স্যার একেবারে কাঁদিয়ে ছাড়তেন: ডা. এজাজুল ইসলাম
আমি রংপুরের মফস্বল এলাকা থেকে এসেছি। মনেপ্রাণে অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছা ছিল। টেলিভিশন নাটকে কেউ কাজ করার সুযোগ আমাকে দিচ্ছিল না। বহুদিন চেষ্টা করে যখন টিভি নাটকে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছিলাম না, তখন মাথা থেকে অভিনয়ের ইচ্ছেটা ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিলাম।
স্যারের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৯৬ সালে। আমি তখন পিজি থেকে নিউক্লিয়ার মেডিসিনে পোস্ট গ্রাজুয়েশন শেষ করেছি। পিজি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন। আমাদের সনদপত্র সংগ্রহ করতে হলে ঢাবির চিকিৎসাবিদ্যা বিভাগের প্রধানের স্বাক্ষর লাগত। তখন বিভাগের প্রধান ছিলেন ডা. আব্দুল করিম। আমি একদিন সেখানে গিয়ে দেখি স্যার নেই। জানতে পারলাম তিনি হুমায়ূন আহমেদ স্যারের অফিসে গিয়েছেন। আমি কারণ জানতে চাইলে তারা বললেন, করিম স্যার আর হুমায়ূন স্যার স্কুল জীবনের বন্ধু।
সেদিন সনদপত্র ওঠানো জরুরি ছিল। আমি তখন গাজীপুর থাকি। গাজীপুরে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। সব মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, সরাসরি হুমায়ূন স্যারের অফিসে যাব। গিয়ে স্যারকে পেলাম। সেই সুবাদে হুমায়ূন স্যারের সঙ্গেও দেখা হলো। আমি কোথায় থাকি, কী করি স্যার জিজ্ঞেস করলেন। তারপর এক সময় বললেন, আমি তো শুটিংয়ের কাজে অনেক সময় গাজীপুর যাই, যদি আমাকে একটু হেল্প করো তাহলে ভালো হয়। আমি বললাম, স্যার অসুবিধা নেই। আপনি শুধু আমাকে জানাবেন।
ওই সময় মোবাইল ফোন আসেনি। ল্যান্ডফোনের যুগ। দেখা হওয়ার এক সপ্তাহ পর স্যার আমাকে ফোন দিলেন।
স্যার বললেন, আমি ‘সবুজ সাথী’ নামে একটা সিরিয়াল বানাবো তুমি আমাকে থাকার ব্যবস্থা করে দাও। আমি তখন সব ম্যানেজ করে দিয়েছিলাম। স্যার খুব খুশি হয়েছিলেন। তখন একদিন আমি স্যারকে বললাম, আমি তো একটু-আধটু অভিনয় করি। আপনার নাটকে যদি সুযোগ থাকে তাহলে একটু দেখবেন।
আরো জানালাম, বিটিভিতে নিজের যোগ্যতায় তালিকাভুক্ত হয়েছি কিন্তু তেমন কোনো কাজ পাচ্ছি না। আসলে এই অঙ্গনে সেভাবে আমার কেউ পরিচিত নেই।
স্যার খুব অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি অভিনয় পারো! সে কথা আগে বলোনি কেন?
স্যার আমার জন্য সেই নাটকেই ছোট্ট একটা দৃশ্য সংযুক্ত করলেন। এবং ভাগ্য ভালো যে, স্যার আমার প্রথম শটই খুব পছন্দ করলেন। বললেন, তুমি তো খুব ভালো অভিনয় করো।
সেই শুরু। এরপর স্যারের অনেক নাটকে অভিনয় করেছি। সিনেমায় অভিনয় করেছি। অভিয়ন যখন পছন্দ হতো, খুব সাদামাটাভাবে বলতেন- ভালো হয়েছে। আর যখন পছন্দ হতো না তখন যা বলতো তা সহ্য করা কঠিন হয়ে যেত। বিশেষ করে প্রথম দিকে এই সমস্যা বেশি হতো। স্যার একেবারে কাঁদিয়ে ছাড়তেন। ভেতরে ভেতরে রেগে যেতাম। খুব বেশি ধারে কাছে ঘেঁষতাম না। স্যার বুঝতে পারতেন। তিনি যে কাঁদাতেন সে বিষয়ে কোনো কথা বলতেন না, উল্টো বলতেন, আমি যাকে কষ্ট দেই তাকে সর্বোচ্চ কষ্টটাই দিতে চাই। এরপর থেকে স্যার যখন খুব বেশি রাগ করতেন, স্যারের প্রতি তত বেশি মায়া, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা বেড়ে যেত। বুঝতে পারলাম এই রাগের উৎস ভালোবাসা, আস্থা।
প্রথম যখন স্যারের অসুস্থতার কথা জানতে পারি, মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু মনে শক্তি ছিল, বার বার মনে হয়েছিল- স্যার ভালো হয়ে উঠবেন। কিছু দিন যাবার পর আমি বুঝে গেলাম স্যারকে বাঁচানো সম্ভব হবে না!
বিদেশে চিকিৎসা চলাকালীন তিনি একবার দেশে এসেছিলেন। অবস্থান করছিলেন নুহাশ পল্লীতে। রান্না করা ইলিশ মাছ নিয়ে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে যাই। স্যার মনে করতেন, আমি দেখে শুনে বুঝে খুব ভালো ইলিশ কিনতে পারি।
নুহাশ পল্লীতে স্যারের সঙ্গে কথা হলো- সেখানে স্যারের মা উপস্থিত ছিলেন। তার সঙ্গেও কথা হলো। স্যার শারীরিক অবস্থার কথা জানালেন। খালাম্মা আমাকে প্রশ্ন করলেন, ডাক্তার তোমার কি মনে হয়? ও কি বাঁচবে?
পৃথিবীর যে কোনো মা একজন ডাক্তারকে এই প্রশ্ন করলে তিনি যে উত্তর দিতেন আমিও তাই দিলাম। বললাম, হ্যাঁ খালাম্মা সব ঠিক হয়ে যাবে।
তারপর আবার একদিন খুব ভোরে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে নুহাশ পল্লীতে গেলাম। সেদিন শিংমাছ রান্না করে নিয়ে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি নুহাশের লোকজন কিছু গাছ ছাঁটাই করছে, স্যার সেগুলো বসে বসে দেখছেন। আসলে আমি স্যারের সামনে খুব কম বসতাম। দাঁড়িয়েই কথা বলতাম। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে স্যারের সঙ্গে কথা বলছিলাম। একটু পর স্যার উঠে গেলেন। যেতে যেতে বললেন, ডাক্তার নাস্তা করে যাবে কিন্তু
আমি শুধু বললাম, জি আচ্ছা।
সেই ছিল স্যারের সঙ্গে শেষ কথা। শেষবারের মতো আমি স্যারকে হেঁটে যেতে দেখলাম।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ জুলাই ২০১৭/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন