ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সাতই মার্চের ঢাকা

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:০০, ৭ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাতই মার্চের ঢাকা

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পোট্রেট, ছবি- সাইদুল ইসলাম

শাহ মতিন টিপু : ১৯৭১এর সাতই মার্চ, এমন একটি দিনের জন্যই বঙ্গবন্ধু নিজকে, আওয়ামী লীগকে সুদীর্ঘ ২৩টি বছর ধরে প্রস্তুত করেছিলেন এবং বাঙালী জাতিকে উন্নীত করেছিলেন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে।

৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেবেন বাঙালীর মুক্তির দিশারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশজুড়ে সকলেরই মনে তখন একটিই জল্পনা-কল্পনা, ভাষণে তিনি কী বলবেন?

৭ মার্চ ঘোষণা করা হবে বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচী, একাত্তরের ১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণার পর থেকেই অধীর আগ্রহে প্রহর গুনতে থাকে সারা দেশের মানুষ।

রেসকোর্স ময়দানের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মঞ্চ ঘিরে সেদিন সকাল থেকেই বিক্ষুব্ধ বাংলার সংগ্রামী জনতা এক স্রোতে এসে মিশে। সেদিন ছিল রবিবার। সকাল থেকেই সারাদেশের জনস্রোত এসে মিলিত হতে থাকে রেসকোর্স ময়দানে।

সারাদেশ থেকে ছুটে আসা পিপাসার্ত মানুষের ঢলে রেসকোর্স ময়দানের চতুর্দিকে রীতিমত জনবিস্ফোরণ ঘটে। বিকেল ৩টায় সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল থেকেই মানুষের ভিড়ে তিল ধারণের ক্ষমতা হারায় সেদিনের রেসকোর্স।

অন্যদিকে ঢাকার চতুর্দিকে ভারি অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা কড়া প্রহরায়। আকাশে উড়ছে হানাদারদের যুদ্ধ জঙ্গী বিমান। মুক্তিপাগল বাঙালীর সেদিকে ন্যূনতম ভ্রুক্ষেপ নেই। তাদের অপেক্ষা শুধু তাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু কখন আসবেন।

গণমানুষের স্লোগানের মধ্য দিয়ে বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে জনসমুদ্রের মঞ্চে আসেন স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু। ফাগুনের সূর্য তখনও মাথার ওপর। আকাশ কাঁপিয়ে স্লোগান হচ্ছে, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’।

সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতকাটা কালো কোট পরে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর প্রাণপুরুষ দৃপ্তপায়ে উঠে এলেন মঞ্চে। দাঁড়ালেন মাইকের সামনে। আকাশ কাঁপানো স্লোগান আর মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানালেন অপেক্ষমাণ জনসমুদ্রের উদ্দেশে। তারপর শুরু করলেন ভাষণ।

মঞ্চে দাঁড়িয়েই বিশাল জনসমুদ্রে পাকিস্তানের নিষ্পেষণ থেকে বাঙালীর মুক্তির মূলমন্ত্র ঘোষণা করলেন। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে বাঙালী জাতিকে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদাত্ত আহবান জানান। মাত্র ১৯ মিনিটের স্বল্প সময়ে বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের পুরো ক্যানভাসই তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদের জানিয়ে দেন, স্বাধীনতাকামী জনতাকে আর বুলেট-বেয়নেটে দাবিয়ে রাখা যাবে না।

তাই বর্জ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে রেসকোর্সের মাঠে তিনি আবৃত্তি করেন বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

মুজিবের স্বাধীনতার ডাকে রক্ত টগবগিয়ে ওঠে মুক্তিপাগল বাঙালীর। মুহূর্তেই উদ্বেল হয়ে ওঠে জনতার সমুদ্র। মুহুর্মুহু স্লোগানে কেঁপে ওঠে বাংলার আকাশ। নড়ে ওঠে হাতের ঝান্ডায় তাদের গর্বিত লাল-সবুজ পতাকা, পতাকার ভেতরে সোনালী রঙে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্র।

সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু উদাত্তকণ্ঠে বলেন- ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো...’। স্বল্পতম সময়ের এই ভাষণের মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালী জাতিকে তুলে আনেন এক অবিশ্বাস্য উচ্চতায়।

এদিকে বঙ্গবন্ধু এদিন তাঁর ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা যাতে না দেন, তার জন্য মার্কিন সরকার তৎপরতা শুরু করেন। ৭ মার্চ সকালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে সাক্ষাত করেন। স্বল্প সময়ের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পরিষ্কার ভাষায় ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্তের কথা বঙ্গবন্ধুকে জানান। তিনি বলেন- ‘পূর্ববাংলায় স্বঘোষিত স্বাধীনতা হলে যুক্তরাষ্ট্র তা সমর্থন করবে না।’

মার্কিন কূটনীতিকের ভাষা এবং পাক সামরিক জান্তাদের পরিকল্পনার কথার আঁচ পান বঙ্গবন্ধু। তাই বিচ্ছিন্নতাবাদীর দায় চাপিয়ে দেশের স্বাধীনতাকে যাতে মার্কিন ও পাকিস্তানী সামরিক জান্তারা বিলম্বিত করতে না পারে সেজন্য বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ একটি ভাষণ দেন। সরাসরি না দিয়ে বঙ্গবন্ধু পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন বীর বাঙালীকে।

স্বাধীনতার জন্য সারাদেশ থেকে ছুটে আসা পিপাসার্ত মানুষের তৃষ্ণা মিটে বঙ্গবন্ধুর মাত্র ১৯ মিনিটের অমর কবিতায়, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণে। এই একটি ভাষণেই নিরস্ত্র বাঙালীকে সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করেন বঙ্গবন্ধু। বিশ্বের ইতিহাসে কোন রাষ্ট্রনায়ক বা নেতা স্বাধীনতার ঘোষণা পূর্ব এই ধরনের ভাষণ দেয়ার নজির নেই।

১১০৮টি শব্দ সম্বলিত প্রায় ১৯ মিনিটের এই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন বাঙালী জাতি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। সে নির্দেশ বুকে ধারণ করেই আজ আমাদের বাংলাদেশ।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ মার্চ ২০১৮/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়