ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

উপকূলের পথে

স্কুলে যাওয়ার যুদ্ধে পরাজিত ওরা!

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৪, ২৪ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
স্কুলে যাওয়ার যুদ্ধে পরাজিত ওরা!

রফিকুল ইসলাম মন্টু, ভোলার চরফ্যাসনের ঢালচর ঘুরে: এখানকার শিক্ষা চিত্রটা কিছুটা ভিন্ন। এখানে স্কুলে যাওয়াটা জীবনের আরেক যুদ্ধ। আর সেই যুদ্ধে পরাজিত হয় অনেকেই। যেসব কিশোর-তরুণেরা এখন মাছধরাসহ বহুমূখী শ্রমে রোজগারে ব্যস্ত; এদের অনেকেরই স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে মানুষ হবে। কিন্তু স্বপ্নপূরণ হয়নি। বিরূপ প্রকৃতি ওদের সহায় হয়নি। অবশেষে স্কুলের বইখাতা ফেলে শ্রমিকের তালিকায় নাম লেখাতে তারা বাধ্য হয়েছে। এদেরই একজন মুসলিম উদ্দিন মির্জা।

ভোলা জেলার চরফ্যাসন উপজেলার সর্বদক্ষিণে ঢালচরের শিক্ষাচিত্রটা এমনই। স্কুল মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্তরা বহুমূখী সংকট মোকাবেলা করে এগুচ্ছেন। এখানে শুধু বসতবাড়ি নয়, বার বার বদল করতে হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা তো দূরের কথা, প্রাথমিকের শিক্ষাটুকু গ্রহণ করাই কঠিন। দ্বীপে রয়েছে তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং একটি মাদ্রাসা। কিন্তু এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী সংখ্যা দিন দিন কমছে বলে জানালেন সংশ্লিষ্টরা।

আলাপ হচ্ছিল মুসলিম উদ্দিনের সঙ্গে। তার বাবার জমিজমা যা ছিল, তা দিয়ে চলছিল ভালোই। মুসলিম লেখাপড়া করছিল। ফাঁকে বাবার কাজে সহায়তা। কিন্তু অস্টম শ্রেণীর পর মুসলিম আর এগোতে পারেনি। নদী ভাঙনের কারণে পরিবারে অভাব তীব্র আকার ধারণ করে। অবশেষে মুসলিম কাজে ফেরে। ইউনিয়ন পরিষদে ছোট একটা চাকরি নিয়েছে; কিন্তু তাতে পোষায় না বলে বাজারে দর্জির দোকান দিয়েছে। কখনো আবার নদীতে জাল ফেলতেও যায়। মুসলিমের লেখাপড়া করে বড় হওয়ার স্বপ্ন এভাবেই ঝাপসা হয়ে গেছে।
 


ঢালচরের আদর্শপাড়া থেকে ভাঙন তীর ঘুরে হাজীপুর এসেই দেখা হলো বেশ কয়েকজন স্কুল শিক্ষার্থীর সঙ্গে। আলাপে জানা গেল ওদের স্কুলে যাওয়ার লড়াইয়ের কথা। ওরা জানালো, আগে স্কুল ছিল ওদিকে (হাত তুলে দেখিয়ে) বাড়ির কাছে। এখন অনেক দূরে এই স্কুলে আসতে হয়। এখানে পড়াশোনা তারা করতে পারে না। খেলার মাঠ নেই। ক্লাসে বসার জায়গা নেই। আরেকটু সামনে এগুলে চোখে পড়লো সাইক্লোন শেলটারে আরও কিছু শিক্ষার্থী। পশ্চিম ঢালচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নদীতে হারিয়ে যাওয়ার পর এই শেলটারেই স্থানান্তর করা হয়েছে।

আলাপ হলো এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জহিরুল হকের সাথে। তিনি জানালেন, ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের দালালপুর থেকে বিদ্যালয়টি চার মাস আগে স্থানান্তর করা হয়েছে ২নং ওয়ার্ডের হাজীপুর গ্রামে। এখানে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের দোতলায় স্কুলের কাজ পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু এখানে শিক্ষার পরিবেশ নেই। ছাত্রছাত্রীদের বসার স্থান নেই; খেলার মাঠ নেই। টয়লেটের অবস্থা ভালো নয়। প্রধান শিক্ষক জানালেন, স্থানান্তরের কারণে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কমেছে। এক সময় ৩০০ থেকে ৩৫০ শিক্ষার্থী থাকলেও এখন শিক্ষার্থী সংখ্যা মাত্র ১৭০জন।

