ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সাক্ষী

অনার্য মুর্শিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১১, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাক্ষী

|| অনার্য মুর্শিদ ||

আজ ক'দিন ধরেই তুষারের শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপরই জ্ঞান হারাচ্ছে সে। তাকে সামলাতে বাড়ির মানুষ ব্যস্ত। জ্ঞান হারিয়েই তুষার জবাই করা মুরগির মতো ছটফট করছে। মিনিট পাঁচেক পর একটু সুস্থ হয়। গত দুই সপ্তাহে প্রায় তিরিশবার অজ্ঞান হয়েছে। নিওরোলোজিস্ট, সাইকোলোজিস্ট, সাইকিয়াট্রিস্ট কেউই তার সমস্যা ধরতে পারছে না।

 

তুষারের মানসিক অবস্থা পরিবর্তনের জন্য ডাক্তার তাকে কোথাও গিয়ে ঘুরে আসার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু অধ্যাপনা আর গবেষণার ব্যস্ততায় বাবা জাকির জাফরান সময়ই বের করতে পারছেন না। গত মাসে ‘পাহাড়তলী গণহত্যা’ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে একটি বই লিখে দেওয়ার চুক্তি হয়েছিল তার। বইটা লিখতে হলে তাকে বেশ কয়েকবার পাহাড়তলী যেতে হবে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ছেলেকে নিয়ে পাহাড়তলী যাবেন। যেখানে একাত্তর সালের ১০ নভেম্বর ঘটেছিল নারকীয় গণহত্যা। রাজাকার, বিহারি ও পাকসেনারা মিলে প্রায় চারশ সাধারণ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। এখন সেখানে গড়ে উঠেছে এ্যামিউজিং পার্ক ও একটি কৃত্রিম লেক। ছেলের বিনোদন, নিজের গবেষণা দুটো কাজ একসঙ্গে হয়ে যাচ্ছে বলে জাকির সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

 

পরদিন রাতের ট্রেনে ছেলেকে নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন জাকির সাহেব। ভোর পাঁচটায় বাবা ছেলে দুজন পাহাড়তলী স্টেশনে নামলেন। সে কি কুয়াশা! বৃষ্টির মতো ঝরছে। জানালা বন্ধ থাকায় ট্রেনের ভেতর থেকে এতক্ষণ বোঝা যায়নি বাইরে কি পরিমাণ কুয়াশা।

 

স্টেশনে নেমে তুষার বলল, বাবা আমার মাথা ঘুরছে। বমি বমি ভাব হচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনই জ্ঞান হারিয়ে ফেলব।

 

বলিস কি! তাহলে তো খুব বিপদ হয়ে যাবে। এত ভোরে কোথাও ডাক্তার পাওয়া যাবে না।

আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছ বাবা?

ডাক্তার বলেছে, সুস্থ হওয়ার জন্য তোমার বায়ু পরিবর্তন প্রয়োজন। তাই সঙ্গে নি্য়ে এলাম। তোমার কি কোন পছন্দের জায়গা আছে?

না, পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার নয়।

তাহলে?

আমি দেখতে পাচ্ছি, আমার চোখের সামনে মানুষ ধরে এনে জবাই করা হচ্ছে।

কি বলছিস তুই! এখানকার ইতিহাস তুই কীভাবে জানিস? পাঠ্যপুস্তকে তো এই ইতিহাস নেই।

 

কেন জানব না? এটি একটি ঐতিহাসিক স্টেশন। বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, সূর্য সেন অনেকেরই এ স্টেশনে স্মৃতি আছে। আর একাত্তরের স্মৃতিতো আমার চোখের সামনে ভাসছে।

মানে!

একাত্তরে এই স্টেশন থেকেই তো শত শত সাধারণ যাত্রীদের ফয়েস লেকে নিয়ে জবাই করেছে রাজাকার আর পাকসেনারা।

এ ইতিহাস তুই জানলি কীভাবে?

বাবা আমি ইদানীং এরকম অনেক কিছু এমনি এমনি জেনে যাচ্ছি। কোন বই না পড়েই।

বলিস কি!

তুমি আশ্চর্য হচ্ছো? আমিও হচ্ছি। আমি বুঝতে পারছি না কেন এমন হচ্ছে? আমার এখন মনে পড়ছে, কেন আমি বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করি? কেন আমি অজ্ঞান হয়ে যাই?

কেন! কেন অজ্ঞান হয়ে যাস?

এখন যেমন দেখছি আমার চোখের সামনে মানুষ ধরে এনে জবাই করা হচ্ছে। এরকম আমি প্রায়ই দেখি। বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন সময়ের সেই দৃশ্যগুলো যখন দেখি তখন বুক ধুকধুক করে, মাথা ঘোরে, বমি বমি ভাব হয়। তারপরে কি হয় তা তো জানো।

 

জাফরান সাহেব আশ্চর্য হলেন। তার ছেলে আধ্যাত্মিক কিছু বা পুনর্জম্ম লাভ করেনি তো? নানান প্রশ্ন ঘিরে ধরে তাকে। তিনি তুষারকে বললেন,

তুই এ কথাগুলো ঢাকায় থাকতে বলিসনি কেন?

বলিনি, কারণ তখনো আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আর জ্ঞান ফিরলে তো সেগুলো মনে থাকে না। এখন তুমি সামনে আছো, তাই বলতে পারছি।

এখন কথা বলতে বলতে আমার বমি ভাব কেটে গেছে।

ওহ, বাঁচালি! এখন চল, কোথাও গিয়ে ব্রেকফাস্টটা সেরে নেই।

দুজন প্লাটফর্মের অদূরে একটা ঝুপড়ি দোকানে চা বিস্কুট খেয়ে নিল।

তারপর স্টেশন থেকে বেরিয়ে তারা হাঁটতে শুরু করল রেল-কলোনির ভেতর দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় পৌঁছে গেল পাঞ্জাবি লেনের মাথায়। সেখানে পাহাড়ের ওপরে একটা মসজিদ।

 

 

বাবা তুমি মসজিদটা চেনো?

না চিনি না। তবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে যে বইটি বেরুবে তার জন্য আমাকে এই এলাকার অনেক কিছু চিনতে হবে।

তাহলে জেনে রাখো। এটা আকবর শাহ মসজিদ। মুক্তিযুদ্ধ এবং গণহত্যার ইতিহাসের সাক্ষী।

অবাক হয়ে ছেলেকে প্রশ্ন করলেন জাফরান সাহেব। কি রকম সেটা!

একাত্তর সালের ১০ নভেম্বর। যেদিন পাহড়তলীতে গণহত্যা হয়েছিল তখন ছিল রমজান মাস। মুসল্লিরা ফজরের নামাজ পড়ে কেবল মসজিদ থেকে বেরুচ্ছে। এমন সময় একজন বিহারি এসে বলল, কলোনি কা হালাত খারাপ হো যায়গা। চার বিহারিকো বাঙালি কতল কর দিয়া।

লোকটার কথা শুনে মুসল্লিরা নিহত বিহারিদের দেখতে গেল। সেখানে গিয়ে দেখে ঘটনা উল্টো। বিহারিরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আছে। তাদের দেখেই কয়েকজন বিহারি আওয়াজ করল, ইহাছে ভাগো শালা বাঙালি লোগ, খতম কর...

 

তারপর আর কি? যে যেভাবে পারল দৌড়াল, যে পেছনে পড়ল বিহারিদের অস্ত্রের ঝঙ্কারের নিচে চাপা পড়ে গেল তার আর্তনাদ। সেদিন পাকসেনাদের উপস্থিতিতে স্থানীয় রাজাকার ও বিহারি জল্লাদরা মিলে প্রায় চারশ বাঙালি জবাই করে। ট্রেনের যাত্রী, মহল্লার নিরস্ত্র বাঙালি কেউই রেহাই পায়নি।

 

এই মসজিদের ইমামকেও হত্যা করা হয়েছিল। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, রাজাকার আর বিহারিরা মিলে কীভাবে বাঙালিদের টেনে হিঁচড়ে ফয়েস লেকের জল্লাদখানায় নিয়ে যাচ্ছে।

 

স্বাধীনতার দলিলপত্রতে এ বিষয়ে সামান্য কিছু তথ্য পাওয়া যায়। তোর কাছ থেকে আরো নতুন কিছু জানলাম। কিন্তু আমার তো এখন তোকে ভীষণ ভয় হচ্ছে! তুই এগুলো...

