ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় শেলাবুনিয়ায় শেষ আশ্রয়ে ফাদার রিগন

আলী আকবর টুটুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৮, ২১ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় শেলাবুনিয়ায় শেষ আশ্রয়ে ফাদার রিগন

বাগেরহাট সংবাদদাতা : বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিক, মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু ফাদার মরিনো রিগন সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বাগেরহাটের মংলায় চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন।

রিগনকে সরকারের প্রতিনিধি, বিদেশি কূটনীতিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। রোববার দুপুর আড়াইটায় প্রার্থনা শেষে রিগনকে মংলা উপজেলার শেলাবুনিয়া গ্রামের চার্চের পাশে সমাধিস্থ করা হয়েছে।

এরআগে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সরকারের একটি বিশেষ হেলিকপ্টারে করে রিগনের কফিনবন্দি মরদেহ মংলা উপজেলা পরিষদ চত্ত্বরে আনা হয়। সেখানে সরকারের পক্ষে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। পরে রিগনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

এ সময় খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা, বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস, পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায়, মংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলাম, খুলনা ধর্ম প্রদেশের বিশপ রমেন বিশ্বাস, ফ্রান্সিস সুদান হালদার, শেলাবুনিয়া ধর্মপল্লির পালক পুরোহিত শেরাফিন সরকার, ফাদার রিগনের ভাগ্নে মরিনো ক্যাবিস্ত্রো উপস্থিত ছিলেন।

এ দেশের মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করা এই ধর্মযাজককে তার ইচ্ছা অনুসারে মংলা উপজেলার শেলাবুনিয়া গ্রামে চার্চের পাশে সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা নেয় সরকার। তিনি ইতালিতে মারা যান এবং এক বছর তার মরদেহ ইতালিতে ছিল। পরে সরকার তার মরদেহ দেশে আনার ব্যবস্থা করে।

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ফাদার মরিনো রিগনের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে সম্মান দেখিয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়েছে। তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামরুজ্জামান টুকু বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভিনদেশি একজন মানুষ নিজের মৃত্যুর কথা চিন্তা না করে ক্যাম্প খুলে যুদ্ধাহতদের সেবা করে গেছেন। তার ঋণ শোধ হওয়ার নয়। সর্বস্তরের মানুষ তার অবদানের কথা সারা জীবন স্মরণ রাখবে।

খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, ফাদার মরিনো রিগন ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। তিনি ধর্মীয় বিষয়ে এ দেশে এসেছিলেন। এরমধ্যে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি জীবনবাজি রেখে স্বাধীনতাকামী মানুষের পাশে এগিয়ে আসেন। তিনি ধর্ম, শিক্ষা, নারী অধিকার, স্বাস্থ্যসেবাসহ নানা কল্যাণমুখী কাজে নিজেকে সমর্পণ করেন।

মরিনো রিগন ১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির ভেনিসের অদূরে ভিন্নাভেরলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। খ্রিস্ট ধর্মযাজক হিসেবে তিনি ১৯৫৩ সালে বাংলাদেশে আসেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে শেষে মংলার শেলাবুনিয়া গ্রামে একটি চার্চ ও একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং ওই গ্রামে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন।

মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ছিল তার অকুণ্ঠ সমর্থন। যুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিতে নিজের চার্চে গোপনে চিকিৎসা ক্যাম্প স্থাপন করেছিলেন তিনি। তার ক্যাম্পে চিকিৎসাসেবা নিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধা সুস্থ হয়ে পুনরায় রণাঙ্গনে ফিরে গেছেন। তাদের মধ্যে বিখ্যাত হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন বীর বিক্রমও ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে ফাদার মরিনো রিগনের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০০৯ সালে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেয়। এরপর ২০১২ সালে দেয় ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’।

বাংলাদেশে বসবাসের পর থেকে তিনি বাংলা ভাষা শিখতে শুরু করেন এবং বাংলা সাহিত্যের প্রতি তার কৌতূহল ও নিবিড় ভালোবাসার জন্ম হয়। তিনি রবীন্দ্রনাথের রচনাবলী, লালনের সংগীত ও দর্শনের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। তার মাধ্যমে ইতালিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলী’সহ প্রায় ৪০টি কাব্য, জসীমউদ্দীনের ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ ও অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ, লালনের গানসহ অসংখ্য সাহিত্যকর্ম।



রাইজিংবিডি/বাগেরহাট/২১ অক্টোবর ২০১৮/আলী আকবর টুটুল/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়