দ্বীপের প্রাকৃতিক এই বিপর্যয় শিক্ষা ব্যবস্থায় কী ধরনের প্রভাব ফেলছে, জানতে চাইলে জহিরুল হক বলেন, ‘এ অবস্থা বহু শিক্ষার্থীকে স্কুল বিমুখ করছে। এখানকার বহু দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের স্কুলে আসার ক্ষেত্রে এমনিতেই নানামুখী সংকট রয়েছে। অনেক অভিভাবক বিশেষ করে ছেলেদের স্কুলে পাঠানোর চেয়ে কাজে পাঠানো লাভজনক মনে করেন। যারা স্কুলে আসে তাদের অনেক যুদ্ধ করেই স্কুলে আসতে হয়। এর ওপর বারবার বিদ্যালয় স্থানান্তরের ফলে ঝরে পড়ার হার বাড়ছে। অনেকে আবার এলাকা ছেড়ে দ্বীপের বাইরে অন্য কোথায় বসতি স্থানান্তর করেছে। ওইসব পরিবারের অভিভাবকদের সঙ্গে তাদের ছেলেমেয়েরাও চলে গেছে।’
 


দ্বীপের ঢালচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও একবার স্থানান্তর করা হয়েছে। এটির কার্যক্রম চলছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্টট্রাস্টের দোতলা ভবনের নিচতলায়। মুজিব কিল্লা সংলগ্ন উত্তর ঢালচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও ভাঙনের মুখে চলে এসেছে। অন্যদিকে ঢালচর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা ও একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়টিও ভাঙনের খুব কাছাকাছি। ভাঙনের বর্তমান গতি অব্যাহত থাকলে অচিরেই বাকি তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও স্থানান্তর করতে হবে।

ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের হাজীপুরে ঢালচর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসায় আলাপ হলো সুপার মো. আমীর হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, এক সময় এই মাদ্রাসা ছিল ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের কেরামতগঞ্জ এলাকায়। ভাঙন ধেয়ে আসায় অনেক দূরে এসে জমি কিনে টিনশেড ঘর তুলে মাদ্রাসার কার্যক্রম শুরু করা হয়। কিন্তু ভাঙন তবুও পিছু ছাড়েনি। এখানে এসেও দেখা যাচ্ছে ভাঙন নিকটে চলে এসেছে। ভাঙনের মুখে থাকায় শিক্ষার্থী সংখ্যা দিন দিন কমছে। এক হিসাব দেখিয়ে মাদ্রাসা সুপার বলেন, ২০১৭ সালের প্রথম দিকে ৪৭৯জন শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও বছর শেষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ২৫০ জনে। এখনও প্রতিদিন বিদ্যালয় পরিবর্তনের সার্টিফিকেট নিতে আসছে শিক্ষার্থীরা।

দ্বীপের শিক্ষাচিত্র তুলে ধরে মাদ্রাসা সুপার মো. আমীর হোসেন বলেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় শিক্ষায় মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ইচ্ছা থাকা সত্বেও আমরা মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারছি না। বর্ষাকালে স্কুল-মাদ্রাসায় ঠিকভাবে ক্লাস করানো সম্ভব হয় না। জোয়ারের পানিতে এলাকা ডুবে যাওয়ায় ছুটি দিয়ে দিতে হয়। এ হিসাবে দেখা যায়, বর্ষার ৬মাস দৈনিক গড়ে ২-৩ ঘণ্টার বেশি ক্লাস করানো সম্ভব হয় না। যতই দিন যাচ্ছে, অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে।

দাখিল মাদ্রাসার পাশেই রয়েছে একতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভবন। পুরনো ভবনটির পলেস্তারা খসে পড়ছে। শ্রেণীকক্ষের অবস্থাও ভালো নয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে। ঢালচর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুস সালাম হাওলাদার বলেন, এই দ্বীপের অভিভাবকেরা অনেক কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠায়। কিন্তু প্রকৃতির বৈরিতায়, বিশেষ করে নদী ভাঙনের কারণে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় মারাত্মক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বর্ষাকালে ছেলেমেয়েদের স্কুলে যেতে খুবই সমস্যা দেখা দেয়। শিক্ষার সংকট উত্তরণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নতুন ভবনের পাশাপাশি শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।

**



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ জানুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়