ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

হায় হায় একি করলাম!

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৫, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হায় হায় একি করলাম!

(ভিয়েতনামের পথে: ১২তম পর্ব)

ফেরদৌস জামান: কাঠ ও ইট-পাথরে নির্মিত কোর্ট ভবন। ক্ষুদ্র ভবন এবং চত্বরে জনাকয়েক মানুষের আনাগোনা। হাতে গুনলে পাঁচ থেকে সাত জনের অধিক হবে না। গলির মাথায় গিয়ে মন চাইল বাম দিকে যাব, তাই ওদিকটায় যাওয়া। রাস্তার পাশে একটা  দুটো দোকান। ঘণ্টাদুই পর বাজার জমে উঠবে। এরই মধ্যে পর্যটক সমাগম বাড়তে শুরু করেছে। আমরা এগিয়ে চললাম আপাতত পথ যেদিকে নিয়ে যায়।

একটা অংশে কিছু দোকানের বিক্রেতাগণ হিজাব-বোরখাআবৃত। দুএকজন পুরুষের মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি। এটি ছোট্ট পাইয়ের মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা হয়ে থাকবে। হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। পাশেই সাদা তোরণ, তাতে লেখা আল ইসরা মস্ক। তার নিচেই ঝুলছে মৃত রাজার ছবি ও শোক বাণী সংবলিত কালো রঙের কাপড়। তোরণ পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে একটা প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণের ঐ মাথায় সুন্দর করে গড়ে তোলা ধবধবে সাদা আল ইসরা মসজিদ ভবন। পেছন থেকে দৃশ্যমান হয়ে আছে কালো মেঘের মত পাহাড় সারি। খোলা প্রাঙ্গণে কঁচিকাচাদের ছোটাছুটি আর খেলাধুলা চলছে। নেতা গোছের মুরব্বীর মখোমুখি হতেই একটা সালাম দিলে তার যা অনুমান করার তা করে নিলেন এবং পাশেই মুসলমানদের রেস্টুরেন্ট আছে; চাইলে আমরা সেখানে হালাল খাবার গ্রহণ করতে পারি বলে অবহিত করলেন। শহরের রূপ দেখছি আর মুগ্ধ হচ্ছি। ছিমছাম আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। হেন রাস্তা নেই যার ধারে ফুল বা পাতাবাহার গাছ নেই। অচেনা সব ফুল ফুটে রয়েছে। ফুটপাতের কোনো কোনো বৃক্ষের কাণ্ডে অথবা ডালে টব থেকে তুলে দেয়া হয়েছে পাতাবাহারের সুদৃশ্য লতা। বাহণের চেয়ে পায়ে হাঁটা পর্যটকের সংখ্যাই অধিক। যানবাহণ বলতে স্কুটি। এটা তাদের দৈনন্দিন কাজের প্রধান অবলম্বন। নির্বিঘ্নে স্কুটি চলছে। নিয়ন্ত্রণের জন্য এখানেও কোনো পুলিশ নেই, সংকেত বাতিতেই দিব্যি চলমান। আর পথচারীর বেলায় ফুটপাত ছেড়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে এমন লোক বিরল।



হঠাৎ চোখ আটকে যায় পথের ধারের দোকানটায়। বৃন্তের পর শুকে ঝনঝনে হয়ে যাওয়া পাতাগুচ্ছের ডগায় হলুদ বর্ণের ফল। দেখতে যেমন সুন্দর খেতেও বড় স্বাদের! দোকানি কেবল দোকান বসানোয় ব্যস্ত। আগ্রহ নিয়ে দেখতে গেলে বলল, একটা খেয়ে দেখতে পারি। ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই অমনি একটা তুলে মুখে দেই। এবার বোধহয় এক ঠোঙ্গা কেনা দরকার। হায় হায় একি করলাম! বলা মাত্রই টুপ করে মুখে দেয়ার কি ছিল! না দিলে তো অহেতুক এই ভাবনায় পড়তে হতো না? দোকানি নিজ থেকেই পরিস্থিতি আন্দাজ করে নিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন, সমস্যা নেই ভালো লাগলে পরে নিবেন। আমরা সাধারণত এমন পরিস্থিতিতে মন না চাইলেও কখনও কখনও বাধ্য হয়ে আধা কেজি, এক কেজি কিনি অথবা কায়দা করে কেটে পড়ি। পেছন থেকে দেকানি মুখ ভেঙচে দুএকটা ইচ্ছামাফিক মন্তব্য করলেও ভ্রুক্ষেপ করি না। এরা সম্পূর্ণ ভিন্ন। খদ্দের এলে প্রথমে মিষ্টি করে হাসি দেয়া তাদের সংস্কৃতি। ওদিকে আমাদের তো দিনটাই শুরু হয় বিষাদ, বিরক্ত আর অশ্রদ্ধা দিয়ে। দোকানগুলোতে গেলে এমন আচরণ করে যেন মাগনা জিনিস নিতে যাওয়া হয়েছে। আর অফিস আদালতের কথা তো বলাবাহুল্য। আগন্তুক দেখলে চোখে-মুখে এমন নকশা ফুটিয়ে তোলে যেন সকাল সকাল খামাখা মাথাটা চিবিয়ে খেতে এসেছি কেন!

অনুচ্চ প্রাচীরের ওপারে মন্দির পেছনে রেখে বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন সুউচ্চ মূর্তি। সোনালি রং করা মূর্তির নিচে দুই পাশে দুটি ড্রাগন মূর্তি। এছাড়াও, উভয় পাশে একাধিক ভিক্ষু-শ্রমন মূর্তি। যেন বৌদ্ধের গভীর ধ্যান সাধানায় তারা পাশে থেকে সশ্রদ্ধ পাহারারত। প্রবেশ দ্বারের পরে একেবারে পেছন দিকটায় চেয়ার-টেবিল এবং মাদুর-বিছানা গোটানোর কাজ চলছে। বোধহয় কোনো প্রার্থনা অনুষ্ঠান এবং অনষ্ঠান পরবর্তী সময়ে ভোজন শেষ হলো মাত্র। লোকজনও প্রায় বিদায় হয়েছে। প্রাঙ্গণজুড়ে যেন এখনও বিরাজ করছে প্রার্থনার ওম ধ্বানির রেশ! দু’চারজন এখনও যারা বিদায় হয়নি প্রার্থনার সার্থকতায় তাদের চোখেমুখে পরম তৃপ্তির ছবি স্পষ্ট। এই হালকা ভিড় আর আবহের মধ্যে এখন আমরাও যুক্ত হয়ে গেছি এবং পারিপার্শ্বিকতা অনুভব করার প্রচেষ্টা চালালাম। তেঁতুল গাছের মত পুরনো বৃক্ষ ছায়া দিয়ে শীতল করে রেখেছে কোণার বড় অংশটাকে। ঠিক তার পাশে একাধিক ক্ষুদ্রকৃতির মঠবেষ্টিত সাদায় সোনালি কারুকাজের সুউচ্চ মঠ। কি ভীষণ পবিত্রতা এর চারপাশ ঘিরে! কেউ টু শব্দটিও করছে না। প্রশস্ত ভিত্তির উপর দাঁড়ানো মঠ উপরে উঠে যেতে যেতে শীর্ষে গিয়ে এক সরু বিন্দুতে শেষ হয়েছে। সেই বিন্দু চুয়ে যেন অনবরত নেমে আসছে প্রকৃতি নিংড়ানো শান্তির ওম!



যেদিকে পথ নিয়ে যাচ্ছে আমরা এখনও সেদিকটাতেই আছি। মন্দির থেকে বেরিয়ে কিছুদূর হেঁটেই  বাজারের শুরু। পাশেই পৌর ভবন। ভবনের নিকটে নির্ধারিত স্থানকে কেন্দ্র করে বাজার তার শাখা-প্রশাখা মেলে দিয়েছে আশপাশের সমস্ত রাস্তায়। কত রঙের শাকসবজি আর ফলমূল তার ঠিক নেই। সবুজ রঙের ফলগুলো না পেয়ারা, না লেবু তবে কি হতে পারে! আবার এক টুকরো সাদা কাগজে কালো কালিতে ৭০ বাথ প্রতি কেজি লিখে সামনে রেখে দেয়া। আমাদের নাড়াচাড়া দেখে পাশ থেকে একজন এসে নিজ থেকেই বলে দিল- এ্যাবোক্যাডো। আরও বলে দিল কোনগুলো পরিণত বা পাকা। কারণ কতক্ষণ পর খাব সেই হিসেব করে কেনা বুদ্ধিমানের কাজ। হঠাৎ এমন উপকারে আমরা তো ধন্য। ফরাসি এই নারীর সাথে তার থাই বন্ধুটিও আছে। কয়েক কথায় জানা যায় বেশ কিছু দিন পাই-এ অবস্থান করছে আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে এখানকার বিস্তারিত। আজও কিছু শাক-লতা এবং সবজি কিনেছে। ঘরে ফিরে মনের মাধুরি মিশিয়ে রান্না করে খাবে। প্রতিদিন তারা পথে প্রান্তরে যা খাদ্য সামগ্রী পায় এক এক করে তার স্বাদ নিতে এতটুকুও কার্পণ্য করে না। বোশিরভাগ জিনিসপত্রের দোকানে দামদরের প্রয়োজন পড়ে না। নারী-পুরুষের ভেদাভেদ যে খুব একটা নেই তা বোঝা যায় দোকানগুলোতে বিক্রেতা হিসেবে তাদের সম উপস্থিতি দেখে। এই কাজে পুরুষের তুলনায় বরং নারীর সংখ্যাই বেশি। পারিবারিক বা সামাজিকভাবে অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণে নারীদের অবস্থান যে অনগ্রসর ও পশ্চাদপদ অবস্থায় নেই সে বিষয়টি স্পষ্ট প্রতিয়মান। মাছ এখানে সহজলভ্য নয়। মাছের দোকান নেই বললেই চলে। কিছু দোকানে মাছের গ্রীল বিক্রি হচ্ছে তবে সংখ্যায় তা হাতে গোনা। তেলাপিয়া ও রঙ্গিন কার্প ছাড়া অন্য কোনো প্রজাতির মাছ নেই। গরম শিকের ট্রের উপর আংটা দিয়ে আটকানো মাছ মৃদু আঁচে রান্না হচ্ছে। মসলাপাতি বলতে হলুদ-মরিচ নয় আটার মত সাদা কিছু মাখানো। তার ভেতর দিয়েও মাছের আসল রং পরিষ্কার দৃশ্যমান। কোন কোনটার পেট ফেড়ে তাতে কলাপাতায় মোড়ানো কিছু একটা ঢুকিয়ে দেয়া। প্রস্তুত প্রণালী আর মূল্য দেখেই বোঝা যায় এ অনেক উঁচু দরের খাবার!



এদিকে রাতের স্ট্রীট মার্কেট জমে উঠেছে কোর্ট ভবনের সামনের সড়কটায়। এটা মূলত খাবারের বাজার। স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী খাবারের পাশাপাশি রয়েছে পাশ্চাত্যের খাবার। রাস্তার উভয় পাশে একটার পর একটা অস্থায়ী দোকান। ঠিক তার পেছন দিয়ে স্থায়ী দোকানপাট। ছোট ছোট অনুজ্জ্বল অথচ বর্ণিল আলোয় ভরে গেছে পুরো এলাকা। পথচারী প্রত্যেকের হাতেই কোন না কোন খাবার। অল্প দূরত্ব পরপর বার ও রেস্টুরেন্টে জমে উঠেছে আলো-আঁধারির খেলা। প্রতিটা দলে কয়েক জন করে গোল হয়ে বসে গল্প-আড্ডায় মাতিয়ে তুলেছে। সামনে ফ্যানা ওঠা একেকটা বিয়ারের গ্লাস। কোনো দোকানেই উপচে পরা খাবার নয়, একেবারে পরিমাণ মত। যার বিক্রি শেষ সে সুন্দর মত পাততাড়ি গুটিয়ে এ বেলার মত বিদায় হচ্ছে। এ পথে সন্ধ্যার পর যানবাহণ নিষেধ। অতএব, ইচ্ছা মত ঢলাঢলি করে যে যেমন পারে আনন্দময় সময় উপভোগ করছে। তবে সবকিছুতে এক পরিশীলিত রূপ বিরাজমান, তা কখনও সীমা লঙ্ঘন করে অসুন্দর হয়ে উঠছে না। এক কোণে ফুটফুটে শিশুরা ঐতিহ্যবাহী লাল-কালো আর ঝালোর পোশাকা পড়ে ঠান্ডা সুরে অনবরত নৃত্য পরিবেশন করছে। নৃত্যের চেয়ে বরং সুন্দর পোশাকে নিজেদের উপস্থাপনটাই বেশি আকর্ষণীয়। পোশাকের ধরন দেখে অনুমান করা যায় তারা মুসলমান সম্প্রদায়ের সন্তান। সামনে একটা বাক্স রাখা। মুগ্ধ পথিক চাইলে দু’চার বাথ রেখে যাচ্ছে। আবার কেউ এসে কাছে ভিড়ে আদর-সোহাগ করে বিদায় নিচ্ছে। কেউ কেউ তাদের সাথে নানা ভঙ্গি করে ছবি তুলছে।

(চলবে)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়