ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সিটি অব গার্ডেন

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৪, ২৮ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সিটি অব গার্ডেন

ফেরদৌস জামান : সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় নয়শ মিটার উচ্চতায় ব্যাঙ্গালুরুর অবস্থান। ইতিহাস থেকে জানা যায়, শের-ই-মহীশূর টিপু সুলতানের পিতা হায়দার আলী ছিলেন কৃষ্ণরাজা ওয়াদিয়ারের প্রধান সেনাপতি। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝিতে তিনি নিজেকে মহীশূরের অধিপতি ঘোষণা করেন। পিতার পর সিংহাসনে আসীন হন টিপু সুলতান। তাদের সময় থেকেই ব্যাঙ্গালুরু গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

 

ব্যাঙ্গালুরুর সৌন্দর্য তথা সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে পিতা-পুত্র দুজনেরই বিশেষ অবদান রয়েছে। যার স্বাক্ষর হিসেবে অনেক কিছুই আজও পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা হয়েছে বিশেষ যত্ন নিয়ে। ১৯৪৭-এ ভারত বিভক্তির পর রাজ্যটির নাম ছিল মহীশূর আর রাজধানী ব্যাঙ্গালর। মাঝে ১৯৫৬ সালে রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় কর্ণাটক। স্থানীয় ভাষা কানাড়িতে ব্যাঙ্গালরের উচ্চারণ ব্যাঙ্গালুরু। সে অনুযায়ী ২০০৬ সালে নাম পরিবর্তন করে রাজধানীর নাম রাখা হয় ব্যাঙ্গালুরু।

 

গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে ব্যাঙ্গালুরুর রয়েছে একাধিক ঐশ্বর্যমণ্ডিত বৈশিষ্ট্য। যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো গার্ডেন সিটি অব ইন্ডিয়া এবং সিলিকন ভ্যালি অব ইন্ডিয়া। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও প্রসিদ্ধ ভ্রমণ গাইড বা ভ্রমণ সহায়ক তথ্য প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান লোনলি প্লানেট। তাদের ২০১২ সালের জরিপ অনুযায়ী বিশ্বের প্রথম দশটি পর্যটক আকর্ষণীয় সিটির মধ্যে ব্যাঙ্গালুরুর স্থান তৃতীয়। প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক ব্যাঙ্গালুরু ভ্রমণ করেন। তার অন্যতম প্রধান কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখিত দুইটি জায়গা বাদেও রয়েছে আরও কিছু আকর্ষণ। যেমন-পাব ক্যাপিটাল অব ইন্ডিয়া, রক ক্যাপিটাল অব ইন্ডিয়া ইত্যাদি। পাঠককে এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি ইন্ডিয়ার মধ্যে রক কনসার্ট আয়োজনের দিক থেকে ব্যাঙ্গালুরু অনেক এগিয়ে।

 

 

সুক্ষ্মভাবে বিচার করার মতো আরও অনেক বিষয় রয়েছে সেখানে যা একজন রুচিশীল এবং খুঁটিনাটি জানতে আগ্রহী পর্যটকমাত্রই অনুধাবন করতে পারবেন। সেখানে পাবলিক প্লেসে সাধারণত কাউকে ধূমপান করতে দেখা যায় না। ডাস্টবিন ছাড়া যেখানে-সেখানে কোনো কিছু ফেলতে দেখা যায় না। ব্যাংক কাউন্টার, বাস কাউন্টার থেকে শুরু করে মুদির দোকান পর্যন্ত প্রত্যেকটি জায়গায় শৃঙ্খলা মেনে চলা হয়। অন্যকে টপকে পেছন থেকে কেউ ঢুকে পড়ে সেখানে বলবে না, আমাকে আখাউড়ার টিকিট দেন অথবা এক কেজি মাসকলাইয়ের ডাল দেন।

 

 এশিয়ার বৃহৎ ও জনবহুল এই মহানগরের যেখানেই যাওয়া হোক না কেন গরুর খাঁটি দুধের চা পাওয়া যায়। কনডেন্সড মিল্ক বলে কোনো কিছু থাকতে পারে এই ধারণা তাদের আছে বলে মনে হয় না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই যদি বলি তবে ইন্ডিয়ার অনেক শহর ঘুরে যে জিনিস কোথাও দেখিনি তা দেখেছি ব্যাঙ্গালুরুতে। ফুটপাথ ধরে বিছানো আস্ত পাথরের স্লাব। অন্যান্য সিটির মত এই ফুটপাথ সমতল বা মসৃন নয়। সুতরাং চলতে হয় সাবধানে। নয়শ মিটার উঁচু পার্বত্য এলাকায় অবস্থিত হওয়ার কারণে সমতল পথ যেমন অকল্পনীয় তেমনি ফুটপাথও। পর্বতের পাথর কেটে বের করা আস্ত পুরু ও চওড়া স্লাবগুলিই ফুটপাথের পাটাতন। পা রাখলেই শব্দ করে নড়ে ওঠে অথবা অন্য পাশটা খানিক উঁচু হয়ে যায়। নিচ দিয়ে পয়ো-নিষ্কাশনের নালা। সুতরাং, এদিক সেদিক হলেই ঘটে যেতে পারে যে কোনো দুর্ঘটনা। যদিও আমাদের রাজধানীর মতো পথ চলতে গিয়ে নালার ভেতর পরে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা সেখানে নেই। আমাদের প্রাণপ্রিয় ঢাকা সিটিতে যেমন দশ-বিশ হাত পরপর দুইটি করে স্লাব খোলা থাকবে আর তার ওপর দিয়ে লং জাম্প দেওয়ার চর্চা করে করে এগুতে হবে- সেখানে এ দৃশ্য কল্পনা করা যায় না।

 

 

পাথরের পর্যাপ্ততার দিক থেকে এলাকাটি এত বেশি সমৃদ্ধ যে পথ-ঘাট থেকে শুরু করে ভবন নির্মাণে, তার ব্যবহার হয়ে থাকে। প্রথম দিকে এমনও ঘটেছে, পথ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই থমকে দাঁড়িয়েছি। কেউ যেন ডাকছে! একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, পথের ধারের বিভিন্ন শো-রুম থেকে বিক্রেতাদের ডাক। মজার ব্যাপার হলো, দোকান বা শো-রুমগুলো রাস্তার পাশের খাদে। অর্থাৎ পাহাড়ি শহর ব্যাঙ্গালুরুর অনেক সড়কই আছে যার দুই পাশের ভবন নিচ থেকে ওপরে উঠে আসা। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলে দেখা যায় বড় বড় দোকান এবং নানা প্রতিষ্ঠানের অফিস। রাজাজী নগরের যে লজে আমি থাকতাম তারও বোধহয় দেড় কি দুই তলা ছিল মাটির নিচে।

 

শের-ই-মহীশূর টিপু সুলতানের পিতা হায়দার আলী প্রতিষ্ঠিত ১৭৬০ সালের লালবাগ বোটানিক্যাল গার্ডেন ইতিহাসের অনবদ্য সাক্ষী হয়ে রয়েছে। কালের পরিক্রমায় বহু সংস্কারের মধ্য দিয়ে যা আজও কর্ণাটকের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। দক্ষিণ এশিয়া তথা বিশ্বের নানা দেশের গবেষকগণ ছুটে আসেন লালবাগ গর্ডেনে। এ ছাড়াও সিটির বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে অনেক উদ্যান। সুপরিকল্পিত উদ্যানগুলোর প্রধান আকর্ষণ নানা প্রজাতির ফুল ও বৃক্ষ। আর শত শত পাখি তো রয়েছেই। দক্ষিণ এশিয়ার সর্বাধুনিক মহানগরের উদ্যানগুলো সার্বক্ষণিক পাখির কলকাকলীতে মুখোরিত থাকে। আমার মনে আছে ইন্ডিয়া যাওয়ার জন্য প্রথম যেদিন ভিসা সেন্টারে লাইনে দাঁড়িয়েছি পরিচয় হয় জামালপুরের এক ভদ্রলোকের সাথে। ফর্ম পূরণ করে ভোর পাঁচটা থেকে দাঁড়িয়ে আছি। আলাপ পরিচয়ের এক পর্যায়ে ব্যাঙ্গালুরু যাচ্ছি জেনে তিনি নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলেছিলেন, এই উদ্যান আর আবহাওয়ার কথা। পুরাকির্তীর বাইরেও শুধুমাত্র এই দুইটি কারণকে প্রাধান্য দিয়ে ইন্ডিয়ার অন্যান্য অঞ্চল থেকে বহু পর্যটক ব্যাঙ্গালুরু ভ্রমণ করেন। এপ্রিলের গরমে বাংলাদেশ তথা ইন্ডিয়ার বেশির ভাগ প্রদেশের মানুষের জীবন যখন ওষ্ঠাগত, ঠিক সেই সময়েও ব্যাঙ্গালুরুর আবহাওয়ায় বয়ে যায় মিষ্টি হাওয়া। এতটাই মিষ্টি আবহাওয়া যে, চাইলে পাতলা টি-শার্ট অথবা স্যুট, যে কোনো পোশাক পরে চলাফেরা করা যায়।

