স্মরণ : ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ
শাহ মতিন টিপু : ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ছিলেন সঙ্গীতজগতের দিকপাল সাধক। তিনিই প্রথম বাঙালি, যিনি সর্বপ্রথম পাশ্চাত্যে এই উপমহাদেশের রাগসঙ্গীতকে পরিচিত করেন। তিনি ছিলেন অতি উচ্চমাত্রার সঙ্গীতকলাকার। এই মহান সঙ্গীতজ্ঞ’র ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
তিনি ১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের মধ্যপ্রদেশের মাইহারে মৃত্যুবরণ করেন। জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে বিখ্যাত এক সঙ্গীতশিল্পী পরিবারে ১৮৬২ সালের ৮ অক্টোবর। তার পিতা সবদর হোসেন খাঁ ওরফে সদু খাঁও ছিলেন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ।
বলা হয়, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য সঙ্গীত সাধক। আমাদের গর্ব যে, এই বিখ্যাত প্রতিভাধর মানুষটির জন্ম বাংলাদেশে।
সুরের সন্ধানে ১০ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি জারি, সারি, বাউল, ভাটিয়ালি, কীর্তন, পাঁচালি প্রভৃতি গানের সাথে পরিচিত হন। এরপর কলকাতা গিয়ে সঙ্গীত সাধক গোপাল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য’র শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সাত বছর সাধনার পর কণ্ঠসঙ্গীত সাধনা ছেড়ে দিয়ে তিনি যন্ত্রসঙ্গীত সাধনায় নিজেকে নিমগ্ন হন। তিনি বাঁশি, পিকলু, সেতার, ম্যাডোলিন, ব্যাঞ্জু ইত্যাদি দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখেন। সেই সঙ্গে তিনি পাশ্চাত্য রীতিতে এবং দেশিয় পদ্ধতিতে বেহালা শেখেন। শেখেন মৃদঙ্গ ও তবলা । এভাবে তিনি সর্ববাদ্য বিশারদ হয়ে ওঠেন।
কিছু দিন তবলা বাদকের চাকরিও করেন। এরপর ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার জগৎ কিশোর আচার্যের আমন্ত্রণে তার দরবারে সঙ্গীত পরিবেশন করতে যান। সেখানে ভারতের বিখ্যাত সরোদিয়া ওস্তাদ আহমেদ আলী খাঁর সরোদ বাদন শুনে বিমোহিত হন এবং তার কাছে পাঁচ বছর সরোদে তালিম নেন। এরপর তানসেন বংশীয় সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর কাছে সরোদ শেখার জন্য রামপুর যান। সেখানে দীর্ঘ ৩০ বছর সঙ্গীতের অত্যন্ত দুরূহ ও সূক্ষ্ম কলাকৌশল আয়ত্ত করেন।
১৯১৮সালে ভারতের মাইহারের রাজা ব্রিজনাথ আলাউদ্দিন খাঁকে নিজের সঙ্গীতগুরুর আসনে অধিষ্ঠিত করেন। তিনি মাইহারে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। জীবনের একটা বড় অংশ শিক্ষার মধ্য দিয়েই অতিবাহিত করেন আলাউদ্দিন খাঁ ।
এরপর শুরু হয় তার কৃতিত্ব অর্জনের পালা। ১৯৩৫ সালে তিনি নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করের সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। তিনিই ভারতীয় উপমহাদেশের রাগসঙ্গীতকে সর্বপ্রথম পাশ্চাত্যের শ্রোতাদের কাছে পরিচিত করান, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি উদয় শঙ্কর পরিচালিত নৃত্যভিত্তিক ‘কল্পনা’ শীর্ষক একটি ক্ল্যাসিকধর্মী ছায়াছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেন।
সরোদে বিশেষত্ব অর্জন করেন। তিনি সরোদ বাদনে ‘দিরি দিরি’র পরিবর্তে ‘দারা দারা’ সুরক্ষেপণপদ্ধতি প্রবর্তন করেন। সেতার বাদনেও তিনি আমূল পরিবর্তন আনেন। এভাবে তিনি সঙ্গীত জগতে এক নতুন ঘরানার প্রবর্তন করেন, যা ‘আলাউদ্দিন ঘরানা’, ‘মাইহার ঘরানা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
আলাউদ্দিনের পরামর্শ ও নির্দেশে কয়েকটি নতুন বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবিত হয়। সেগুলোর মধ্যে ‘চন্দ্র সারং’ ও ‘সুর শৃঙ্খার’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি অনেক রাগ-রাগিনীও সৃষ্টি করেন। যেমন- হেমন্ত, দুর্গেশ্বরী, মেঘবাহার, প্রভাতকেলী, মেহ-বেহাগ, মদন মঞ্জুরী, মোহাম্মদ (আরাধনা), মানঝ খাম্বাজ, ধবল শ্রী, সরস্বতী, ধনকোশ, শোভাবতী, রাজেশ্রী, চন্দ্রিকা, দীপিকা, মলয়া, কেদার, ভুবনেশ্বরী প্রভৃতি ।
তিনি দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে অর্কেস্টার স্টাইলে একটি যন্ত্রিদল গঠন করে নাম দেন ‘রামপুর স্ট্রিং ব্যান্ড’। ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘খাঁ সাহেব’ উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারতের সঙ্গীত আকাদেমি পুরস্কার পান। ১৯৫৪ সালে তিনি ভারত সরকার কর্তৃক প্রথম সঙ্গীত নাটক আকাদেমির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে ‘পদ্মভূষণ’ ও ১৯৭১ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’ এবং ১৯৬১ সালে তিনি বিশ্বভারতী কর্তৃক ‘দেশীকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত হন। ভারতের দিল্লি ও বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে আজীবন সদস্যপদ দান করেন।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮/টিপু
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন