ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

হার না মানা কুষ্টিয়ার ৫ নারী

কাঞ্চন কুমার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৭ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হার না মানা কুষ্টিয়ার ৫ নারী

সেলিনা খাতুন, ফারজানা ববি, ফিরোজা বেগম, আলিয়া খাতুন, আনোয়ারা খাতুন

কাঞ্চন কুমার, কুষ্টিয়া : দারিদ্রর কাছে  হার মানেননি কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ৫ নারী।দারিদ্রর বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জনের জন্য এই ৫ নারী পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা । নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য তারা এখন কর্মসংস্থানে সাহসী নারীর দৃষ্টান্ত ।

সেলিনা খাতুন : তারা ৫ বোন, কোন ভাই নেই ।পিতার অস্বচ্ছলতার কারণে কোনভাবে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শেষে সেলিনা খাতুনের বিয়ে হয় গোড়ারপাড়া গ্রামের এক দরিদ্র বেকার যুবকের সাথে। তাদের অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটতে থাকে। এরই মাঝে তাদের সংসারে আসে দু’কন্যা। অভাব যেন আরও তীব্র হয়। শেষে নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রত্যয় নিয়ে সেলিনা খাতুন সরকারি একটি সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে গরু পালন শুরু করে।

প্রথমে একটি, পরে দু’টি এভাবে সে গড়ে তুলে গরুর খামার। এখন তার খামারে ১২ টি গরু রয়েছে। আর্থিকভাবে সে এখন স্বাবলম্বী। স্বামী রাজু আহমেদকে নিজ অর্থে বিদেশ পাঠিয়েছেন। দুই মেয়েকেও পড়া লেখা করাচ্ছেন। বড় মেয়ে এবার এসএসসি পাশ করে কলেজে পড়ছে। ছোট মেয়ে পড়ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া এই নারী শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে নিজেকে আজ একজন সফল নারী হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা।

ফারজানা ববি : ফারজানা ববির ডাক নাম লিনা। দরিদ্র বাউল শিল্পী শফি মন্ডলের ৩ কন্যার মধ্যে ফারজানা ববি সবার বড়। প্রমত্তা পদ্মার করালগ্রাসে ৩ বার বাড়ি ভেঙ্গে সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়া শফি মন্ডলের মাথা গোঁজার শেষ ঠাঁই হয় হোসেনাবাদ এলাকায়। এখান থেকেই ফারজানা ববি’র বেড়ে ওঠার সংগ্রাম শুরু। এসএসসি পাশের পরই বাবা শফি মন্ডল তার বিয়ে দেন। তারপরও থেমে থাকেনি ফারজানা ববি’র পড়ালেখার সংগ্রাম।

সংসারে কাজকর্ম শেষে পরিবারের সকলকে ম্যানেজ করে নিজ উদ্যোগে পড়া লেখা করে এইচএসসি পাশ করে সে। একইভাবে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন । শিল্পী পরিবারে জন্ম হওয়ার সুবাদে সংগীত চর্চাও চালিয়ে যাচ্ছেন। শিল্পি হিসেবেও পেয়েছেন জাতীয় সম্মান। বর্তমানে দৌলতপুর অনার্স কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক । পাশাপাশি আরও একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপাধ্যক্ষ’র দায়িত্ব পালন করছেন। অদম্য ইচ্ছা আর আত্মপ্রত্যয় থাকলেই যে অসম্ভবও সম্ভব করা যায় তারই উজ্বল দৃষ্টান্ত তিনি। শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে অবদান রাখায় পেয়েছেন জয়িতার সম্মাননা।

ফিরোজা বেগম : মথুরাপুরের মধ্যবিত্ত স্কুল শিক্ষকের ঘরে জন্ম ফিরোজা বেগমের। লেখাপড়া শিখে বড় হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু এসএসসি পাশের পর তার বিয়ে দেওয়া হয়। তারপরও থেমে থাকেনি তার ইচ্ছা। বিয়ের পরও অতিকষ্টে এইচএসসি পাশ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়োগ করেন । জন্ম হয় ৩ সন্তানের।

নিজে পড়ালেখায় বেশিদুর এগুতে না পারলেও নিজ সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। বড় ছেলে ভেড়ামারা কলেজে শিক্ষকতায় রয়েছেন, মেজ ছেলে সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা এবং ছোট ছেলে একটি বিদেশি কোম্পানিতে কর্মরত।  নিজে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকলেও নিজ সন্তানদের ফিরোজা বেগম উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে নিজের ইচ্ছা শক্তির বিকাশ ঘটিয়েছেন। ফিরোজা বেগম আজ একজন সফল জননী। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা।

আলিয়া খাতুন :  মহিষকুন্ডি গ্রামের দিনমজুর বাবার ঘরে জন্ম নেওয়া আলিয়া খাতুন ছোট থাকতেই বাবাকে হারান। তার দায়িত্ব বর্তায় বড় ভাইয়ের ওপর। অতিকষ্টে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার পরই বিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে নেমে আসে চরম অশান্তি।চলে নির্যাতনের বিভীষিকা।স্বামীর নির্যাতন ও অত্যাচার সহ্য করেও টিকেছিলেন ৭ বছর।এর পর ১৩ মাসের  সন্তানকে নিয়ে স্বামীর ঘর ত্যাগ করেন। আবারও ভাইয়ের সংসারে আশ্রয় নিয়ে নিজেকে গড়ে তোলার সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। নিজের অর্জিত বিদ্যা ও বুদ্ধি দিয়ে শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার পাশাপাশি নিজেও এসএসসি পাশ করে ব্র্যাক স্কুলে চাকরি নেন । সেখানেও কাটিয়ে দেন ১৪ বছর। এখন বেসরকারি সংস্থা শিশু বিকাশ কেন্দ্রে কর্মরত আছেন। তার একমাত্র সন্তানটি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। নিজের আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাব আর প্রবল মনোবলে একটি নিশ্চিত জীবনের দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন আলিয়া খাতুন।  সম্মাননা পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ জয়িতার ।

আনোয়ারা খাতুন : দৌলতপুরের ধর্মদহ গ্রামের অশিক্ষিত কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া আনোয়ারা খাতুন নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে এসএসসি পাশ করেন। এরপর তার বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পর স্বামীর ঘরে পড়ালেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন । কিন্তু সমাজের কুসংস্কার ও  নানাক্ষেত্রে নারীদের বঞ্চনা- লাঞ্ছনার বিষয়টি তার মনে সর্বদা পীড়া দিতে থাকে। একপর্যায়ে একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে সমাজের কুসংস্কার, বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, যৌতুকসহ নানা বিষয়ে সমাজ সচেতনতামূলক কাজ করার সুযোগ হয় তার। আর এসব কাজ করে নারীদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হন আনোয়ারা খাতুন। এখন তিনি নারীদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করে নিজেকে করেছেন একজন আলেচিত নারীতে পরিনত করেছেন। নির্বাচিত হয়েছেন শ্রেষ্ঠ জয়িতা।

 

 

 

রাইজিংবিডি/কুষ্টিয়া/১৭ জুলাই ২০১৭/কাঞ্চন কুমার/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়