ভয়ের কিছু নেই। আগেই তো বলেছি, আমি এমনই। তুমি শুধু এখানকার ইতিহাসের কথা বলছ কেন? আমি এরকম আরো অনেক ইতিহাস জানি, যা হয়ত কেউই জানে না। মজার ব্যাপার কি জানো বাবা, ক্লাসে যখন স্যাররা ইতিহাস পড়ায় আমার হাসি পায়। তাদের কাছে এটা অতীত মনে হয়। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় এটা বর্তমান। আমার চোখের সামনেই ঘটছে ঘটনাগুলো। যখন কোনো হত্যার দৃশ্য দেখতে পাই তখনি আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।

 

জাফরান সাহেব ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলেন। এমন মানুষের জন্মও কি পৃথিবীতে হয়? তার মনে পড়ছে, তুষারের জন্মের বছরখানেক আগে তিনি এক ধরনের কল্পনা করতেন। যদি ইতিহাস না পড়েই এমনি সব জানা যেত-কতই না ভালো হতো! কিন্তু এও কী সম্ভব! এ ধরনের অযাচিত স্বপ্ন তাকে প্রায়ই ডুবিয়ে রাখত। সে সময় তিনি ‘জাতিস্মর’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। জাতিস্মররা তার আগের জন্মের ইতিহাস অনর্গল বলে যেতে পারেন। প্রতি একশ বছর পর নাকি একজন জাতিস্মরের আবির্ভাব হয়। বিজ্ঞানও নাকি সেটা স্বীকার করে।

 

শ্রীমনুসংহিতায় আছে, ‘বেদাভ্যাসেন সততং শৌচেন তপস্যৈব চ/অদ্রোহেন চ ভূতানাং জাতিং স্মরতি পৌর্কীম।’ অর্থাৎ যে মানুষ সর্বদা বৈদিক শাস্ত্র অনুশীলন করেন, সবার সঙ্গে কোমলভাব প্রকাশ করেন, কাউকে হিংসা করেন না, শ্রদ্ধা এবং ভক্তি সহকারে জীবনযাপন করেন, সেই ব্যক্তি পূর্ব জন্মের জ্ঞান লাভ করতে পারেন।

 

তবে কি তিনি একজন জাতিস্মরের পিতা? নিজের অজান্তে কখন যে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল খেয়ালই করেননি জাফর সাহেব।

 

পাঞ্জাবি লেন থেকে হাঁটতে হাঁটতে বাপ-ছেলে দুজন ফয়েস লেকের জল্লাদখানায় বসল। দেখে বোঝার উপায় নেই এক সময় এখানে মানুষ জবাই করা হতো। কারণ জায়গাটা এখন বিনোদন কেন্দ্র। এর নতুন নাম কনকর্ড অ্যামিউজমেন্ট পার্ক।

 

তুষার বাবাকে প্রশ্ন করে, বাবা, মানুষের বিবেক এমন কেন? এরকম একটা জায়গায় মানুষ কীভাবে বিনোদন কেন্দ্র খুলতে পারে!

 

আমিও তো আগে বিষয়টা ভাবিনি! যে বইটা লিখব সেখানে অবশ্যই বিষয়টা তুলে ধরব।

তাই করো।

চল, সামনে এগোই। হাঁটতে পারবি তো! নাকি আবার অজ্ঞান হয়ে যাবি?

তুষার একটু হাসল। আমি বোধ হয় আর অজ্ঞান হবো না। এখানে এসে বুঝতে পারলাম আমার সমস্যাটা কোথায়। এখন শুধু সমাধানটা বাকি।

 

সমস্যা যেহেতু ধরা পড়েছে রোগও সেরে যাবে। বাদবাকি ডাক্তার দেখবে। যদি জানতাম এমন জায়গায় এলেই তুই সুস্থ হয়ে যাবি তবে অনেক আগেই তোকে এখানে নিয়ে আসতাম।

 

হ্যাঁ, আমিও কি আর জানতাম! আর তুমি তো সবসময় খালি কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তুমি যে আমাকে এখানে নিয়ে এলে, আমার তো এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।

 

তুষারের অভিমান দেখে হো হো করে হেসে উঠলেন জাকির সাহেব। ছেলের মাথায় হাত রেখে হাসি মুখে বললেন, চল, সামনে এগোই।

বাবার হাত ধরে তুষারও বলল, চলো।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়