ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

২০১৭ সালের সবচেয়ে যুগান্তকারী ক্যানসার গবেষণা

এস এম গল্প ইকবাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৭, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
২০১৭ সালের সবচেয়ে যুগান্তকারী ক্যানসার গবেষণা

প্রতীকী ছবি

এস এম গল্প ইকবাল : ক্যানসার নির্ণয়, ক্যানসারের চিকিৎসা ও ক্যানসার প্রতিরোধে আমরা দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। বিগত বছরসমূহের ন্যায় ২০১৭ সালেও ক্যানসারকে জয় করার জন্য বিজ্ঞানের প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল।

২০১৭ সালে বেশ কিছু যুগান্তকারী ক্যানসার গবেষণা করা হয়েছে। এর ফলে আমরা পূর্বের তুলনায় আরো অধিক জীবনকে ক্যানসারের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হব।

১. ইমিউনোথেরাপিতে অগ্রগতি
বিজ্ঞানীরা ক্যানসার রোগ নির্মূল করার জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ক্যানসার এমন রোগ যা শরীরে অস্বাভাবিক কোষের বৃদ্ধি ঘটায় এবং শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। গতবছর যুক্তরাষ্ট্রে ১,৬৮৫,০০০ জন লোকের মধ্যে ক্যানসার ধরা পড়ে এবং ৬০০,০০০ জন লোক মারা যায়। ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য এখনো পর্যন্ত স্ট্যান্ডার্ড থেরাপিসমূহ হচ্ছে সার্জারি, কোষ হত্যা করতে রেডিয়েশন এবং কেমোথেরাপি, যা ক্যানসার কোষের পুনরুৎপাদন থামাতে ক্যানসার কোষের ডিএনএ পরিবর্তন করে। কিন্তু রেডিয়েশন এবং কেমো সুস্থ কোষেরও ক্ষতি করে, তাই গবেষকরা আরো ভালো চিকিৎসার জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। নতুন ইমিউনোথেরাপি ড্রাগ ক্যানসারকে আক্রমণ করতে রোগীর নিজস্ব ইমিউন কোষ ব্যবহার করে। ডিভিশন অব অনকোলজি এবং ডিভিশন অব পিডিয়াট্রিক অনকোলজির প্রধান এবং চিলড্রেন’স হসপিটাল অব ফিলাডেলফিয়ার সেন্টার ফর চাইল্ডহুড ক্যানসার রিসার্চের পরিচালক স্টিফেন হাঙ্গার বলেন, এ বছর দুইটি ইমিউনোথেরাপি চিকিৎসা অনুমোদিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এদের একটি হচ্ছে ইনোটিউজুম্যাভ যা লিউকেমিয়া কোষ শনাক্ত করতে অ্যান্টিবডি ব্যবহার করে এবং বেছে বেছে এসব কোষে টক্সিন প্রদান করে, যার ফলে স্ট্যান্ডার্ড কেমোথেরাপি ড্রাগের তুলনায় অনেক কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তাদের হত্যা করা যায়। অন্য কার্যকরী নতুন থেরাপি হচ্ছে একটি ড্রাগ, যাকে ব্লিনাটিউমোম্যাব বলে। এই ড্রাগটি মূলত টি-কোষকে অপকারী বি-কোষের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটানোর একটি লিংক হিসেবে কাজ করে, যা তাদেরকে লিউকেমিয়া কোষকে হত্যা করার জন্য সক্ষম করে।’

২. প্রথমবার জিন থেরাপি
২০১৭ সালের সবচেয়ে বড় ক্যানসার ব্রেকথ্রো বা আবিষ্কার হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) অনুমোদিত প্রথম জিন থেরাপি ড্রাগ, যা চিলড্রেন’স হসপিটাল অব ফিলাডেলফিয়া এবং ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়াতে ডেভেলপ করা হয় অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়ায় (এএলএল) আক্রান্ত অল্প বয়সি ছেলেমেয়েদের চিকিৎসার জন্য (যখন অন্য সব চিকিৎসা ব্যর্থ হয়)।

ডা. হাঙ্গার বলেন, ‘সিএআর টি-সেল থেরাপি রোগীর শরীর থেকে সুস্থ টি-কোষ তুলে ফেলার সঙ্গে জড়িত এবং তাদেরকে জেনেটিক্যালি মডিফাই করা হয়। ক্যানসার শণাক্ত করার জন্য তাদেরকে রিপ্রোগ্রামিং করার পর রোগীর শরীরে পুনরায় সংযোজন করা হয় এবং তারা সারা শরীরে ঘুরে বেড়ায় ও ক্যানসার কোষকে খুঁজে, আক্রমণ করে ও হত্যা করে।’ দীর্ঘমেয়াদে কাজ করার জন্য টি-কোষ পুনরুৎপাদনও করে। ডা. হাঙ্গার এর ফলাফলকে ‘উল্লেখযোগ্যভাবে কার্যকর’ বলেছেন। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ৮৩ শতাংশ রোগী তিন মাসের মধ্যে উপশম লাভ করে এবং তাদের অর্ধেক দুই বছর পরও সুস্থ থাকে। ডা. হাঙ্গার বলেন, ‘এটিও উল্লেখযোগ্য যে, পুনরায় অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া ফিরে আসা কিংবা দুরারোগ্য অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত ১০ থেকে ২০ শতাংশের কম শিশু স্ট্যান্ডার্ড থেরাপি নিয়ে দুই বছর পরও জীবিত ছিল।’

জিন থেরাপির উচ্চ জ্বরের মতো কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, তাই এ বিষয়ে আরো কাজ করার প্রয়োজন আছে। এ প্রসঙ্গে ডা. হাঙ্গার বলেন, ‘চিকিৎসকরা কিভাবে অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত শিশু, কিশোর ও তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের চিকিৎসার জন্য থেরাপির টুলবক্সের সঙ্গে এটির সমন্বয় করবেন তা বোঝার দিকে নতুন প্রচেষ্টা নির্দেশিত।’

৩. আরো জিন থেরাপি
একদিকে কিছু গবেষক পিডিয়াট্রিক ক্যানসার অথবা শিশু বা অল্পবয়সি ছেলেমেয়দের ক্যানসার নিরসনের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে অন্য গবেষকরা ক্যানসারে আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন লিউকেমিয়ায় ভুক্তভোগীদের জন্য যেমন জিন থেরাপির অনুমোদন দিয়েছে, তেমনি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও (বিশেষ করে নন হজকিন-লিম্ফোমায় আক্রান্ত ব্যক্তি) জিন থেরাপির অনুমোদন দিয়েছে।

প্রাপ্তবয়স্কদের জিন থেরাপির এই চিকিৎসাও প্রথম জিন থেরাপির মতো কাজ করে- টি-কোষ অপসারণ করা হয় এবং ক্যানসার কোষ খুঁজতে, ক্যানসার কোষকে আক্রমণ করতে ও ক্যানসার কোষ ধ্বংস করতে অপসারিত টি-কোষে ক্যানসার-ফাইটিং ‘চিমেরিক অ্যান্টিজেন রিসেপ্টর (সিএআর)’ সরবরাহ করা হয়, আক্রমণ অব্যাহত রাখতে শরীরে এটির পুনরুৎপাদন হয়।

ডানা-ফারবার/ব্রিগহাম অ্যান্ড ওমেন’স ক্যানসার সেন্টারের ইমিউন ইফেক্টর সেল থেরাপি প্রোগ্রামের মেডিক্যাল পরিচালক ক্যারন এ. জ্যাকবসন বলেন, ‘সিএআর টি-সেল থেরাপির মাধ্যমে রোগীদের চিকিৎসা করা আমার জীবনের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ পেশাদার অভিজ্ঞতাগুলোর একটি এবং ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কর্তৃক এ থেরাপির অনুমোদন সেসব রোগীদের মনে আশার সঞ্চার করছে যাদের অন্যান্য চিকিৎসা ব্যর্থ হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এটি সেসব রোগীদের জন্য অত্যধিক ফলপ্রসূ হতে পারে যাদের ১২ থেকে ২৪ মাস আগেও বস্তুত কোনো বিকল্প ছিল না।’ সিএআর টি-সেল থেরাপি লিউকেমিয়া ও লিম্ফোমার মতো রক্ত ক্যানসারে কাজ করতে দেখা গেছে। এখন গবেষকরা দেখবেন যে কিভাবে এ থেরাপি অন্যান্য ক্যানসারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে।

