হেমন্তের বিকেলে লক্ষ্মীকুঞ্জে নায়করাজ
নায়করাজ রাজ্জাক
খান মোঃ শাহনেওয়াজ : রাজধানী ঢাকার গুলশান এলাকায় আজাদ মসজিদের কাছেই লক্ষ্মীকুঞ্জ। এটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অন্যতম দিকপাল নায়করাজ রাজ্জাকের বাসভবন। এখানেই প্রথম দেখা হয়েছিলো নায়করাজের সঙ্গে।
১৯৮০-এর দশকের একেবারে শুরুর দিকের কথা। গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে ঢাকায় এসে কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছি। থাকি রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের পাশেই, গুলশান লেকের অপর পাড়ে দক্ষিণ বাড্ডায়। তখন এই বাড্ডা এলাকা বলতে গেলে একেবারে ঢাকার বাইরের একটি এলাকা ছিলো এবং যানবাহন সংকটে চলাচল করা খুব কষ্টের ছিলো। কলেজে যাতায়াতের প্রয়োজনে ফোনিক্স ব্র্যান্ডের (চায়না ফোনিক্স) একটা নতুন বাই-সাইকেল পেয়েছি। সাইকেলে কলেজে যাতায়াত করি। সেই সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় মডেলের নতুন সাইকেল, চালানোর শখও অনেক; প্রায় প্রতিদিনই বিকেলে সাইকেল নিয়ে ঘুরতে বের হই।
ইট বিছানো সংকীর্ণ একখানা রাস্তা দক্ষিণ বাড্ডা থেকে গুলশানে তালতলায় গিয়ে মিশেছে। সেই পথ ধরে সাইকেলে চলে যাই গুলশানে। গাছপালা সমৃদ্ধ, মনোরম ও নিরিবিলি আবাসিক এলাকা গুলশান; এ রাস্তা - ও রাস্তা, এ গলি - ও গলি ঘুরে সন্ধ্যায় দক্ষিণ বাড্ডায় বাসায় ফিরি।
গুলশান-১ ও গুলশান-২ নম্বরের প্রায় মাঝামাঝি আজাদ এলাকায় ৩৬ নম্বর সড়কে অবস্থিত লক্ষ্মীকুঞ্জ। বাড়ি নম্বর ৫, ছিমছাম সুন্দর দু’তলা বাড়ি। চিত্রনায়ক রাজ্জাকের বাড়ি, তাই এটি এখানে অত্যন্ত পরিচিত।
সাইকেল চালাতে গিয়ে লোকমুখে শুনে আমিও চিনে ফেলি নায়করাজের বাড়ি। ফটকের বাইরে পিতলের নামফলকে লেখা লক্ষ্মীকুঞ্জ। বাড়িটির প্রতি সকলের শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রকাশ পায়- এটাও বুঝে ফেলি।
হেমন্ত ঋতুর মাঝামাঝি সময়ে কোন এক সুন্দর বিকেল। আমি ধীর গতিতে সাইকেল চালিয়ে লক্ষীকুঞ্জের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখি গেট বেশ ফাঁক করা, ভেতরটা দেখা যাচ্ছে। আমি সাইকেল থামালাম এবং গেটের ফাঁক দিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করলাম এই আশায়, যদি চিত্রনায়ক রাজ্জাককে একনজর সামনে থেকে দেখা যায়।
এক পর্যায়ে সাইকেল থেকে নেমে সাইকেল ঠেলে একটু এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে পেলাম নায়করাজ বসে আছেন বেতের চেয়ারে, সামনে ছোট একটা কাঠের টুল।
আমার উঁকি দেওয়াটা তার চোখে পড়ায় তিনি জোড়েই জিজ্ঞেস করলেন, কে ওখানে ?
আমি সাইকেল ঠেলে আর একটু এগিয়ে জবাব দিলাম, আমি।
এবার আমায় পুরোপুরি দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কে তুমি, কি কর ওখানে, কি চাও?
আমি জবাব দিলাম, আপনাকে দেখছি, এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, গেটের ফাঁক দিয়ে আপনাকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়েছি, আপনাকে দেখছি।
তিনি হেসে দিলেন এবং বললেন, এসো ভেতরে এসো। এরপর তিনি অন্য কারও খোঁজ করলেন (সম্ভবত তত্ত্বাবধায়ক বা দারোয়ান)।
আমি গেট আরেকটু ফাঁক করে সাইকেল নিয়েই ভেতরে ঢুকলাম, গেট চাপিয়ে দিয়ে স্ট্যান্ডের ওপর সাইকেল দাড় করিয়ে নিজেও দাড়ালাম। তিনি আমাকে আপাদমস্তক দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় থাকো, কিসে পড়ো।
আমার জবাব পেয়ে তিনি বললেন, কাছে এসো।
আমি কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, একেবারে সামনে।
তিনি চোখের ইশারায় সামনের টুল দেখিয়ে আমায় বসতে বললেন।
ততক্ষণে আমার দেহে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। আমি গ্রাম থেকে কিছুদিন আগে ঢাকায় আসা এক কিশোর এবং নায়করাজ রাজ্জাকের সামনে দাড়ানো …।
আমার এই স্নায়বিক দুর্বল অবস্থা বা ভীতির বিষয়টি সম্ভবত তিনি খেয়াল করলেন। মিষ্টি হেসে টুল দেখিয়ে স্নেহের স্বরে বললেন, বোসো এখানে; ইজি হয়ে বোসো।
আমি বসলাম এবং স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম। একটু সময় নিয়ে তিনি আমার কথা জানতে চাইলেন। সায়েন্স নিয়ে পড়ছি কিনা, গ্রামের নাম কি, কোন থানা, মহুকমা ও জেলা, স্কুলের নাম, স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নাম, এলাকায় ক্লাব আছে কিনা, স্কুলে বা ক্লাবে নাটক হয় কিনা, কখনও অভিনয় করেছি কিনা, বাবার নাম, বাবা কি করেন, ভবিষ্যতে কি হওয়ার ইচ্ছা - এগুলো জিজ্ঞেস করলেন এবং আমি জবাব দিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছি কিনা, কোন কোন সিনেমা দেখেছি, আমার গ্রামের বাড়ির কাছের শহরে কয়টি সিনেমা হল আছে সেটা জানি কিনা।
তিনি আরো জিজ্ঞেস করলেন, তার অভিনয় করা কোন সিনেমা দেখেছি কিনা।
আমি হ্যাঁ সূচক জবাব দেওয়ায় তিনি ছবির নাম জানতে চাইলেন।
কিন্তু নায়করাজের সামনে বসে তার অভিনীত কোন ছবির নাম তাৎক্ষণিকভাবে আমি মনে করতে পারিনি এবং বলতে পারিনি।
সিনেমায় তার যে অভিনয় দেখেছি সেগুলোর কিছু মনে আছে কিনা - সেটা তিনি জানতে চাইলেন।
আমি তার অভিনয়ের দৃশ্যের কিছু কিছু বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
তিনি শুনেছেন, উপভোগ করেছেন এবং অসম্ভব সুন্দর করে হেসেছেন।
কথা আরো কিছু হয়েছে তবে খুব বেশি সময় নয়, এরই মধ্যে অতিথি কেউ একজন এসে ভেতরে ঢুকলেন।
নায়করাজ আমায় বললেন, বাসায় এখন কেউ নেই, তোমায় জল-মিঠাই কিছু দিতে পারলাম না। মেহমান এসেছে, তুমি যাও, বেলা শেষ হয়ে এলো, বাড্ডায় যাবা, সেটা দূরেই তো। এদিকে এলে আবার এসো। গেটে লোক আছে, তাকে বলো আমার কথা। গ্রাম থেকে এসেছো উন্নতির জন্য, ভালোমতো পড়ালেখা করো। যা হওয়ার ইচ্ছা তার জন্য চেষ্টা করো।
আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথাগুলো শুনলাম এবং বললাম, দোয়া করবেন আমার জন্য। একদিন বেড়াতে আসবেন আমাদের বাসায়, বেড়াতে যাবেন আমাদের গ্রামের বাড়িতে।
তিনি আবারও মিষ্টি করে হাসলেন এবং অতিথির প্রতি নজর দিলেন।
আমি তাকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে এলাম সাইকেল নিয়ে। গেট ফাঁক করে আমায় বের হতে সাহায্য করলেন মাঝবয়সী এক ব্যক্তি; সম্ভবত তিনি দারোয়ান অথবা বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক।
রাস্তায় নেমে মনে হলো, সাইকেল চালানোর মত শক্তি আমার নেই। মনের ভেতরে একটা উত্তেজনা; চিত্রনায়ক রাজ্জাক, এতবড় একজন মানুষ, আমার মত একজন ছেলেকে কাছে ডেকে নিয়েছেন, বসিয়েছেন, কথা বলেছেন ...!
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ আগস্ট ২০১৭/শাহনেওয়াজ
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন