ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘সুন্দরীদের’ বাঁচিয়ে রাখে সুন্দরবন

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০০, ১৮ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘সুন্দরীদের’ বাঁচিয়ে রাখে সুন্দরবন

রফিকুল ইসলাম মন্টু: তারা স্বামীর সঙ্গে সুন্দরবন যাবেন। সেজন্য ভোর থেকেই ব্যস্ততা। প্রস্তুতির চিন্তায় রাতে হয়তো ভালো ঘুমই হয়নি! তাই সূর্য ওঠার আগেই শুরু হয়েছে প্রস্তুতি। না, সুন্দরবনে যাওয়ার জন্য এই নারীরা নতুন শাড়ি, পায়ে আলতা কিংবা ঠোঁটে রং লাগাচ্ছেন না। কারণ তারা সেখানে বেড়াতে যাচ্ছেন না। যাচ্ছেন কাজে। জীবনের লড়াইয়ে টিকে থাকার চেষ্টায়। যাবেন স্বামীর কাজে সহায়তা করতে। ছেলেমেয়ে, ঘর ফেলে থাকবেন অন্তত সপ্তাহখানেক। বাঘের সামনে পড়ুক, সাপ কিংবা কুমির তাড়া করুক কিছুই যায় আসে না তাতে। রোজগার হলেই কেবল ঘুরবে জীবনের চাকা।

চিত্রটা মথুরাপুর জেলেপল্লীর। সুন্দরবন লাগোয়া গ্রাম। মাঝখানে শুধু একটি ছোট্ট নদী। মথুরাপুরে গায়ে গায়ে লাগানো মাটির ঘরগুলো জেগে উঠেছে অনেক আগেই। শীত সকালে কেউ তাঁতানো রোদে পিঠ এলিয়ে দিয়েছে। কেউবা খুব ভোর থেকে কাজে ব্যস্ত। বিরামের সময় নেই। এদের মধ্যে দু’জন নারীর সঙ্গে দেখা। কবিতা সানা (৪৮) আর সুন্দরী বাড়ই (৪৫)। দু’জনই স্বামীর সঙ্গে সুন্দরবন মাছ ধরতে যাবেন। বন বিভাগের অনুমতি পেয়ে গেছেন। তাই তাদের ব্যস্ততা একটু বেশি। সময়ক্ষেপণ করা যাবে না। যত আগে গিয়ে যত বেশি মাছ ধরা যায়, সেজন্যেই সব প্রস্তুতি চলছে তাদের। পশ্চিম উপকূলীয় সীমান্ত জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ বাজার থেকে সুন্দরবনের গা ঘেঁষে যে নদী কালিঞ্চি হয়ে পাঁচনদীর মোহনায় মিলেছে, মথুরাপুরের অবস্থান সেই নদীর ধারে। হরিনগরের বাজারের পাশে ছোট্ট জেলেগ্রাম। তবে মুন্সীগঞ্জ বাজার থেকে নদীর তীর ধরে মথুরাপুর যেতে পেরোতে হয় দীর্ঘ পথ। বিকল্প সড়ক পথে মুন্সিগঞ্জ বাজার থেকে কিংবা গ্যারেজ বাজার থেকে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় মথুরাপুর।



সুন্দরী বাড়ই মাছের জন্য ককসিটের তৈরি বরফের বাক্স তৈরি করে নিচ্ছিলেন। ঘরের সামনে রোদে পিঠ এলিয়ে দিয়ে কাজ করছিলেন স্বামী ববী বাড়ইয়ের সঙ্গে। নৌকা-বড়শি, খাবার-দাবারের জন্য চাল-ডাল, অন্যান্য বাজার, চুলা সব প্রস্তুত হয়ে আছে। বাঙ্খানা তৈরি শেষ হলে রাত পোহালে পরের দিন ভোরেই যাবেন সুন্দরবন। কবিতা সানাও প্রস্তুত হচ্ছেন সব নিয়ে। স্বামী মিন্টু সানার সঙ্গে সুন্দরবনে বড়শি ফেলতে যাবেন। বাঁধের বাইরে ঘরের সামনে দেখাচ্ছিলেন প্রস্তুতি। পুরনো বড়শির সঙ্গে নতুন কিছু বড়শি যোগ করেছেন। এগুলো মাত্র আগেরদিন কেনা হয়েছে হরিনগর হাট থেকে। শুধু কবিতা আর সুন্দরী নয়, এই জেলেগ্রামে প্রায় সকল ঘরের নারীরাই সুন্দরবনে যান জীবিকার তাগিদে। মথুরাপুর জেলেগ্রামের নারীদের এই গল্পগুলো অনেকের কাছে আশ্চর্যের মনে হলেও বেঁচে থাকার প্রয়োজনে এই কঠিন কাজটি এদের কাছে একেবারেই গা সওয়া। প্রায় সকল নারীই বহুবার কোন না কোন বিপদের মুখে পড়েছেন। শুধু সুন্দরবনে নয়, বেশ কয়েকবার বাঘ ছুটে এসেছিল হরিনগরের লোকালয়ে। বনজীবী নারীরা বহুবার বাঘের সামনে পড়েছেন, দস্যুদের বন্দিশালায় থেকেছেন। ছাড়া পেয়েছেন মুক্তিপণের বিনিময়ে। আবার ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের প্রভাব তো আছেই। সুন্দরবনে বিপদের কথা জানাতে গিয়ে সুন্দরী বাড়ই বলেন, ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে একবার ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকা ডুবে গিয়েছিল। বাঘের মুখোমুখি হয়েছেন একবার। আর বনদস্যুদের হাতে ধরা পড়েছেন তিনবার। তিনবারে ১০ হাজার করে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে দস্যুদের কাছ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। কবিতা সানা কিংবা এ গ্রামের অন্যান্য নারীরাও এমন বিপদের মুখে পড়েছেন। কথা বলে বোঝা গেল, এখানকার নারীরা ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গেই নৌকায় সুন্দরবনে যান। এভাবে তারা কাজে দক্ষ হয়ে ওঠেন। সুন্দরবনে গিয়ে এই কাজে নারীর দক্ষতাও যেন এই সমাজে তার মর্যাদা বাড়িয়ে তোলে, সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে সহায়তা করে।

সে কথাই বলছিলেন কবিতা সানা, তারামনি মণ্ডল এবং সন্যাসী সরদার। ভেতরে যেন একটা চাপা কষ্ট নিয়ে এরা বলেন, হয়তো আমার জন্মই হয়েছে এই কাজের জন্য। অন্য এলাকার মানুষ ভাবতেও পারে না আমরা কী পরিমাণ পরিশ্রমে সংসার টানছি। যে নারীরা চাকরি করেন, তারা হয়তো দিনশেষে ঘরে ফিরে আসেন। কিন্তু আমরা সাতদিনের জন্য ঘর, ছেলেপেলে ফেলে বনে চলে যাই। আমার স্বামীর একার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। তাকে সহায়তা করা দরকার। দু’জন মিলে বড়শি ফেলেন, বড়শি তোলেন। প্রতি ট্রিপে ১০-১৫ হাজার কিংবা ২০-২৫ হাজার টাকার মাছ পাওয়া যায়। এই দিয়ে চলে সংসার। কষ্ট হলেও অধিকাংশ পরিবারের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়। জেলেগ্রামের নারীরা জানান, আমাদের কোনো ভিটে নাই। শ্রমের বিনিময়ে যা রোজগার হয়, তা দিয়েই চালাতে হয় সংসার। বাঁধের বাইরে নদীর তীরের ঘরের দরজায় মলিন মুখে বসেছিলেন তারামনি মণ্ডল। বয়স কতোই বা, চল্লিশ পেরিয়েছে। কঠোর শ্রম আর লবণাক্ততায় শরীরের রঙটা যেন তামাটে রূপ ধারণ করেছে। চেহারায় শ্রমের ছাপ স্পষ্ট। স্বামী হরিপদ মণ্ডল মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে। ছেলেমেয়ে নেই। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে সুন্দরবনে যাওয়ার তালিম নিয়েছেন। বিয়ের পর বনে যেতেন স্বামীর সঙ্গে। এখনও সে কাজটিই করেন- বনে যান ভাইয়ের ছেলেদের সঙ্গে। এবং থাকেন তাদের ঘরেই। কথায় কথায় কষ্টের নিঃশ্বাস পড়ে তারামনির। বললেন, কাজ না করলে খাওয়াবে কে? আজকাল কেউ কাউকে বসিয়ে খাওয়ায়?



তারামনির মতো আরও বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে দেখা হলো- যারা স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন। কারও স্বামী মারা গেছে, আবার কারও স্বামী ফেলে চলে গেছে। হিন্দু সমাজে এমন প্রথা খুব একটা চোখে পড়ে না। কিন্তু মথুরাপুর জেলেগ্রামের মন্দিরের সামনে নমিতা মণ্ডলের জীবনে তেমনটাই ঘটেছে। স্বামী স্বপন মণ্ডল একদিন না বলেই বাড়ি থেকে চলে গেছে। অন্যত্র বিয়েও করেছে। দু’মেয়ের একটি স্বপন নিয়ে গেছে, আরেকটি নমিতার কাছে। কষ্ট হলেও মেয়েকে স্কুলে পাঠাচ্ছেন নমিতা। এই জেলেগ্রামে এমন কিছু অসহায় নারীর সঙ্গে দেখা মেলে- যাদের কষ্টটা অন্যদের তুলনায় বেশি। জীবিকা নির্বাহের জন্য এরা নিকটস্থ কারো সঙ্গে বনে মাছ ধরতে যান অথবা একই নদীতে পোনা ধরাসহ অন্যান্য কাজ করেন। জেলেগ্রামে বেশ কয়েকটি দোকান আছে নারী পরিচালিত। কথা বলে আরো জানা গেল, মথুরাপুর জেলেগ্রামের নারীরা অধিক ঝুঁকি নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। নদীর পানিতে লবণের মাত্রা বেড়েছে বলে অনুমান করেন এলাকার মানুষেরা। পানিতে যাদের কাজ সেই নারীরা এ কারণে বেশি ঝুঁকিতে থাকছেন। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বাঘের আক্রমণ, দস্যুদের আক্রমণ- এসব সুন্দরবনে জীবিকা নির্বাহকারী নারীদের প্রধান সমস্যা। শারীরিকভাবেই তারা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। কিন্তু সে তুলনায় সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে এই নারীদের নিয়ে কাজ হচ্ছে খুবই কম। শহর এলাকায় নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে যেসব স্লোগান শোনা যায়, সে চিৎকার মথুরাপুরের মত জেলেগ্রামে খুব একটা আসে না। ফলে বিভিন্ন বিষয়ে নারীদের সচেতনতার মাত্রাও খুবই কম। তবুও বেঁচে আছেন তারা!

পুবের আকাশ ফরসা হয়। মথুরাপুরের নারীরা কাজে যায়। ঘরের সামনে এক টুকরো উঠোন ঝাড়ু দেয়া থেকে শুরু হওয়া দিনের কাজটি কখন শেষ হয়- নারী নিজেও জানেন না। গল্পচ্ছলে কাঁথা সেলাই চলে, ঘরের দাওয়ায় লাইন ধরে পিঁড়িতে বসে মাথায় বিলি দেওয়া চলে, এর মধ্যে রান্নাবান্না, সন্তানের দেখাশুনা, আবার হাট-বাজারটাও করে নিয়ে আসতে হয়। এভাবেই দিন যায়, রাত নামে। আরেকটি ভোরের অপেক্ষায় থাকেন মথুরাপুরের নারীরা।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ জানুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়