ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

সীমান্ত পেরিয়ে দক্ষিণে

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২৯, ১৫ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সীমান্ত পেরিয়ে দক্ষিণে

ফেরদৌস জামান : পশ্চিমবঙ্গের কিছু বাঙালি পরিবার রয়েছে যারা চাকরি বা অন্যান্য পেশাগত কারণে কর্ণাটক রাজ্যে অবস্থান করে। বুবুনদের পরিবার তেমনই একটি। বাবার চাকরির সুবাদে কলকাতার পাট এক রকম চুকিয়েই দিয়েছে। অনেক বছর স্থায়ী হয়ে বসবাস করছে ব্যাঙ্গালুরুতে। আমার সহযাত্রী রেশাদ ভাই উচ্চ শিক্ষার্থে সেখানে কাটিয়ে দিয়েছেন চার বছর। এই সময়ের মধ্যে বুবুনদের পরিবারের সাথে তার এক অসাধারণ সখ্য গড়ে ওঠে। সেই সম্পর্কের খাতিরে ওদের বাসায় প্রায়ই যাওয়া হতো।

 

মাতৃভূমি থেকে হাজার মাইল দূরে আপন ভাষায় প্রাণ খুলে কথা বলার জন্য আমাদের মন যেমন ব্যাকুল হয়ে থাকতো তাদের ক্ষেত্রেও একই বিষয় কাজ করতো। হোক না আলাদা দেশের মানুষ, একই ভাষাভাষি তো! একদিন সন্ধ্যায় দাওয়াতের অতিথি হয়ে গেলাম বুবুনদের বাসায়। বুবুনের বড় বোন পাম্পি দিদি ও তার স্বামী সুপ্রিয় দাদাও এসেছেন। মাত্র কয়েক মিনিটে জমে ওঠে বাঙালিয়ানা আন্তরিক আলাপ আলোচনা। ব্যাঙ্গালুরুতে দেখার মত বিশেষ কী কী রয়েছে? এই প্রসঙ্গ উঠতেই চলে আসে বিখ্যাত রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের কথা। ব্যাঙ্গালুরু ঘুরে দেখার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ তথা ঐতিহাসিক স্থানগুলির মধ্যে রাধাকৃষ্ণ মন্দির একটি। মাত্র কয়েক মাস আগে বুবুন তার সহপাঠীদের সাথে ঘুরে এসেছে। আর সুপ্রিয়দাকে অফিসের কাজে প্রায়ই ওদিকে যেতে হয়, যার সুবাদে মন্দির দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য আগেই পেয়ে গেলাম। এবার যাওয়ার পালা। আজ কাল করে পেরিয়ে গেল আরও একটি সপ্তাহ।

 

বসন্তের এক বিকেল বেলা অটো নিয়ে চললাম মন্দিরের দিকে। শহর ছেড়ে বেশ দূরে যেতে হয়। পথের মাঝেই সন্ধ্যা নেমে এলো। অন্ধকার কেটে এগিয়ে চলছে অটো। ঢাকা শহরে এক সময় যে টু-স্ট্রোক ইঞ্জিনচালিত বেবিট্যাক্সি চলতো, সেখানকার অটোর কাঠামো বেশ খানিকটা তার মত, তবে মিটারে চলে। দামদর করার কোনো প্রয়োজন নেই। রাজি হলে শুধু ঘটাং ধরণের এক শব্দ করে মিটারটা ঘুরিয়ে দেয়, ব্যাস এতটুকুই। রঙিন আলোর ঝলমলে পথ ছেড়ে এক পর্যায়ে প্রবেশ করি ঘুটঘুটে অন্ধকার পথে। এই সময়টায় মনের মধ্যে উদয় হয় প্রচলিত ভীতিকর নানান গল্প। ছোটবেলায় বয়োজেষ্ঠ্যদের মুখে শুনতাম, মন্দীরে জিন বা ভূত-প্রেত থাকে। মৃত মানুষের খুলিও ঝুলানো থাকে। কিছু কিছু সিনেমাতেও এমন দৃশ্য দেখা যেত। মন্দির মানেই পুরনো দেয়াল, দেয়ালের শরীর বেয়ে উঠে যাওয়া বট-পাকুরের গাছ ইত্যাদি! এমন সব ভাবনার অবসান ঘটে দূরে নিকোশ কালো পাহাড়ের চূড়ায় এক চকচকে সাদা আলোর পিণ্ড দেখে। যতই এগিয়ে যাই আলোর পিণ্ডটি বড় হয়ে উঠছে। এক পর্যায়ে পাশে বসা রেশাদ ভাইকে বলি, এত অন্ধকারে ওটা কী জ্বলছে? নিরুত্তর থেকে তিনি বরং আমার কৌতূহল বাড়িয়ে দিলেন। আলোটি যতই নিকটবর্তী হতে থাকলো বোঝা গেল সাদা ধবধবে একটি ভবন ঘিরে সে এক নান্দনিক মহা আয়োজন!

 

 

মন্দিরের অবস্থান পাহাড় চূড়ায়। পাহাড়ের গোড়ায় গিয়ে অটো চালক সেই আগের মত ঘটাং শব্দে মিটার ঘুরিয়ে দিলেন। এবার নেমে এক পা, দুই পা করে এগিয়ে যাই। মন্দির এলাকায় কেবল একটি রঙের প্রলেপ-সাদা। প্রতিটি দেয়ালেই নানা কায়দায় আলো ফেলা হয়েছে আর সেই আলো ছড়িয়ে পরেছে চারদিকে। মূল তোরণ পেরিয়ে চোখে পড়ে আমাদের মত শত শত দর্শনার্থী। সর্ব প্রথম প্রত্যেককে একটি করে বস্তা আকৃতির ব্যাগ সংগ্রহ করতে হয়। ব্যাগে জুতা-স্যান্ডেল ও অন্যান্য জিনিসপত্র ঢুকিয়ে তারপর তা রাখতে হয় লম্বা সারি করা নির্দিষ্ট হ্যাঙ্গারে। ক্রমিক নম্বর মিলিয়ে দেয়া হয় একটি টোকেন। এরপর আরোহণ শুরু মূল মন্দির গৃহের উদ্দেশ্যে।

 

উন্নত পাথরে গড়া সিঁড়ি। বিশৃঙ্খলা ছাড়াই পাশাপাশি দুই-তিনজন উঠে যাওয়া যায়। দশ মিনিট ওঠার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানির মসৃণ ফোয়ারায় পা ধৌত হয়ে যাচ্ছে। পা পরিস্কারের জন্য দাঁড়ানো বা কচলানোর প্রয়োজন নেই। একটি একটি করে সিঁড়ি কাটছি আর পানি এসে তার কাজ সেরে নিচ্ছে। মন্দির ঘিরে সমস্ত পাহাড়ের গায়ে যে স্থাপনা ও ফুল বাগান তা দেখার জন্য আলাদা করে অন্য পথ ধরার প্রয়োজন নেই। স্বয়ং সিঁড়ি এগিয়ে নেয়া হয়েছে ওসবের মাঝ দিয়ে। কখনও বা সিঁড়ি এগিয়েছে অন্যান্য ভবনের মাঝ দিয়ে। দ্বিতীয় তোরণের ভেতর দিয়ে এবার প্রবেশ করি বেশ বড় একটি খোলা চত্বরে। সাদা পাথরে মোড়ানো চত্বর, একটি ধূলি কণারও অস্তিত্ব নেই। বহু দর্শনার্থী দল বেঁধে যে যার মত বসে আছে। চলছে গল্পগুজব, আলাপ আলোচনা। পুনরায় পথ চলা শুরু। একাধিক ভবনের মাঝখান দিয়ে সমতল চলার পথ। প্রদর্শিত নানান কিছু দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি। যেতে যেতে প্রবেশ করি মূল মন্দিরে। অনেক বড় কক্ষ! শত শত মানুষ অনায়াসে ঘুরে বসে সময় পার করছে। তবে তার আগে লাইন ধরেই অগ্রসর হতে হচ্ছে। কক্ষের অপর প্রান্তে ঝলমলে অলোর নিচে মাঝাড়ি অকৃতির রাধা এবং ঠিক তার পাশে বংশি হাতে কৃষ্ণের দণ্ডায়মান মূর্তি। প্রত্যেকেই ভক্তিতে মস্তক নত করে প্রণাম জানিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে। লাইনে চলার পর্ব আপাতত শেষ। সুবিশাল কক্ষের যেখানে খুশি অবস্থান করা সম্ভব। তবে তার আগে প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট স্থানে দণ্ডায়মান এক পুরোহিতের নিকট থেকে হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করছে চরণামৃত। ভক্তিময় এই কর্মটি থেকে নিজেকেও বঞ্চিত করলাম না।

 

 

মন্দির গৃহের সাথে লাগানো বিনোদনের অধুনিক সব নানান বন্দোবস্ত। এর মধ্যে থিয়েটার হলগুলিতে প্রদর্শিত হয় রাধাকৃষ্ণ ও সনাতন ধর্মীয় নানান ডকুমেন্টারি। দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে বেশ কিছু দোকান রয়েছে। দোকানের সমস্ত পণ্যও ঐ একই বিষয়কে কেন্দ্র করে। ধর্মীয় সিম্বল অঙ্কিত টি-শার্ট এবং বিভিন্ন স্যুভেনির। সব শেষে রয়েছে নানান পদের স্ন্যাক্সের স্টল। ইডলী, দোসা, পাকোড়ে, ফলের জুস ও অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী খাবার এসব দোকানের প্রধান পণ্য। নিকটেই খোলা আকাশের নিচে চমৎকার আলো-আঁধারীর ব্যবস্থা। তার মাঝে স্বল্প দূরত্বে টেবিল-চেয়ার পাতা। চাইলে দর্শনার্থীরা তাতে বসে খাবার গ্রহণ ও সময় কাটাতে পারে। সব শেষে ভিন্ন পথ ধরে একই রকম শৃঙ্খলার সঙ্গে ধীরে ধীরে নেমে আসার পালা। এত বিশাল ব্যবস্থাপনা দেখে দর্শনার্থী মাত্রই মুগ্ধ হয়ে যাওয়ার কথা! আরও বেশি মুগ্ধ করে তোলে সেখানকার সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা ও অত্যান্ত পরিপাটি পরিবেশ। যতদূর মনে পরে, মন্দিরের এই অতি চমৎকার পরিবেশের কারণে পরে আরও দুই কি তিন বার যাওয়া হয়েছিল।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ নভেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়