 

 

এতদিন সেখানে থাকলাম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বলতে গেলে চোখেই পরেনি। রাজনৈতিক অস্থিরতা একেবারেই নেই। লক্ষ করেছি জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে সেখানে স্থানীয় দলগুলোর প্রাধান্যই অধিক। রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্যতম একটি বিষয় যে কাউকেই কৌতূহলী করে তোলার মতো। সিটির বিভিন্ন জয়াগায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে মানুষের মূর্তি শোভা পায়। প্রতিটি মূর্তিই স্থানীয় বা প্রাদেশিক পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা বা সমাজের জন্য অবদান রাখা ব্যক্তিবর্গের। সেখানে অবস্থানকালে এক রাজিব গান্ধীর মূর্তি ছাড়া একটিও চিনতে পারিনি। এমনও শুনেছি, কোথাও কোথাও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মূর্তি স্থাপনের জন্য জায়গা ভাড়া পাওয়া যায়। ব্যাপারটি হাস্যকর মনে হলেও অন্তত আমাদের দেশের মতো দাঁত বের করা, স্নো-পাউডার মাখা বা তোয়াজ করা মার্কা ছবি সংবলিত বিলবোর্ডে পথ-ঘাট ঢেকে ফেলার মতো সস্তা বিষয়ে রূপ নেয়নি।

 

আগেই বলেছি অপরাধমূলক ঘটনা চোখে পড়েছে বলে মনে পড়ে না। বিধি মেনে রাস্তায় গাড়ি চলাচল করছে, অনেক মোড় রয়েছে যেখানে সিগনাল বাতিতেই কাজ চলমান। বিশেষ বিশেষ জায়গায় ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও তাকে লাঠি বা স্টিলের পাইপ হাতে যানবাহণ শাসাতে হয় না। আবার সুযোগ করে গাড়ি চালকের কাছ থেকে শুভেচ্ছা স্বরূপ কিছু গ্রহণও করতে হয় না। মোড়ের ঠিক মাঝখানের নির্দিষ্ট বাক্সে দাঁড়িয়ে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন তারা। আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় যেখানে সেখানে পুলিশ সদস্যদের দেখাও পাইনি। মদের দোকান রয়েছে প্রচুর। নির্দিষ্ট পরিমাণ মদ গ্রহণে কোনো মানা নেই। কোনো একদিন এক জনকেও চোখে পড়ল না, যে মদ পানের পর বিশৃঙ্খলা করছে বা অন্যের অসুবিধা করছে। তবে শহরের বিশেষ বিশেষ জায়গায় কিছু ওষুধের দোকান রয়েছে, যেখানে ফেন্সিডিল পাওয়া যেত। অপ্রিয় হলেও সত্য, সেই ফেন্সিডিলের একমাত্র ক্রেতা বাংলাদেশি।

 

সে সময় ব্যাঙ্গালুরুতে বাংলাদেশের তরুণ-যুবকের সংখ্যাও কম ছিল না! কারণ ঐ সময় দেশের মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের বহু ছাত্র উচ্চশিক্ষার জন্য ব্যাঙ্গালুরুকে উত্তম জায়গা হিসেবে বেছে নিত। এমন কিছু ঘটনার কারণে এক পর্যায়ে বাংলাদেশি ছাত্ররা স্থানীয়দের নিকট হীন দৃষ্টিতে গণ্য হতে শুরু করে। জানি না আজকের বাস্তবতা কী?

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ নভেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়