ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সিকদার আমিনুল হকের অনন্য ডানার গান

মিনার মনসুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৩, ৬ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সিকদার আমিনুল হকের অনন্য ডানার গান

সিকদার আমিনুল হক (৬ ডিসেম্বর, ১৯৪২- ১৭ মে, ২০০৩)

মিনার মনসুর: সব কবির কি ডানা থাকে? নিশ্চিতভাবে উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে সব মহৎ কবিরই বোধ করি থাকে ঝলমলে ডানা। রবীন্দ্রনাথের ছিল। তাঁর গানে, তাঁর কবিতায়, এমনকী তাঁর গল্পেও নানাভাবে আমরা দেখি সেই ডানার অসাধারণ সব তৎপরতা। ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ কিংবা কয়েক সহস্র বছর আগের ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’ কালিদাসের উজ্জয়িনীনগরে রবীন্দ্রনাথের যে-অনায়াস ভ্রমণ সে যে রহস্যময় ডানারই কাজ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’র সঙ্গীও এই ডানা। জীবনানন্দ দাশ তো সার্বক্ষণিক ডানাময় এক কবি। ডানা ছেঁটে দিলে এই কবির পরিণতি হয়তো হতো কোলরিজের কবিতার বিশাল ডানাঅলা সেই আলবাট্রসের মতো। হাজার বছর ধরে- সভ্যতার আদি থেকে অনাগত অন্ত অবধি- তাঁর যে অবিস্মরণীয় পথপরিক্রমা তা যে পদব্রজে নয়, সেটা তার নিবিষ্ট পাঠকমাত্রই জানেন; যদিও তিনি কোথাও কোথাও ‘হাঁটিতেছি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতায়। বাংলাদেশের বরিশালে জন্মগ্রহণকারী এই কবি, যতদূর জানি, ভারতবর্ষের বাইরে কখনো যাননি। কিন্তু কী বিচিত্র, কী বিস্তৃত তাঁর ভ্রমণের মানচিত্র:

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,

সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে

সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,

আমারে দুদণ্ড-শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।

(বনলতা সেন)

দেখা যাচ্ছে, ডানার ক্ষমতা অসীমই শুধু নয়, আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো জাদুকরীও বটে। ডানার ব্যবহারও বহুবিধ। শুধু কি পৃথিবী পরিভ্রমণ, অতীত-ভবিষ্যত সর্বত্রই তার অবাধ বিচরণ। তার অভিধানে অগম্য বা দুর্গম বলে কোনো শব্দ নেই। সেদিক থেকে বিজ্ঞানীদের তৈরি সকল মহাকাশযানের চেয়ে এই ডানার ক্ষমতা নিঃসন্দেহে বহু বহুগুন বেশি। বিশেষত, কবিদেরই যেহেতু ডানা নিয়ে যতো কারবার- তাই যদি বলা হয়, এই ডানার ক্ষমতা যার যতো বেশি, তিনি ততো বড়ো কবি তাহলে কি বাড়িয়ে বলা হবে? আমার বিবেচনায়, না। কথাটি এইভাবেও বলা যেতে পারে যে, ডানা থাকলেই কেউ কবি হবে এমন নয়, বরং ডানার অনন্যতাই হচ্ছে কবিত্ব। কবিতার পণ্ডিতদের মুখে কথাটি আমরা আগেও শুনেছি; তবে অন্যভাবে। কেউ বলেছেন- কল্পনাই কবিত্ব; আবার কারো মতে, উপমাই কবিত্ব। এই দুইয়ের মধ্যে আবার কল্পনার সঙ্গে ডানার সম্পর্কটাই নিবিড়তর।

ডানার অধিকার যে কবিদের একচেটিয়া নয় তাও আগেভাগে বলে রাখা সঙ্গত মনে করি। এটা বলাই বোধ করি সবচেয়ে নিরাপদ যে, সব প্রকৃত শিল্পীরই ডানা থাকে। পিকাসোর ছিল, জয়নুলেরও ছিল। অতো দূরে না গিয়ে যদি বলি আমাদের উপন্যাস সাহিত্যের যাকে ‘জনক’ বলা হয় সেই বঙ্কিমেরও ছিল অপরূপ ডানা। ডানা ছিল বলেই তাঁর পক্ষে আজ থেকে  শতাধিক বছর আগে ‘কপালকুণ্ডলা’(১৮৬৬) কিংবা ‘বিষবৃক্ষ’(১৮৭৩)-এর মতো উপন্যাস রচনা করা সম্ভব হয়েছিল। মীর মশাররফ হোসেন কিংবা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকেও অসঙ্কোচে এই সারিভুক্ত করা যেতে পারে। এই ডানার ব্যাপারটি এমন যে, এর সংস্পর্শে গদ্যপদ্যের ব্যবধান ঘুচে যায়। এ-প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর একটি মন্তব্য এখানে স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘‘টোমাস মান বা ডস্টয়েভস্কির মতো লেখককে ‘কবি’ আখ্যা দিতে নারাজ হবেন শুধু তাঁরাই যারা গদ্য ও পদ্যের তফাৎ বুঝলেও গদ্যমন ও কবিমনের প্রভেদ বোঝেন না।’’ অর্থাৎ আমরা যে-ডানার কথা বলছি তার সঙ্গে কবিমনের একটি সম্পর্ক আছে- যা অনেকটা অবিচ্ছেদ্যই বলা চলে।
 

বাঁ থেকে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, শামসুর রাহমান, সিকদার আমিনুল হক ও মিনার মনসুর


২.

আমাদের ষাটের কবি সিকদার আমিনুল হক (১৯৪২-২০০৩)-এরও ছিল সুপ্রশস্ত ডানা। গত অর্ধশতকে বাংলাদেশ বেশ ক’জন ভালো কবির জন্ম দিয়েছে। বলা বাহুল্য যে, পঞ্চাশ ও ষাটের কবিদের মধ্যেই এমন কবির সংখ্যা বেশি। এদের যদি আমরা বলি ডানাঅলা কবি; সিকদার আমিনুল হককে বলতে হবে সতত ডানার কবি। তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের নামও ‘সতত ডানার মানুষ’। এ-গ্রন্থটিকে তিনি তাঁর সেরা গ্রন্থ বলে বিবেচনা করতেন। আমার নিজেরও তাই ধারণা। এখানে তাঁর কবিসমগ্রকে পাওয়া যায়। পাওয়া যায় তার অভিনব কবিতা-সাম্রাজ্যের অন্তর ও বর্হিজগতের একটি দুর্লভ ছবিও। আমি বলতে প্রলুব্ধ হই যে, এটি বাংলাভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক, যাদের বইটি এখনো পড়া হয়ে ওঠেনি, আমি তাদেরকে বইটি পড়তে অনুরোধ করি। কবিতার এমন রসায়ন বাংলা ভাষায় প্রায় দুর্লভই বলা চলে। 

‘সতত ডানার মানুষ’টি যে তিনি নিজে তাতে সন্দেহ নেই। তাঁর কবিতা এক অর্থে তার যাপিত ও অযাপিত জীবনেরই পুনর্নির্মাণ। কখনো দেখা যাবে তার যাপিত জীবনের খররৌদ্রে বিপন্ন পথিকের মতো দগ্ধ হচ্ছে তার কবিতা:

আমি কি স্বপ্নই দেখি? চুল থেকে নখ, সর্বত্রই

স্বপ্নই আমাকে টানে।- অবান্তর এক আগন্তুক

        এই গ্রহে, উপরন্তু স্বাস্থ্যহীন, শুনি চতুর্দিকে

আলস্য আমার নাকি মর্মমূলে। নিজস্ব একটা

ফ্ল্যাট নেই, রিকন্ডিশন গাড়ি; দৃষ্টি শুধু নীলিমায়

        রোজ চাটে অপ্সরার বায়বীয় রূপ।

(কোথাও থাকে না কবি)

আবার কখনো মনে হতে পারে যে, কবিতার পরাবাস্তব আলোর ঝরনাধারায় স্নাত হচ্ছে তার অযাপিত অথচ প্রবলভাবে প্রার্থিত জীবন। এখানে কারো কারো হয়তো আসাদুল্লাহ খাঁ গালিবের (১৭৯৭-১৮৬৯) কথা মনে পড়ে যেতে পারে। গালিব লিখেছিলেন: ‘মনে প’ড়ে যায় কতো অতৃপ্ত বাসনার ক্ষতচিহ্ন বুকে রয়েছে;/ হে ঈশ্বর, আমার কাছে পাপের হিসাব চেয়ো না॥’

