ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শুভ্র দ্য ফাইটার

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৫, ৩ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শুভ্র দ্য ফাইটার

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : ‘মায়ের আদর পাইনি, বাবার কাছেই মানুষ হয়েছি। বাবা চাইতেন আমি পরিপূর্ণ মানুষ হই। যাতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। যেন শুধু মেয়ে হয়ে পড়ে না থাকি’- কথাগুলো বলছিলেন তায়কোয়নদো ফাইটার শুভ্র। পুরো নাম শুভ্র মাহামুদ জ্যোতি। শুধু তায়কোয়নদো নয়, জীবন যুদ্ধেও ফাইটার হয়ে বাবার স্বপ্নের পথেই হাঁটছেন তিনি।

 

ফরিদপুরের ভাংগা থানার বাইশাখালী গ্রামের মেয়ে শুভ্রর জীবনের শুরুটা ছিল গ্রামের অন্য দশটি মেয়ের মতোই। মুন্সী বাড়ির মেয়ে, স্বল্প পড়াশোনা, বিয়ে-এটাই ছিল পরিবারের নিয়ম। মেয়ে বাড়ির বাইরে যাবে, রাজনীতি সচেতন হয়ে বড় হবে, পড়াশোনা করে নিজের জীবন নিজে গড়বে এগুলো ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। শুধুমাত্র বাবার হাতে হাত রেখে সব কিছু ঠিকঠাক মতো চলছিল। কিন্তু দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন হঠাৎ বাবার মৃত্যুতে শুভ্র'র জীবন থমকে দাঁড়ায়।

 

চাচারা চাইলেন বিয়ে দিতে। মেয়ে মানুষ বেশি পড়ে কী লাভ? শুভ্র পড়ালেখা চালিয়ে যেতে চাইলেন। শুরু হলো পারিবারিক টানাপোড়েন। বাবা-মরা মেয়ে তিনি। ফলে শুভ্র'র অভিভাবক তখন চাচা। এসএসসি পাশ করার পর শুভ্র আরো পড়াশোনা করুক তিনি তা চাচ্ছিলেন না। তিনি ভাতিজিকে বিয়ে দিতে চাইলেন। শভ্র বিষয়টি মেনে না নিলে শুরু হলো অত্যাচার। এইচএসসি পরীক্ষার আগে চাচা সব বই পুড়িয়ে দিলেন। শুভ্র হাল ছাড়লেন না। অদম্য সাহস নিয়ে পরীক্ষা দিলেন শুভ্র। পাশও করলেন।

 

এরপর শুরু হলো শুভ্রর জীবনে নতুন চ্যালেঞ্জ। শুভ্র চাইলেন ঢাকা শহরে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করবেন। এ নিয়ে শুরু হলো চাচার সাথে নতুন বিরোধ। চাচা তাকে কিছুতেই ঢাকায় পড়াশোনা করতে দেবেন না। চাচার স্পষ্ট কথা- বাড়ি থেকে বের হলে নিজের অর্থায়নে মানুষ হয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। নয়তো জীবনে কোনদিন এ বাড়ি ফিরতে পারবে না।

মনের জোর আর সাহসিকতার সাথে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বাড়ি ছাড়লেন শুভ্র। সম্বল দাদিমা, ফুপিদের থেকে পাওয়া সামান্য কিছু টাকা। শুভ্রর দুচোখে তখন ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন। ২০১১-১২ সেশনে অনার্স কোর্সে ভর্তি হলেন মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজে। পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে একা একটা মেয়ের পথ চলা খুব সহজ নয়। রাজধানীর ব্যয়বহুল জীবনযাত্রায় প্রথম দিকেই অর্থ সংকটে পড়তে হয় তাকে। জীবন যুদ্ধে হারতে নারাজ তিনি। চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেন। শুরু হয় গার্মেন্টস দিয়ে। এরপর শো-রুমের সেলসম্যান, কখনো ইভেন্টের কাজ, কখনো এডফার্মে জব, টিউশনি করে নিজের আর্থিক সংকট দূর করেছেন তিনি। নারী হিসেবে প্রতিটি সেক্টরে অনেক বাঁধা বিপত্তি ও হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে। তবুও পিছপা হননি শুভ্র। স্বাধীনচেতা নারী হওয়ায় ২০১৩ সালে দুর্বৃত্তের হামলার শিকার হন। তারা তাকে চাপাতি দিয়ে আঘাত করে। সে যাত্রা বেঁচে যান তিনি।

 

জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার লড়াইয়ে নিরাপত্তা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয় শুভ্রর জীবনে। আত্মরক্ষার কথা মাথায় রেখে যোগাযোগ করেন মিরপুর তায়কোয়নদো এসোসিয়েশনে। এখানে তায়কোয়নদো শেখেন তিনি। এটি ঐতিহ্যবাহী কোরিয়ান মার্শাল আর্ট। খালি হাতে শরীরকে চর্চাকারীর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করার একক কৌশল। এখানে শুভ্র জীবনের প্রথম সাফল্যের দেখা পান। শুভ্র অনুর্ধ ৬০ কেজিতে ওয়ালটন তায়কোয়নদো প্রতিযোগিতায় (২০১৫ সালে) জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করেন। পরের বছর একই প্রতিযোগিতায় হন রানার্স আপ।

 

শুভ্রর জীবনে লড়াই এখনও চলছে সমানতালে। পড়ালেখার পাশাপাশি এখন পার্টটাইম কাজ করেন একটি টেলিকম কোম্পানিতে। অবসরে সময় দেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শিশুস্বর্গে। শুভ্র বলেন, আমি নিজেকে মেয়ে ভাবি না, মানুষ ভাবি। আমার এ লড়াই পরুষতান্ত্রিক সমাজে নিজেকে মানুষ হিসেবে টিকিয়ে রাখার লড়াই।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ অক্টোবর ২০১৬/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়