। আমাদের নিকট এসব গল্প করতে আনোয়ার হোসেনের ভালো লাগছে বলে মনে হলো। জানতে চাইলে আরও অনেক কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হলো সে। হয়তো এমন করে এসব কথা সচরাচর কেউ শুনতে চায় না। ডান হাত সামনে তুলে ধরে তর্জনী সোজা করে বাড়িয়ে বললেন, ঐদিকে একটা চর আছে- শিবচর। উপকূলীয় এলাকায় সনাতনী নামের চর নিয়ে কৌতূহরী হলাম। তিনি জানালেন, অনেক দিন আগের কথা, চরের কাছে এক শিপ (জাহাজ) ডুবে গিয়েছিল। তারপর থেকেই চরের এমন নাম। আঞ্চলিক উচ্চারণে বর্তমানে তা শিপ থেকে শিব হয়ে গেছে।

ভাটায় পানি নেমে গেছে অনেক দূর। আনোয়ার ভাই কাদা মাড়িয়ে সেখানে যাবেন। কাঁকড়া শিকারের টোপ হিসেবে ছোট মাছের প্রয়োজন। সেই মাছ ধরতে এখানে তার জাল পাতা আছে। এরই মধ্যে এক ফাঁকে কাঁকড়া শিকারের অভিজ্ঞতাও জানালেন। কাঁকড়া খেতে আমাদের সমস্যা নেই- একথা জানার পর বললেন, পিকনিক পার্টির সামিয়ানা পার হয়ে খালের ঘাটে নৌকা বাঁধা আছে। নৌকায় যিনি আছেন তাকে আমার কথা বললেই ব্যবস্থা করে দেবে। আর আমি অল্পক্ষণের মধ্যেই আসছি। সাথে থাকা কিশোর বলে উঠল-চিনতে পারবেন তো? ঐ যে বিমানবন্দর দেখা যায়, ওটার পাশ দিয়ে চলে যান। এতক্ষণ চিনতে পারার মতোই ছিল কিন্তু মাঝখানে ‘বিমানবন্দর’ চলে আসায় তালগোল পেকে গেল। জট খুলতে গিয়ে জানা গেল হেলিপ্যাডটাই তাদের নিকট বিমানবন্দর।

 



এতক্ষণ কোথায় কোন জেলায় আছি তা নিয়ে আমাদের মাঝে কোনো বিকার ছিল না। সামনে বন বিভাগের সাইনবোর্ডে লেখা অভয়ারণ্য- পটুয়াখালী জেলা। আমাদের দেশের অভয়ারণ্য বা সংরক্ষিত বনাঞ্চলের এই হলো অবস্থা! বাঁশের খুঁটির মাথায় ছোট্ট একটা সাইনবোর্ড। জানি না কবে এটাকে অভয়ারণ্য ঘোষাণা করা হয়েছে? তবে বোর্ডের দশা দেখে বোঝা যায় সেই ঘোষণাকালে এটি খাড়া করা হয়েছে, এরপর সংস্কার হয়নি। অর্ধেকটা পড়া যায় তো বাকি অর্ধেকটা রং চটে গিয়ে টিন বেরিয়ে আছে। এক কোণা থেকে টিন খসে পরেছে, নাকি ওরকম কানা টিন দিয়েই সাইনবোর্ড বানানো হয়েছে কে জানে? এদেশে অভয়ারণ্য আর সংরক্ষিত বনাঞ্চল কথাটার ব্যবহার খুবই যত্রতত্র, যেখানেই মন চেয়েছে সেখানেই একটা করে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ, পশুপাখি শিকার করা হয় নির্বিচারে, বৃক্ষ নিধন হয় দিনেদুপুরে এবং দাতাদের ব্যবস্থাপত্র আর ত্রাতাতুল্য বেসরকারি সংস্থাগুলোর উদ্যোগে রোপণ করা হয় এখানকার পরিবেশ প্রকৃতির জন্য অনুপোযোগী বৃক্ষ। সোনার দেশের সোনার ছেলেরা অভয়ারণ্যের ভেতর মূর্খের মতো উচ্চ আওয়াজে মাইক বাজিয়ে পরিবেশের বরোটা বাজায়।

অভয়ারণ্যের মর্যাদা আমরা কতটা বুঝি তার বাস্তব প্রমাণ দিতেই সম্ভবত একটু পর বজরা নিয়ে আরও এক দল প্রবেশ করল। দুই পাশ থেকে দুই দলের প্রমোদ সংগীত; দুনিয়া কাঁপানো চিৎকারে মনে হলো বনে নয়, কোনো যাত্রার মঞ্চের সামনে বসে আছি। আনোয়ার ভাইয়ের নৌকা খুঁজে পেলাম। বিস্তারিত বলতেই তার সহযোগী সম্মানের সঙ্গে ছাউনির নিচে বসতে দিলেন। নৌকার পাটাতনের একটা কাঠ সরিয়ে সংরক্ষণাগার থেকে বের করলেন বেশ কয়েকটা কাঁকড়া। তার আগে ছোট্ট লাঠির আঘাতে সবগুলোকে আহত করা হলো। এরই মধ্যে পিকনিক পার্টির ছাউনিতে এক পেট খেয়ে মুখ মুছতে মুছতে বশার মাঝি এসে উপস্থিত। কী করেন ভাইজানেরা? ও কাঁকড়া পাক করবেন?

জি।

সরেন দেখি, এভাবে কেউ কাঁকড়া কাটে? কাটার একটা পদ্ধতি আছে।

ও তাহলে আপনি পারবেন?

পারবো মানে, এই বশার পারে না এমন কাজ দুনিয়াতে নেই। আমাদের আর কিছুই করতে হলো না। সে নিজেই কেটেকুটে রান্না করে ফেললো। এরমধ্যে আনোয়ার ভাই এসে পড়লেন। কথায় কথায় পরবর্তীতে কখনও তার সাথে দুই চার দিনের জন্য কাঁকড়া শিকারের অভিজ্ঞতা নেয়ার কথাটাও চূড়ান্ত হয়ে গেল। একই সাথে আমাদের ভ্রমণে যুক্ত হলো নতুন পরিকল্পনা- আর বাজারে ফেরা নয়, এখান থেকেই চলে যাব বাইলাবুনিয়ার চরে। পাশেই এই নামের বড় চর আছে। যেতে পারবে কি না এমন শঙ্কার দৃষ্টিতে বশারের দিকে তাকানো মাত্রই নিজ থেকে বুঝে নিয়ে জানালেন, বাইলা চর কেন? সমুদ্রে যত চর আছে সব তার চেনা। সুতরাং নো চিন্তা। কাঁকড়া খেয়ে রওনা হলাম নতুন লক্ষের দিকে।

 



খানিকটা পথ যাবার পর পেছনে ফিরে অভয়ারণ্যকে আরেকবার দেখতে ইচ্ছে হলো। দেখার পর মনে হলো শেষ বেলায় কেন আবার ফিরে দেখতে চাইলাম! ঝাউ গাছের গোড়ায় পরে থাকা শুকনো ডালপাতায় আগুন ধরিয়ে আনন্দনৃত্য করছে নবাগতরা। দাউদাউ করে উপরে উঠে যাচ্ছে আগুনের শিখা। আনন্দের এমন উন্মাদনা দেখে কেবলই মনে হলো, আমরা কতটা পেছনে পরে আছি, আনন্দ উৎসব বলতে এখনও এসবই বুঝি! এদিক-সেদিক ভুল ঘোরাঘুরির পর অরণ্য ঢাকা খালের প্রান্তে গিয়ে মিললো বাইলাবুনিয়া বাজার। একই পথের মাছ ধরা ট্রলারটার সাক্ষাত না পেলে হয়তো আজকের মতো অথৈ জলেই থেকে যেতে হতো। বশার এখনও নানান কায়দায় নতুন নতুন গল্প পরিবেশন করে চলেছে, যাতে আমরা বুঝতে না পারি সে আসলে বাইলাবুনিয়ায় জীবনে প্রথম এলো।

বাজারে একটা দোকানও খোলা নেই। দশ মিনিট পর একজন পা টিপেটিপে এসে দোকান খুললেন। চরাঞ্চলের বাজার মনে হলো, বিকেল না হলে খোলে না। পুরনো লুঙ্গির এক টুকরো ময়লা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা পুরি দেখিয়ে এক দোকানি বলল,  দেব একটা করে? টিনের চালে শুকানো রুটির মতো মড়মড়ে পুরি। কালো রঙের বাসি! অথচ ক্ষুধার তাড়নায় সেই পুরিই অনেক স্বাদের মনে হলো। চা খেতে খেতে জেনে নেয়া হলো ইউনিয়ন পরিষদ এবং চেয়ারম্যানের ঠিকানা। বশার মাঝিকে বিদায় দিয়ে আমরাও উঠে পরলাম। যেতে হবে পুরান বাজার। কাকের কানে খবর পেয়ে দুই দুইটা মোটর সাইকেল এসে হাজির। ভাড়া অনেক। সুতরাং, পর্তায় হলো না। বেলা যতখানি আছে তাতে হেঁটেই এটুকু দূরত্ব পারি দেয়া সম্ভব। তাছাড়া, চরের নির্মল পরিবেশে হেঁটে যাওয়াটাই সর্বোত্তম একটা কাজ হবে। চেয়ারম্যানের বাড়িতে কাউকে না পেয়ে পরিষদ ভবনের দিয়ে এগিয়ে গেলাম। পাথারের মাঝে একলা দাঁড়ানো ইউনিয়ন পবিষদ ভবন, বাসা বেঁধেছে পুলিশ, স্থাপন করা হয়েছে ফাঁড়ি। স্যান্ডো গেঞ্জি ও লুঙ্গি পড়া একজন লোক বারান্দায় রেলিং ধরে আঙুল ঘষে দাঁত মাজছে। এ্যাই কী চাই? উপরে উঠে আসেন!

বোঝা গেল উনি একজন পুলিশ। সুতরাং, তার কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু প্রত্যাশা করা যায় না। হুকুম তামিল করতে উপরে উঠে যেতে হলো। বোধহয় ঘুম থেকে উঠলেন, দাঁতে ডলাডলি তখনও চলমান। আমরা কারা, কী উদ্দেশ্য, সেই একই প্রশ্ন। এই প্রশ্ন দুটো শুনতে শুনতে কান পঁচে গেছে! সবকিছু জানার পর গালের ভেতর থেকে আঙুল বের করে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, তিনি এখানকার এসআই।

 



সেটা জেনে আপাতত আমার কোনো লাভ নেই। কারণ আমার সমস্ত মনোযোগ মুখ থেকে সদ্য বের করা তার তর্জনীর দিকে। হাত মেলানোর সময় ওটা সামান্য উঁচু করে রাখলেও সেখান থেকে গড়িয়ে আসা ঘোলাটে রসের স্পর্শ থেকে আমার হাত একেবারে রক্ষা পেল না। আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে আরও খানিকক্ষণ দাঁতে ডলা মারার পর কুলি করলেন এবং আমাদের তার কক্ষে নিয়ে বসালেন। নাম, ঠিকানা ইত্যাদি নোট খাতায় লিখে ফোন দিলেন এক মোটর সাইকেল চালককে। তারপর চার নম্বর স্লুইজগেট বাজারের রেস্টহাউজ মালিক সাথী ভাইকে। বললেন, এই ভবনে থাকার কোনো সুযোগ নেই, সাথী ভাইয়ের ওখানে যান ভালো ব্যবস্থা আছে। পুলিশের ফোন বলে কথা, পাঁচ মিনিটের মধ্যে মোটর সাইকেল হাজির। এ্যাই উনাদের আশপাশে যা যা দেখার আছে ঘুরে দেখাও।

আমাদের এই এক সমস্যা, বিস্তারিত না জেনে কেবল নামধাম শুনেই উপকার করতে ব্যাকুল। আমরা কী মোটর সাইকেলে ঘোরাঘুরি করার মানুষ? স্লুইজগেট বাজারে যেতেই প্রায় সন্ধ্যা নেমে এলো। দুই একটা থাকার জায়গা আছে, ব্যাপারীদের থাকার ব্যবস্থা। প্লাস্টার করা দেয়ালে কয়লা দিয়ে লেখা যোগাযোগের ঠিকানা। সেখান থেকে ফোন নম্বর নিয়ে ফোন দিলে বলে- একটু পরে আসেন। কথা শুনে মনে হয় যেন কোনো ফাইলে সই করাতে গেছি। সাথী ভাইয়ের রেস্টহাউজ দেখে অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছা হলো না। একশ টাকায় একজনের থাকার ব্যবস্থা। হাউজের পেছনে কিছু ফুল ও পাতাবাহারের গাছ রয়েছে। সামনে সম্পূর্ণটা উন্মুক্ত। দেখা যায় দূর দিগন্ত আর নীল আকাশ।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ অক্টোবর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়