ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

সোনালী কাবিন বাংলা কবিতার সিগনেচার

জব্বার আল নাঈম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০৬, ১৫ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সোনালী কাবিন বাংলা কবিতার সিগনেচার

জব্বার আল নাঈম : বাংলার জনজীবনের গ্রামীণ সৌন্দর্যের রূপ, রস ও গন্ধ পুরোদমে উন্মেষ ঘটেছে আল মাহমুদের কাব্য সৃজনের মাধ্যমে। তিনি নানান উপমা ও উৎপ্রেক্ষায় বিভিন্ন সঙ্গতি ও সুন্দরকে স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের ভঙ্গিমায়, শব্দের সুষমা, কলাকৌশল ও কষ্টময়তাকে অলংকরণের ক্যানভাসে বর্ণিল আয়োজনের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।

বাঙালিমাত্রই জানেন গ্রামীণ ক্যানভাসের অন্যতম অলংকরণ হল প্রকৃতি। প্রকৃতির বিছানায় গা এলিয়ে দেখি সুন্দরের পাঠশালা, পাঠাগারে বেড়ে উঠছে গাছ, ফল ও ফুল। নদীর স্রোতের গায়ে বয়ে যাওয়া ঢেউয়ের সাথে প্রতিনিয়ত কারা যেন জিকির তুলে ‘বলো কন্যা কবুল কবুল’ বলে। সেই ধ্বনি ভাসতে ভাসতে দেশীয় মাশরিক থেকে মাগরিবের দরজায় কড়া নাড়ছে আর বাতাস থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে শহরের রাস্তায় ঘুড়ি উড়িয়ে আনন্দ বিলি করছে মানুষের মাঝে।

কবি শহর ও গ্রামকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আলাদা করতে নারাজ। দুটিই মানুষের দেহের অংশ। আবার একটি আত্মার সমন্বয়ে দেহ গঠিত। তফাৎ শুধু গাছ, পালা, নদী ও নালা। অথচ মানুষ জানে শহরে যারা বসবাস করেন, গ্রামেও তারাই। সেই তারাই আবার পার্থক্য করে থাকেন। যা আমাদের মাঝে আন্তঃদ্বন্দ্বই তৈরি করে শুধু। এই শহরে বসবাস করে গ্রাম থেকে উঠে আসা একদল মানুষ। যাদের নাড়ির টান গ্রামের আলপথের শেষ প্রান্তে এখনও নিবিড়ভাবে প্রোথিত। চেনা-জানা পরিচিত শব্দের ভেতরেই তাদের বসবাস ও বেড়ে চলা। কবি আল মাহমুদ সেই সভ্যতারই অন্যতম অ্যাম্বাসেডর। পরবর্তীতে বাংলা কবিতায় সেই স্বাক্ষর তিনি দেখিয়েছেন।

প্রত্যেক কবির সত্তা ও স্বভাবে প্রজ্জ্বলিত হতে থাকে গ্রামীণ সৌন্দর্যবোধ ও মমত্বমাখা ভালোবাসায়। কবি আল মাহমুদ সেখানেই উজ্জল কিন্তু ব্যতিক্রম নন। তিনি সুন্দরের পূজারী হয়ে নিজস্ব সুন্দর নিয়ে পৌঁছে গেছেন মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি। সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের সাহিত্য সত্তার ক্যাম্পাস।

গ্রামীণ সৌন্দর্যে আল মাহমুদ একটা নিরাময়ের নাম। একটি এন্টিবায়োটিক। যে এন্টিবায়োটিক ছাড়া মুশকিল থেকে আসান মেলা অসম্ভব। যে কবি কলম দিয়ে গ্রামকে বানিয়েছেন শুশ্রুষার প্রতীক। আজ সেই শুশ্রুষার প্রতীকও বদলে যাচ্ছে, আধুনিকতার ছোঁয়ায়। আর ক্রমান্বয়ে সুন্দরকে সম্প্রচারের নামে সম্ভাবনাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে মানুষ। হয়ত কবি জানেন না তার চিরচেনা গ্রামে ফিরে গেলে সুন্দর ফিরে পাবেন না। কৃত্রিমের সামনে সুন্দর অনেকটা হুমকিতে রয়েছে।