সিকদার লিখেছেন: ‘ডাকহরকরার হাতে চিঠি, সেই চিঠি মধ্য সমুদ্রের। অনেক হাওয়ার, আর জাহাজের দরোজায় দাঁড়ানো আমার স্বপ্নের কাম্য দীর্ঘাঙ্গীর; যার সিল্ক ভেদ করা স্তনের খয়েরী ডগা আমি মৃত্যুর আগে দেখবো না।’ (সতত ডানার মানুষ)। অনুরূপ আর একটি দৃষ্টান্ত: ‘বস্তুত শাদা পোশাকের নিচে এই নীল স্তন। নারীর নয়, কল্পনার; কমলা রঙের গ্রীবা, উচ্ছল কামনা-মদির অন্য এক যুবতীর। যদিও বিসর্পিল তাদের সুঠাম তনু, তবু তারা নক্ষত্রেই থাকে, জ্যোৎস্নার জলাশয়ের সামনে।’ (সতত ডানার মানুষ)। সীমিত পরিসরের এই আলোচনায় আপাতত এটুকু বলা যেতে পারে যে, সব মিলিয়ে, তার জীবন থেকে কবিতাকে এবং কবিতা থেকে জীবন পৃথক করা যথার্থই কঠিন।

৩.

কী জীবনে কী কবিতায় তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ডানানির্ভর এক মানুষ। রাজহাঁসের শুভ্রতা এবং সুদূরতা দুটোই ছিল তার ডানায়। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দূরের কার্নিশ’ (১৯৭৫) থেকে মৃত্যুর পরে প্রকাশিত ‘অগ্রন্থিত কবিতা’ (২০০৪) পর্যন্ত তার কবিতা যতো অগ্রসর হয়েছে ততোই তা হয়ে উঠেছে ডানানির্ভর। যাত্রা মাটি থেকে হলেও শেষের দিকে মাটির ওপর নির্ভরতা ছিল না বললেই চলে। অনেকটা উড়োজাহাজের উড্ডয়নের মতোই ছিল তার কবিতার উড্ডয়ন। প্রথম দিককার কাব্যগ্রন্থে দেখা যাবে তার কবিতা মাটির ওপর দিয়ে দৌড়াচ্ছে স্থূল এক টার্কির মতো; কদাচিৎ শোনা যেতে পারে মাটির সঙ্গে ঘর্ষণের কর্কশ শব্দও; যেন শক্তি সঞ্চয় করছে মহাউড্ডয়নের। তারপরে ‘সতত ডানার মানুষ’-এ এসে দেখা যাবে তার ডানা ভাসিয়ে দিয়েছে মেঘমুক্ত বিশাল আকাশে। চিরাচরিত ভাষা, গতানুগতিক শব্দ; কিন্তু এমন মুন্সিয়ানার সঙ্গে তা ব্যবহার করা হয়েছে যে-কোনো শব্দের গায়ে সামান্য মলিনতাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর বাক্যগুলোর কুয়াশাচ্ছন্ন কোমলতা ঈর্ষণীয়। সবকিছুর শুভ সমন্বয়ে নির্মিত আশ্চর্যরকম নির্ভার কবিতাগুলো উড়ছে ধবল রাজহাঁসের মতো। উড়ছেন কবি নিজেও। অসাধারণ সেই উড্ডয়ন:

‘তারার দিকে আমি উড়ে চলেছি। এবং আমি একা যাচ্ছি। আমার সামনে মদিরা কিংবা স্বর্গীয় উত্থানের কোনো পানপাত্র নেই। এবং কোনো দাসত্বের কাছে যত ছোট প্রতিশ্রুতিই হোক না কেন, আমি রাখিনি। আমি একা, এবং নারীর কামনা-মদির নখ ও দুরন্ত নদীর মতো চুল থেকেও মুক্ত।’

আমার কথা এই মুহূর্তে আশ্চর্য মনে হবে তোমাদের এবং ছন্দময়। যা কি না ভোরের শিশিরের মতো শান্ত আবার সমুদ্রের গর্জনের মতো মুখর। এবং এই অন্তর্লীন বিরোধ ও আনন্দ তোমরা ধরতেও পারবে না। যখন একা থাকি, তাই হয়! নিঃশব্দের ওপর আমি ভেসে চলি। আমার ডানার ছায়া পড়ে উঁচু দালানের চিলেকোঠার ঘুলঘুলিতে। এবং এত উঁচুতে উঠি যে টাকশালের নতুন পয়সার মতো তোমাদের সর্বশেষ পাপ কিংবা দয়ার্দ্র হৃদয় আমি দেখতে পাই। (সতত ডানার মানুষ)
 

বন্ধু, পরিজনবেষ্টিত কবি সিকদার আমিনুল হক (পেছনের সারিতে মাঝখানে)


৪.

