ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

সিলেট থমথমে

রফিকুল ইসলাম কামাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪২, ২৬ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সিলেট থমথমে

রফিকুল ইসলাম কামাল, সিলেট : হযরত শাহজালাল (রহ.) ও হযরত শাহপরান (রহ.) এর মাজারসমৃদ্ধ পূণ্যভূমি সিলেট। এ নগরী ছিল শান্ত, নিরাপদ। কিন্তু হুট করেই সব বদলে গেছে। শান্তির নগরী সিলেট এখন আতঙ্কগ্রস্ত। পুরো সিলেটে পরিস্থিতি ভয়ানক থমথমে।

সব ‘নষ্টের মূল’ যেন ‘আতিয়া মহল’। সিলেট মহানগরীর দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি পাঠানপাড়ায় পাঁচ তলা ভবন ‘আতিয়া মহল’। সাবেক সরকারি কর্মকর্তা উস্তার আলীর মালিকানাধীন এ ভবনে যখন জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মিললো, এরপর শান্ত সিলেট ক্রমেই আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হতে থাকলো।

ঘটনার শুরু গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে। কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামের সীতাকু-ে ধরা পড়া দুই জঙ্গির কাছ থেকে সিলেটে জঙ্গি আস্তানা থাকার বিষয়টি জানতে পারে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম (সিটিটিসি) ইউনিট। এরপর সিলেটে শুরু হয় গোয়েন্দা তৎপরতা। সিটিটিসির ডিসি মনিরুল ইসলাম এই তথ্য জানিয়েছেন।

গোয়েন্দারা সিলেট মহানগরীর দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি পাঠানপাড়ায় পাঁচ তলা আবাসিক ভবন আতিয়া মহলে জঙ্গিদের আস্তানা থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হন। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে জঙ্গি আস্তানার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর রাত ৩টার দিকে ওই ভবন ঘেরাও করে ফেলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। জঙ্গিদের ফ্ল্যাটের ফটকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তালা। শুরু হয় শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান।

শুক্রবার সকাল ৭টার আতিয়া মহলের বাইরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি টের পেয়ে বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। পাশাপাশি দুটি ভবন- চার তলা ও পাঁচ তলা মিলে আতিয়া মহল। শুক্রবার সকালেই চার তলা ভবনের ১২টি ফ্ল্যাটের সকল বাসিন্দাকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়। তবে পাঁচ তলা ভবনের নীচতলায় জঙ্গিদের অবস্থান হওয়ায়, নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকায় ওই ভবনের বাসিন্দাদের সরিয়ে নিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

শুক্রবার দুপুরে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের জন্য অনেকবার হ্যান্ড মাইকে আহবান জানায় পুলিশ। কিন্তু জঙ্গিদের তরফ থেকে সাড়া মিলেনি। বেলা ১টার পর জঙ্গিদের ফ্ল্যাট থেকে নারী ও পুরুষ কণ্ঠে উচ্চস্বরে বলা হয়, ‘তোমরা (পুলিশ) শয়তানের পথে আছো, আমরা আল্লাহর পথে। দেরি কেন, দ্রুত সোয়াত পাঠাও। আমাদের সময় কম।’

এই পরিস্থিতিতে শুক্রবার বিকেলে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছে পুলিশের বিশেষায়িত টিম সোয়াত। এরপর আতিয়া মহল কাছে থেকে ঘিরে ফেলেন সোয়াত সদস্যরা। সিলেটের পুলিশ ও বাড়ির মালিককে সাথে নিয়ে তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। সেদিন রাত ৮টার দিকে সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো ইউনিটের একটি দল ঘটনাস্থলে আসে। তবে রাতে তারা ফিরে যায়। ওই সময় সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া জানিয়েছিলেন, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে এসেছে প্যারা-কমান্ডো ইউনিট।

শুক্রবার দিবাগত রাতে চূড়ান্ত অভিযান হতে পারে, এমনটা মনে করা হয়েছিল। তবে চরম উৎকণ্ঠায় সে রাত পেরিয়ে যায়। শনিবার সকাল ৮টার দিকে শতাধিক সেনা প্যারা-কমান্ডো আসেন শিববাড়িতে। সোয়া ৯টার দিকে ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আনোয়ারুল মোমেনের নেতৃতে অভিযান শুরু করেন তারা। পরিকল্পনা অনুসারে শুরুতেই আতিয়া মহলের পাঁচ তলা ভবনে আটকা পড়া ২৯টি ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের উদ্ধারে নামেন তারা। কোন ধরনের হতাহতের ঘটনা ছাড়াই ভবনের ৭৮ জন বাসিন্দাকে নিরাপদে সরিয়ে আনেন প্যারা-কমান্ডোরা। তাদের মধ্যে ৩০ জন পুরুষ, ২৭ জন মহিলা ও ২১ জন শিশু।

শনিবার বেলা ২টার দিকে জঙ্গিদের ফ্ল্যাট ঘিরে অভিযানে নামেন প্যারা-কমান্ডোরা। আতিয়া মহলের আশপাশ থেকে সাংবাদিক, উৎসুক জনতাসহ সবাইকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর দফায় দফায় গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। বেলা সোয়া ২টা, ২টা ৩১ মিনিট, বিকাল ৪টা ৫৬, ৫৭ ও ৫৮ মিনিটে শক্তিশালী বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এছাড়া আরো বেশ কয়েকবার গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।

শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে প্রেস ব্রিফিং করেন সেনা সদর দপ্তরের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান। আতিয়া মহলে অভিযানের বিষয়ে গণমাধ্যমকে অবহিত করেন তিনি। তাঁর ব্রিফিং শেষ হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই আতিয়া মহলের অদূরে প্রচ- শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এ বোমা বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই নিহত হন চার জন। পরে হাসপাতালে মারা যান আরো দুজন। নিহতদের মধ্যে পুলিশের দুই কর্মকর্তাও রয়েছেন। এ ঘটনায় র‌্যাব সদর দপ্তরের ইনটেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল আবুল কালাম আজাদ, উপপরিচালক মেজর আজাদসহ অন্তত ৪০ জন আহত হন।

শুক্রবার সকাল থেকে আতিয়া মহলে জঙ্গি আস্তানা ঘিরে সিলেটের মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল, শনিবার বোমা বিস্ফোরণে ছয় জনের প্রাণহানির ঘটনায় সে আতঙ্ক জগদ্দল পাথরের মতো চেপে ধরেছে এখন। সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। কি হয়, কি হচ্ছে- এসব প্রশ্নে আতঙ্কিত মানুষ। নিজের প্রিয় নগরীতে এরকম জঙ্গি কর্মকা- ঘটছে, তা যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না অনেকেই।

পারিবারিক কাজে বিশ্বনাথ উপজেলা থেকে সিলেট নগরীতে এসেছিলেন নিজাম উদ্দিন। নগরীর জিন্দাবাজার পয়েন্টে এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছি। এসব কি হচ্ছে, বুঝে ওঠতে পারছি না। সিলেটে এরকম জঙ্গি কর্মকা- হবে, কখনোই চিন্তা করিনি।’

সিলেট মহানগরীর ইলেকট্রিক সাপ্লাই এলাকার বাসিন্দা মারুফ খান মুন্না। তিনি বলেন, ‘আতঙ্কের মধ্যে আছি। ঘর থেকে বাইরে বেরোতে ভয় কাজ করছে।’

এদিকে, সার্বিক পরিস্থিতিতে সিলেটে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মহানগর পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া। তিনি বলেন, ‘সিলেটে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে এবং তল্লাশিচৌকি বাড়ানো হয়েছে।’

নগরীর বিভিন্ন স্থানে সন্দেহভাজনদের তল্লাশি করতেও দেখা গেছে। মোড়ে মোড়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

রোববার সকাল থেকে আতিয়া মহলে একাধিকবার প্রচ- শব্দে বিস্ফোরণে শব্দ শোনা গেছে। তবে প্যারা-কমান্ডো নাকি জঙ্গিরা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আতিয়া মহলের আশপাশ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে পুলিশ। অভিযানের ৫৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। এখনও জঙ্গিদের ধরা সম্ভব হয়নি। জঙ্গিরা অত্যন্ত শক্তিশালী ও সংগঠিত বলে শনিবার ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান।

আতিয়া মহলের মালিক উস্তার আলী গত শুক্রবার জানিয়েছেন, গত জানুয়ারি মাসে একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক কোম্পানির কর্মকর্তা পরিচয়ে কাওছার ভবনের নীচতলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় এক দম্পতি। এটিই মুলত জঙ্গি আস্তানা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারণা, এ ফ্ল্যাটে নব্য জেএমবির নেতা মুসা থাকতে পারেন।




রাইজিংবিডি/সিলেট/২৬ মার্চ ২০১৭/কামাল/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়