ফিরলে আজো পাবো কি সেই নদী/স্রোতের তোড়ে ভাঙা সে এক গ্রাম?/হায়রে নদী খেয়েছে সবকিছু/জলের ঢেউ ডেকেছে নাম-ধাম। কি এক দারুণ বৈচিত্র্য! গ্রামের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত সেই নদী আর নেই। নদীগুলো এখন করপোরেট  মালিকের পেটে আনাগোনা করছে। প্রকম্পিত হচ্ছে কবির কলম। মূর্ছা যাচ্ছেন কবিও। এমন সত্যের সামনে আবার যিনি ব্যতিক্রম তিনি আল মাহমুদ।

চল্লিশের দশকের নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আল মাহমুদের ‘কালের কলস’ ও ‘লোক লোকান্তর’ হতে কয়েকটি কবিতা দরাজ কণ্ঠে আবৃত্তি করে বিস্মিত হয়ে, পূর্ববাংলার এই মৃত্তিকাশ্রয়ী কবিকে বাংলা কাব্যজগতে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কবি সুফিয়া কামাল ও রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাই লাকসাম কচি-কাঁচার অনুষ্ঠানে সদ্য প্রকাশিত সোনালী কাবিনের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছিলেন ‘বাংলা কাব্যের আরেক বিস্ময়ের নাম আল মাহমুদ।’

সত্যিই তো পরবর্তী সময়ে বাংলা কাব্যে আল মাহমুদ ও আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’ এর বিস্ময়কর রাজত্বকাল চলে। যা এখনও বহমান। আগামী দিনগুলোতেও চলবে কাবিনের শাসন। সুফিয়া কামালের সেই স্বরে তাল মিলিয়ে বলতে হয়-পঙক্তির মতো নিয়েছিলেন, ‘ক্ষীরের মতন গাঢ় মাটির নরমে/কোমল ধানের চারা রুয়ে দিতে গিয়ে/ভাবলাম, এ মৃত্তিকা প্রিয়তমা কৃষাণী আমার।’ প্রিয়তমা কৃষানী আমার।” কৃষাণী পূর্ব বাংলার এই রূপেই যেন দেখতে পাই মুক্তিযুদ্ধপূর্ব ও উত্তরকালে রচিত এবং এতে রচিত কাব্যগ্রন্থমালা। স্বভাবত এই নদ, নদী ও মৃত্তিকা সোনালী কাবিনের অন্যতম অনুসঙ্গ। সেই রূপটি কবি তার কাব্যে এঁকেছেন অসাধারণ প্রেম, ভালোবাসা ও কাব্যময়তায়। প্রেমের স্রোতস্বিনী নকশায় আমাদের রমণীরা বুনেন শাড়িতে নানান চিত্রকর্ম। এখন সেসব হারিয়ে গেলেও কবিতার বর্ণবিন্যাসে সমানভাবে জ্বলছে। পরিপূর্ণতায় নিতম্বের কলস্বর আমাদের আবহ সংগীতকে দিয়েছে আলাদা ব্যঞ্জনা।

আর এই সোনালি কাবিন সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল- সোনালী কাবিন, আসন্ন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কাব্যিক সংবাদ ও প্রেমের দখিণাহস্ত। যেখানে রয়েছে নারীর নিখুঁত সৌন্দর্য, প্রকৃতির সুনিপুণ বর্ণনা, প্রেম ও কামের বৈচিত্রময় ক্যানভাস আর সেই বৈচিত্রময় ক্যানভাসের রূপকার বাংলাদেশের প্রান্তিক পর্যায় থেকে উঠে আসা একজন অল্প শিক্ষিত কবির কলম। কবি প্রকৃতিকে দেখিয়েছেন নানান উপমা ও উৎপ্রেক্ষার ভঙ্গিমায়। নানান ব্যঞ্জনা ও চিত্রকলায়। আর এ কথা বলা যায়, নানান ভঙ্গিমা, উপমা, ব্যঞ্জনা ও চিত্রকল্প হলেও যেখানে রয়েছে বাস্তবতার ছোঁয়া।

‘নোলক’ কবিতায় মায়ের হারিয়ে যাওয়া সোনার নোলক না নিয়ে ঘরে না ফেরার প্রত্যয় ছিল এই কবিতা ও কাব্যগ্রন্থের অন্যতম প্রধান প্রতিজ্ঞা। এই কঠিন প্রতিজ্ঞা অন্ত্যজ ও প্রাকৃত কিন্তু চিরায়ত সত্য প্রতিষ্ঠার প্রধান লক্ষ্য প্রতীয়মান হয়েছে সোনালি কাবিনের সনেটগুচ্ছে।

সোনালি কাবিনের পরতে পরতে লোকজ সংস্কৃতির বর্ণনাই প্রধান। বাংলা কবিতায় অভিনব নতুনত্ব নিয়ে যখন হাজির হয়েছেন মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। রবীন্দ্রনাথ আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বারবার জিকির তোলেন ধ্যান ও চিন্তা দিয়ে। কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী সুর তুলে প্রবল ভাঙচুর শুরু করেন।  জসীমউদদীনের পল্লী অঞ্চলের সকল সংগ্রহ নিয়ে চেনা-জানাকে আরো বেশি চিনিয়েছেন আমাদের শহুরে সমাজে। জীবনানন্দ দাশ সেখান হতে বের হয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশকে বলতে চেয়েছেন ভিন্নভাবে। কিন্তু কবি আল মাহমুদের সাহিত্য প্লট যেন তা ছাড়িয়ে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে সব জায়গায় আল মাহমুদ লাব্বাইক লাব্বাইক করছেন। আর এর ভেতর দিয়েই যেন শাশ্বত বাণী আওড়িয়েছেন তিনি।

৬ নং সনেটে দেখিয়েছেন-কবি কৌম সমাজ থেকে এসেছেন। আর নারীর হৃদয়ে গভীর ব্যঞ্জনায় ঢেউ তুলেছেন। সেই ঢেউয়ে একবার ভেসেছে আরেকবার ডুবেছে বেদনাবিধূর হৃদয়। নারীরা বারবারই পুরুষের প্রেমে মুগ্ধ হয়েছে। আবার পুরুষরা নারীর প্রেমে। এই প্রেম-অপ্রেম খেলা এখনও চলছে নগরে নগরে। নারীকে নিয়ে আমাদের যত বন্দনা ততটা নেই সামন্ত সমাজ নিয়ে। নারীকে কতভাবেই পাওয়া যায়। নারীরা মমতাময়ী হিসেবে উজ্জ্বল। কখনও মা হয়ে। কখনও মেয়ে আবার কখনও বোন হিসেবে। আবার কামের দেবি হিসেবেও। কবির ধ্যান জ্ঞান শুধু মাত্রই নারী। নারীতেই শোলোক। নারীতেই মুক্তি। আর এই মুক্তি আমাদের সামনে এসেছে একাত্তরের সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। কিংবা অন্যকোন মুক্তি খুঁজেছেন কবি।

অবাঞ্চিত ভক্তিরসে এ যাবৎ করেছি যে ভুল’ তা থেকে বেরিয়ে আসতে চান কবি। এই পটভূমি থেকে বেড়ে ওঠা কবি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে উচ্চারণ করতে পারেন-

কবিতা তো ছেচল্লিশে বেড়ে ওঠা অসুখী কিশোর

ইস্কুল পালানো সভা, স্বাধীনতা, মিছিল, নিশান

চতুর্দিকে হতবাক দাঙ্গার আগুনে

নিঃশ্ব ফিরে আসা অগ্রজের কাতর বর্ণনা...

এতকিছু স্বত্তেও একজন কবির পরিচয় হাজার বছরের গ্রাম বাংলা, চিরায়িত প্রাচীন। যেখানে বেড়ে ওঠা, যেখানে রয়েছে স্মৃতির মিলনমেলা। অভাবের আলক্ষ্যে যাপিত জীবন হয় শুদ্ধাচারের দিকে ধাবিত হয় না হয় ধ্বংসের রাস্তায় বেখেয়ালি হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে দরিদ্রের প্রেম জাগে মন ও মগজে। এতেই সামান্য আনন্দ খোঁজে। কিংবা বিনোদন ভাবে। অথবা বাউল সেজে বেখেয়ালি রাস্তায় ধুকতে থাকে জীবন। এর মূল কারণ পোকায় ধরা সমাজ। এমন জরাজীর্ণতাকে সতেজতায় ভরিয়ে দিতে পারে কেবল দ্রোহী কবিতা। সেই কবিতায় যে সব ভাঙচুর থাকবে এমন নয়। দুধের ভেতর বিষ মিশিয়ে নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া পাওয়া যেতে পারে। আবার চিনি মিশিয়ে ভিন্ন স্বাদও নেওয়া সম্ভব।

শরমিন্দা হলে তুমি, ক্ষান্তিহীন সজল চুম্বনে

মুছে দেবো আদ্যাক্ষর রক্তবর্ণ অনার্য প্রাচীন।

আরেক উচ্চারণে বলেছেন-

অভাবের অজগর জেনো তবে আমার টোটেম

তোমার কপালে লাল আর দীন দরিদ্রের প্রেম।

...তোমার দুধের বাটি খেয়ে যাবে সোনার মেকুর

না দেখার ভান করে কতকাল দেখবে, চঞ্চলা?

কবির কাছে তাই প্রধান হয়ে ওঠে : ‘তোমার চেয়েও বড়ো হে শ্যামাঙ্গী শস্যের বিপদ।’ যে ‘খোরাকির শত্রু’ তার সঙ্গে কোনো সমঝোতা নেই। কবি তাই ‘ঝড়ের কসম’ দিয়ে বলেন :

বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই

দোহাই মাছ ও মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর

লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই

‘আমিষের নলা’র মধ্যে যদি ‘নাপাক জবানে’র হারাম রোজগার প্রবেশ করতে থাকে তবে ‘ভাষার শপথ আর প্রেমময় কাব্যের শপথ’ নিয়ে তিনি তাকে ‘লানৎ’ দেন। এই কাব্য কাঠামোর মধ্যে যেমন ‘অনার্য প্রাচীন’ বাঙলার বিন্যাস রয়েছে তেমনি রয়েছে প্রান্তিক জীবনের এক অনন্য সাধারণ প্রত্যয়। নিম্নোক্ত  পঙতিমালার সৌন্দর্য শুধু কবির শিল্প থেকে জাত নয়, কৌম মানুষের দৃঢ়াবস্থান হতে অর্জিত :

শুভ এই ধানদূর্বা শিরোধার্য করে মহিয়সী

আবরু আলগা করে বাঁধো ফের চুলের স্তবক,

চৌকাঠ ধরেছে এসে ননদীরা তোমার বয়সী

সমানত হয়ে শোনো সংসারের প্রথম সবক।

বধূবরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকুল

গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল কবুল।

সনেটগুচ্ছে কাম ও যৌনতা উন্মুক্ত ও তীব্র কিন্তু একথা ভুললে কবির প্রতি অবিচার করা হবে যে, তার সবটুকুই ‘শস্যের সপক্ষে’। অন্য সনেটে ‘শস্যের সুবাসে’র সঙ্গে বলা হয়েছে ‘যে নারী উন্মুক্ত করে তার ধন-ধান্যের দুয়ার’। এ পরিপ্রেক্ষিতেই ‘খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ’কে বুঝতে হবে। ‘উল্টানো চোখ’ কবিতায় তাই তিনি এমন পূর্ব বাংলাকে আবিষ্কার করেন যা তার নিজস্বতায় ঋদ্ধ :

এঁদো ডোবা। কচুরিপানার ওপর বেগুনি ফুল। নেবুলতার

ভেতর দিয়ে ধাবমান বাতাস। গোবরের গন্ধ। কোকিল। পাট খেতে

দমবন্ধ গরমের মধ্যে মোল্লাবাড়ির সবচেয়ে রূপসী মেয়েটিকে

চুমু খাওয়া।

এটিও তাৎপর্যপূর্ণ সত্য যে, ‘সত্যের দাপটে’ কবিতায় অভিপ্রায় ভিন্ন হলেও তার মৃদু যৌনতা কবির মনে অথবা বিশ্বাসে জেগে থাকে:

খাটের বিছানা জুড়ে ঘুমিয়েছে যে গরিমা, তার

দ্যাখা চেয়ে বুক দুলছে, নিঃশ্বাসে কাঁপছে দুটি বুক।

বাহুতে জমেছে ঘাম।

শান্ত, শুভ্র ও নরম দেশজ শব্দের প্রতি আল মাহমুদের পক্ষপাত দারুণ পরিষ্কার। সেটা তার কাব্যবিশ্বাস ও শৈলীর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণও বটে। কিন্তু সেক্ষেত্রে মাত্রাবোধের বিষয়টিও ছিল সুবিবেচ্য। ফলে ‘কলসে’র পরিবর্তে ‘ঠিলা’ পছন্দ হলেও নিজের কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রে প্রথমোক্ত শব্দটিই বেছে নিয়েছেন। গত শত শত বছর ধরে আলোচিত বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে অসংখ্য ‘নদী’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে বিভিন্ন উপমায়, কিন্তু একজন আল মাহমুদ যখন বলে ওঠেন ‘গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল কবুল’ তখন মনে হয় এর চেয়ে সুপাঠ্য ও সুপ্রযুক্ত আর কিছুই নয়।

শহরের ভদ্র ও শুদ্ধতাকে পাশ কাটিয়ে গ্রামীণ শুদ্ধতার আঁচলে মাত্রাঋদ্ধ হয়ে কবিতায় যখন জনাব ‘মিয়া’, সকল নষ্টামি ‘হগল পুংটামি’, কাক ‘কাউয়া’, নৌকা ‘নাও’, ছোট মাছ ‘বইচা’, পরেছি ‘পিন্দেছি’ বা মামা ‘মামু’-তে পরিবর্তিত হয় সহজেই। সেখানে ‘কাল ও কবির বৈভবে’র মতো ভাস্কর্যসদৃশ্য ও বাক্যবন্ধ দেখি। সেই কবিই পল্লী মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে ‘স্তনে’র পরিবর্তে দেশজ ‘বুনি’ শব্দই কবির অধিক পছন্দ। আঞ্চলিক সচেতনতায় ঋদ্ধ কবি লেখেন ‘স্তন দুটি দুধের ভারে ফলের আবেগে ঝুলে আছে।’ আবার ‘আঘ্রাণ’ কবিতায় লবণ ও নুন-উভয়ের ব্যবহারে কবি শব্দ সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসেন নিজস্ব শক্তিতে। কবিতাটির শেষ পঙক্তি ‘হে বরুণ বৃষ্টির দেবতা!’ তাকে সংস্কারের পরিবর্তে মৃত্তিকায় প্রোথিত করে।

যে সময়ে, বিশেষত মুক্তিযুদ্ধপূর্ব পর্বে যে কবিতাগুলি তিনি লিখেছেন তাতে স্বভাবতই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ‘উল্টানো চোখ’-এ খুব সরলভাবে বললেও, বা ঐ সারল্যের কারণেই, তা তীব্র ও তীক্ষ্ম হয়ে ওঠে। ‘ভিয়েতনামে বোমা পড়ছে। আমি তার প্রতিবাদ করি।’ ‘ক্যামোফ্লেজ-এ এশিয়ার বিস্তুত পটভূমির চিৎকার:

জেনো, শত্রুরাও পরে আছে সবুজ কামিজ

শিরস্ত্রাণে লতাপাতা, কামানের ওপর পল্লব।

ঢেকে রেখে

নখ

দাঁত

লিঙ্গ

বন্দুকের নল

হয়ে গেছে নিরাসক্ত বিষকাটালির ছোটো ঝোপ।

বাঁচাও বাঁচাও বলে

এশিয়ার মানচিত্রে কাতর

তোমার চিৎকার শুনে দোলে বৃক্ষ

নিসর্গ, নিয়ম।

প্রিয় সহকর্মী আহমেদুর রহমানের অকাল মৃত্যুতে ‘আত্মীয়ের মুখ’ কবিতায় কবির দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিকতায় রূপ নিয়েছে।

বইয়ের দোকান যদি নেই, কেনো তবে সেখানে গমন?

সকালে সংবাদপত্র, রাজনীতি, ক্ষুব্ধ খোঁচাখুঁচি

যা কিনা রক্তাক্ত শার্টেল মতো পরে আছে আমাদের ভয়ার্ত শতক-

এসবের উর্ধ্বে আজ বিনাবাক্য ব্যয়ে

কি করে থাকেন?

জানি না, দেশের খবর কিছু পান কি না,...

আরেক শক্তিশালী লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার উপন্যাসে যে স্বদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন, তা কবি আল মাহমুদ বাক্সময় করে তুলতে চেয়েছেন কবিতার মাধ্যমে। এতে কোনো সন্দেহ না রেখেই বলা যায় আল মাহমুদেরও ছিল এক আন্তর্জাতিক অভিযাত্রা। আর সেই সত্য উপস্থাপনা করেছেন তার কবিতার বর্ণনা ও ভঙিমায়।

আল মাহমুদের ১০ নং সনেটে নজর রাখলে তা স্পষ্ট হবে।

শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতেরা উঠিয়েছে হাত

হিয়েন সাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,

এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত

তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা।

আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,

পরম শান্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণির উচ্ছেদ,

এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ,

যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ

প্রগতিশীলতার চূড়ান্ত দ্রাঘিমা এঁকেছেন এখানে। ধর্মের চাইতে বেশি সাম্যের কথা বলে সাম্যের বাণী আওড়িয়েছেন। আবার বলেছেনও, ‘যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ’। ‘সোনালি কাবিন’ কাব্যগ্রন্থে নারীর ভূমিকা প্রধান থাকলেও পিতার স্বপ্নও কম না। ‘বাবা’র স্বপ্নটিও কম বড় সত্য নয়, বরং সেটিই হয়তো আসল সত্য। সন্তান যেখানে ভাঙনের শব্দ শোনে, সেখানে বাবা ‘বলতেন, আয়/কোথায় চর জাগলো দেখে আসি।’

গ্রামের সহজ, সরল ও সাধারণ মানুষগুলো একদিন শহরের এসে শহর দখল করে নেবে তেমন ভবিষ্যৎ বাণী কবি আগেই করে গেছেন। যার ব্যত্যয় ঘটেনি পরবর্তী সময়ে। ঐতিহাসিক সেই সাক্ষী খাতায় কবি নিজেও। গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন এই শহরে।

যেমন আমি ভাবি,

গ্রাম থেকে শুদ্ধ মানুষের স্রোত এসে

একদিন শহর দখল করে নেবে।

তবে, একথা সত্য বে-তমিজ গাঁওয়ের পোলারা যদি সভ্যতা গড়ার কাজে মনোযোগি না হতো তাহলে আমরা আজকের অবস্থান থেকে আরো পিছিয়ে থাকতাম। সেটা হতে পারত, পরিকল্পনায় কিংবা আমাদের সমাজ ও অর্থনীতির বিষয়ে।

‘প্রকৃতি’ কবিতায় মাহমুদের আপসোস এই মানুষ নিয়ে। মানুষের উন্নতি আর অগ্রগতি নিয়ে তার সন্দেহের অন্ত নেই। ‘কতদূর এগোলো মানুষ!’ এমন বিস্ময়কর সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে ‘সোনালি কাবিন’ লেখার চল্লিশ বছর আর দেশ স্বাধীন হওয়ার ছেচল্লিশ বছর পরেও কবি আল মাহমুদের ভাষায় আমরা বলতে পারছি না ‘কতদূর এগোলো মানুষ!’। এই হল কবিতার দার্শনিক সত্য। যে সত্যকে অস্বীকার করা দুঃসাধ্য।

মানুষের অগ্রগতি নেই এমন সত্য জেনেও আমাদের ভেতরে ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ হারিয়ে বেহায়া প্রায় জীব আমরা। পরবর্তী জেনারেশনের জন্য আমাদের আরো অনেক কিছু করার থাকলেও আমরা করতে পারছি না। না করতে পারাটা ব্যর্থতা না, লজ্জাও না। সদিচ্ছার অভাব। ফিরে আসাটা কখনই লজ্জার নয়। ক্ষেত্র বিশেষে সেটা গর্বেরও হয়। মাহমুদ যখন সকল জড়তা ভেঙে বলতে পারেন, ‘আর আমি মাকে জড়িয়ে ধরে আমার প্রত্যাবর্তনের লজ্জাকে ঘষে ঘষে তুলে ফেলবো।’ বলতে পারাটাই সাহসিকতা। আমরা এখানে মা বলতে স্বদেশ মাতাকে বুঝতে পারি। স্বদেশের কলোনী ধরে বিশ্ব মানচিত্রে গর্দান উচু করা সম্ভব। না হয় আমরা পিছিয়ে যাব আগের মতো। বরং লজ্জা ভুলে ফিরে এসে জড়িয়ে ধরে দেশকে নিয়ে যেতে হবে উন্নতির সোপানে এই যেন আল মাহমুদের প্রত্যয়।

প্রত্যয়ের আহ্বানে ঊনসত্তরকেই একাত্তর হিসেবে দেখে বলেন:

কোথায় পাবো মতিয়ূরকে

ঘুমিয়ে আছে সে;

তোরাই তবে সোনামানিক

আগুন জ্বলে দে।

কবি দেশের পতাকা আগামী প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে সর্বদা প্রস্তুত। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে তরুণ নেতৃত্ব দরকার। দরকার শক্ত হাতে আলোর পথ দেখানো। তাই এখন আর সেই মতিয়ূরকে দরকার নেই। অসংখ্য মতিয়ূর জীবিত। এই সোনামানিকেরা আগামীর জাতি গঠনে অনেক অবদান রাখবে।

সভ্যতার উন্মেষ ঘটানোর জন্য মানুষ শহরমুখী হয়। কিন্তু, পরবর্তী জেনারেশন শেকড় ভুলে নিরানির স্তূপাকার জঞ্জাল ভুলে যায়! তখনই আল মাহমুদরে ‘খড়ের গম্বুজ’ প্রাসঙ্গিক সত্য হয়ে সামনে দাঁড়ায়। শহরের বুকে দাঁড়িয়ে আমরা ফিরে তাকাতে বাধ্য হই চিরপরিচিত গ্রামের আলপথ ধরে হেঁটে চলা। বৈঠকখানার দিকে। মজলিসের দিকে। হারানো ঐতিহ্যের দিকে। মারফতি গান শুনতে শুনতে দিন কেটে যেত আনন্দে। কি দারুণ উদযাপনের দিন ছিল সে সময়। গ্রামের দখিণা বাতাস বয়ে যায় উদাস বাউলের মতো। দিন শুরু হলেই অবিরাম চলা শুরু। এ চলার যেন শেষ নেই। শেষ না হওয়া শেষ দিয়েই আমাদের আজীবন। আমাদের পথ চলা। সেই পথচলার ভেতর অবিরাম আনন্দ মিশ্রিত ছিল। আর এমন হারিয়ে যাওয়া অতীতের খোঁজে পেছন ফেরাতে বাধ্য করান একজন শক্তিশালী কবি। কৃষক বাবার ছেলে শহরে এসে সভ্য হয়। কিন্তু সেই সভ্যতায় সে নষ্ট হয়ে ধানের বিচালিকে ময়লা ভাবে। শস্য শিল্পীদের সঙ্গে বসতে কিংবা তামাক সাজাতে অস্বস্তি প্রকাশ করে।

স্বদেশ প্রেমের শ্লোগান মুখে তুলে নগরের অন্ধ গলিতে অনেক শকুন উড়াউড়ি করছে। যারা চিড়ে ছিড়ে খায় প্রকৃত স্বদেশ প্রেমি মানুষের উরু। বিচ্ছেদে বিষাদগীতি যারা করছেন তাদের অনিবার্য ধ্বংসের রাস্তায় নামিয়ে কবিরা বয়ান করেন সুন্দরের। কবি মাত্রই সুন্দরের পূজারী। সুন্দরের প্রতিধ্বনি। কবি আল মাহমুদ সোনালি কাবিনের রূপকার। কবির নিজের বক্তব্য আরেকটা ‘সোনালি কাবিন’ কবির পক্ষে দ্বিতীয়বার লিখা সম্ভব নয়! ‘সোনালি কাবিন’ গত চল্লিশ বছর ধরে বাংলা কাব্যের অনিবার্য কাব্যিক সংবাদ বা প্রতিধ্বনি। ‘সোনালি কাবিন’কে অস্বীকার বা অবজ্ঞা করার সুযোগ আমাদের কিংবা আল মাহমুদের আছে?



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ আগস্ট ২০১৭/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়