সিকদার আমিনুল হকের কবিতাকে মনে হতে পারে এক অভিনব ভ্রমণবৃত্তান্ত। অভিনব এ-কারণে যে, প্রচলিত ভ্রমণের সঙ্গে এর একটা ভিন্নতা আছে। আমরা লক্ষ করেছি যে, এই ভ্রমণে নিজের এবং মানুষের ‘সর্বশেষ পাপ’ এবং ‘দয়ার্দ্র হৃদয়’ও তিনি দেখতে পান। তাই বলে উপেক্ষিত নয় নানা দেশ ও মানুষের বিস্ময়কর অভিজ্ঞতাও। পাঠকমাত্রই বিস্মিত হবেন এই ভেবে যে, কীভাবে এটা সম্ভব হতে পারে? যে-কবি বেড়ে উঠেছেন অংশত বৃহত্তর বাংলার আলো-হাওয়ায়; এবং যার ভ্রমণ সীমিত ছিল ভারত, থাইল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো গুটিকয় দেশে; সেই কবি কীভাবে তুলে ধরতে পারেন বিভিন্ন দেশের ও মানুষের এতো বিচিত্র জীবন্ত সব বর্ণনা?

আমি সেই লোক, বন্দরের

নীল জলে দেখতাম বহু সন্ধ্যা। ঘন কালো চুলে

চিরুনি বুলিয়ে, শেষে নামতাম টায়ার বা গ্রীসে;

বসন্তের রাত্রি খুব জব্দ করা; মদ-মাংসই নয়,

কামুক ডাইনি লাগে নাবিকের।...সময়ের পাপ

গর্তে ঢোকে কাঁকড়ার মতো। আমি ভয়ঙ্কর গন্ধ

কিছুতেই আর নেই। ঝুলিতে রয়েছে তাজা স্মৃতি

ওক গাছ আর গুহা। মেক্সিকোর উৎকট মদিরা-

হাঙর মাছের ঝোল।...রেস্তোরাঁয় টিপস্‌ ছুঁড়ে দিয়ে

দামেস্কের পাখি আর বেড়ালের বাজার চষেছি

নিতান্ত শখের বশে।...

(কাফকার জামা)

সন্ধ্যায় ঘুরেছি আমি অর্চার্ড রোডের শান্ত ভিড়ে।

টাই-শার্ট-জিন্স-স্কার্ট; মাঝে মাঝে ক্যাফে থেকে আসে

উত্তপ্ত গল্পের হাওয়া; পাতা ঝরে প্রশস্ত রাস্তায়

খুব তকতকে লাগে সারাদিন এই ছোট দ্বীপ।

(জর্নাল, ১৯৯৫)

স্পেন, এই শব্দে চিরকাল আমি পেয়েছি যৌবন!

হে, প্রিয় মাদ্রিদ, লোর্কা, হিমেনেথ হাঁটতেন রাতে

যে-রাস্তায়, যাযাবর তাঁবু আর গিটারের তার

থেকে আসা প্রতিবাদ; সমস্ত কেন্দ্রিত থাকে, মৃত্যু

আর জীবনের মুখোমুখি!- ষাঁড়ের লড়াই শেষে

রক্তাক্ত স্ট্রেচারে ফেরে মেটাডোর। নেরুদার স্পেনে

স্তবগান হয় শুধু যৌবনের! যে-কোনো কবির

অবরুদ্ধ শব্দ মুক্তি পায়, কাদিৎসের কালো রাত্রে।

(প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা কবিতা)

এই সব হচ্ছে ডানারই তৎপরতা। আর এই ডানা সম্পর্কে তিনি নিজেও ছিলেন সচেতন। কবিতার পর কবিতায় নানাভাবে এসেছে সে-প্রসঙ্গও:

আমার কবিতা লোকে এমনিতেই বোঝে না, শুনেছি

আগুনে ঢুকে যায়। তারপরেও যদি

তার স্তরে স্তরে আমি তৈরী করি চিত্রকল্প, শ্লেজ-গাড়ির

উঠোন আর আরাবল্লি পাহাড়ের শৃঙ্গ;

ভল্ল উঠিয়ে বলি, আজ কোনো তাজা জন্তু নয়, তরুণীর

সুচিন্তিত দাঁত তুলে দেখবো চুম্বনের মাড়ি থেকে, এবং তারপরেও

উৎফুল্ল আগমন দেরী ক’রে দেবো!

(জাহাজডুবি)

৫.

সিকদার আমিনুল হকের এই ভ্রমণ আর একটি কারণেও আলাদা এবং তা আমাদের বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। এটা কোনো সাধারণ ভ্রমণ নয়, তাই তাঁর ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও একেবারেই অন্যরকম; তিনি যাকে বলেছেন ‘মৃত্যুর জামা পরে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা’। এই জামা তার সর্বক্ষণের ভ্রমণসঙ্গী। তাঁর কবিতায় যেমন অসাধারণ এক ডানার অস্তিত্ব আমরা লক্ষ করি, তেমনি তার কবিতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রকটভাবে লক্ষ করা যাবে অশরীরী এক বিশাল অবয়ব। এই অবয়বটি নিশ্চিতভাবে মৃত্যুর। তাঁর কবিতায় মৃত্যুর আধিপত্য একচ্ছত্র। আমাদের সকল ইন্দ্রিয় দিয়ে তো বটেই, ইন্দ্রিয়াতীতভাবেও আমরা অনুভব করি মৃত্যুর বিচিত্র রূপ ও গন্ধ; তার স্পর্শ ও স্পর্শহীনতা; শব্দ ও  শব্দহীনতা।

মৃত্যুর স্বপ্নই দেখি!- মাটি বলে, এসেছে সুদিন।

অবশেষে এলে তুমি, আমি মিত্র, পুরস্কার নাও;

বীরত্ব ডুয়েলে আসা, এসেছিলো কবি পুশকিন-

উপলক্ষ প্রেম; তবে যদি ভিন্নভাবে তুমি চাও,

পাবে! রোগে, উপেক্ষায়, মদে নেমে; দরোজা অনেক।

(মৃত্যুর স্বপ্ন দেখি)

...মৃত্যু এসেছিলো। তার শ্লেজ-

গাড়িটি পশ্চিমে পড়ে আছে; দাঁতে মাংসাশী ত্রাস;

আমি আর মৃত্যু তাই মাখামাখি। চার বোন তারা

চারটি পোশাকে হাটে।...

(মৃত্যুর মতন ঘুম)

প্রতিটি কাজের আগে মৃত্যু একবার চিৎকার করে ওঠে। সম্রাটের অভিষেক, বালিকার নগ্ন স্নান কিংবা শহরতলীর বিবর্ণ দোকানের করোগেটেড টিনের ওপর মাঘের জ্যোৎস্না- যাই হোক না কেন!

(সতত ডানার মানুষ)

নিরানন্দ ও দৈনন্দিন মৃত্যুর জন্যে সংসারে এত উগ্র বাতাস বইবার তবে কি দরকার ছিলো?... যে মানুষ বস্তুত মৃত্যুর মুহূর্তে খুব আশ্চর্য একটি উপমাও তার সন্তান, স্ত্রী কিংবা পরিজনের সামনে উচ্চারণ করে যেতে পারে না- সেকি থাকতে পারতো না আরও নিশ্চুপ, আলস্যময় আর মদ খাওয়ার মতো নগ্ন? (সতত ডানার মানুষ)

বিশেষ করে ‘সতত ডানার মানুষ’-এর অধিকাংশ কবিতাই যেন মৃত্যুর এক অনন্য শিল্পরূপ। তবে বিশেষভাবে মনে রাখা আবশ্যক যে মৃত্যুবিলাস বা মৃত্যুর বন্দনা বলতে যা বোঝায় তার কবিতা অবশ্যই তা নয়। মৃত্যু যে তার প্রেমিকাদের কেউ নয় কিংবা তিনি যে ‘মৃত্যুপসন্দ’ গোত্রের কবি নন তাও অজ্ঞাত নয় তার পাঠকদের:

‘তবু পৃথিবীতে আমরা এমন কিছু রেখে যাবো, যার উদ্ধত ভঙ্গীর কাছে মৃত্যুর প্রতিজ্ঞা আর দস্যুতার চিরকালের অবসান হবে- হয়তো নানান সুকৃতিসহ আমার আত্মজের হাতে আছে সেই তরবারি।’

মৃত্যুর প্রতি ঘৃণাও ব্যক্ত হয়েছে কোথাও কোথাও। লিখেছেনও যে, ‘মৃত্যু ভয়ঙ্কর, তার হাত থেকে আমাদের পরিত্রাণ নেই।’ তাই মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে তার কবিতায় মৃত্যুর এই আগ্রাসী উপস্থিতি কেন? এ কি তার শিল্পীসত্তারই কোনো অবিচ্ছেদ্য অংশ নাকি জীবনেরই কোনো ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার অভিঘাত? তার দুটি গদ্যগ্রন্থের মধ্যে একটির নামই হচ্ছে ‘মৃত্যুচিন্তা: এবার হ’লো না গান’। গ্রন্থের ভূমিকায় এ-প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন:

জীবনকে ভালবাসি বলেই মৃত্যু নিয়ে আমার ভাবনা প্রায় প্রাত্যহিক ও নিয়মিত। এ-ছাড়া কয়েকটি বড়ো অসুখ ও মৃত্যুর ঝাঁকুনি উত্তীর্ণ হয়েই আমি পঞ্চাশ পেরুতে পেরেছি। তাই মৃত্যু আমার অপরিচিত নয়। প্রথম যৌবনে মৃত্যুর প্রথম আঘাতের পরেই, আমার বিশ্বাস জন্মেছিলো যে, (অন্তত সে সময়ে) এই পৃথিবীতে আমার বসবাসের সময় অতি সীমিত। বিষাদ ও বিরক্তির নির্যাতন কিছুদিন সহ্য করার পর নিশ্চিত হলাম যে, প্রতিভাবান ও বিশেষ ভাগ্যবানেরাই অকাল-মৃত্যুর গৌরব লাভ করে। সম্ভবত, এটা অপরিণত বয়সের সান্ত্বনা- কিন্তু লাভ হ’লো এই যে ‘মৃত্যুচিন্তা: এবার হ’লো না গান’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখা হয়ে গেল। বেশ কিছু বছরের ব্যবধানে, নতুন করে মৃত্যু আবারও উপস্থিত হ’লো আরও ভয়ঙ্কর রূপে। হৃদরোগ আমার এখন নিত্যসঙ্গী। শল্য-চিকিৎসার ভবিষ্যত, ভবিষ্যতই বলতে পারে- তবে আমার পুরোনো এবং বহুদিনের সঙ্গী মৃত্যুচিন্তাই আবার গুরুত্ব পেলো নতুন বাস্তবতায়। (মৃত্যুচিন্তা: এবার হ’লো না গান, ঢাকা-১৯৯৫)।

মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ নয়, বরং বেঁচে থাকার একটা প্রবল আকুতি ছিল তার মধ্যে। জানতেন মৃত্যু অনতিক্রম্য; তার হাত অনেক দীর্ঘ। মৃত্যুর সর্বময় কর্তৃত্ব মেনে নিয়েও তার পক্ষপাত ছিল জীবনের প্রতি।

আহ্‌! কী সুন্দর লাল ঘোড়ার দ্যুতি আর কী যে মসৃণ তার পেলব গাত্রবর্ণ! এর নাম জীবন! আমার ঘরের বোতলের লাল সুরার মতো তা অস্থির ও টগবগে। গ্লাস উপচে পড়ার জন্য তা ফেনিল। (সতত ডানার মানুষ)

আর কলকাতার বিড়লা হাসপাতালে জটিল বাইপাস সার্জারির পর নবজীবন পেয়ে তার শল্য চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত দুই চিকিৎসককে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন:

‘তোমার অনেক নাম ত্রাতা। কী যে কান্তিমান

দেবী শেঠি; শুভ দত্ত; কবি ছাড়া আর

কে চায় এ-গ্রহে শুভ! ফেলে দাও দেখি

বিশটি বছর মাত্র! জেগে থাকি। লিখি।’

(মৃত্যুর জামা পরে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা)

জীবন কার আবেদন গ্রহণ করবে আর কারটা করবে না- সে কেবল জীবনই জানে। বেঁচে থাকলে আজ তার ৭৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হতো সাড়ম্বরে। তরুণদের ঈর্ষণীয় ভালোবাসার রঙে ঢাকা পড়ে যেত তার নাতিদীর্ঘ জীবনের যত উপেক্ষা যত অন্ধকার। আফসোস কেবল এটুকুই যে, তিনি তা দেখে যেতে পারলেন না।

আলোকচিত্র: লেখক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়