৪. ক্যানসারের জন্য ফিটবিট
ফিটবিটের মতো অপটিক্যাল ইমেজিং শরীরের ভেতরটা দেখার জন্য লাইট ব্যবহার করে এবং এটি কেমোথেরাপির প্রতি স্তন ক্যানসারের রোগীদের প্রতিক্রিয়া দেখার কাজে সহায়ক হতে পারে। বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে একটি হাতেধরা যন্ত্র ডেভেলপ করা হয় যা টিউমারের রক্ত সরবরাহ এবং বিপাকের পরিবর্তন জানার জন্য রিয়ার-ইনফ্রারেড লাইট ব্যবহার করে। যদি কেমো কাজ না করে, তাহলে ডাক্তাররা খুব তাড়াতাড়ি পরিবর্তন আনতে পারবেন যা রোগীর সময় বাঁচাবে ও ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে রোগীকে রক্ষা করবে।

গবেষক ড. ড্যারেন রব্লিয়ার আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটিকে বলেন, ‘আমরা ভাবতে শুরু করেছি, চিকিৎসার সময় অনেক বায়োলজি ঘটেছে যা গবেষণা করা হয়নি, কারণ সঠিক সময়ে রোগীদের পর্যবেক্ষণ করার এ যন্ত্র পাওয়া যায়নি।’ তিনি একটি পরিধানযোগ্য যন্ত্রও ডেভেলপ করছেন যা অবিচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণের জন্য স্তনে ফিট করা হবে। অপটিক্যাল ইমেজিংয়ের অন্যান্য অগ্রগতিও দেখা যাচ্ছে, যেমন- মাল্টিমডেল অপটিক্যাল স্পেক্ট্রোস্কপি প্রোব, যা সার্জারির সময় সকল ক্যানসার কোষ সরানো হয়েছে কিনা তা সার্জনকে জানানোর জন্য লাইট ব্যবহার করে।

৫. নতুন ক্যানসার গবেষণা শেয়ারিং
প্রত্যেকের আশাপ্রদ ক্যানসার পরিসংখ্যান সম্পর্কে জানা উচিত এবং ক্লাউড শেয়ারিং ডাক্তারদেরকে আরো বেশি ক্যানসার উপাত্ত জানতে সাহায্য করবে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের নীতি-নির্ধারকদের মতে, ‘নতুন আবিষ্কারগুলোর একটি প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে, শেয়ারকৃত তথ্য এবং একটি নতুন ক্লাউডভিত্তিক তথ্য শেয়ারিং সেন্টার আবিষ্কারের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম সাফল্য আনতে সহায়ক হতে পারে।’ এই লক্ষ্যে ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে সুরক্ষিত ক্যানসার গবেষণা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে যা স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্য নিরাপদ সংরক্ষণ করার সময় সহযোগিতার অনুমতি দেবে।

এ প্রকল্পের কো-প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর এবং মেডিসিন অ্যান্ড হিউম্যান জেনেটিক্সের ওয়াল্টার এল. পামার ডিসটিনগুইশড সার্ভিস প্রফেসর ওলুফানমিলায়ো আই. অলোপেডি এক প্রেস রিলিজে বলেন, ‘আমরা হিপা-সুরক্ষিত পরিবেশে (হিপা=হেলথ ইন্স্যুরেন্স পোর্টেবিলিটি অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবিলিটি অ্যাক্ট) আমাদের তথ্য সংরক্ষণ করতে পারি এবং এই মহাদেশ ও সারাবিশ্বের সহযোগীদের সঙ্গে আমরা তা শেয়ার করতে পারি।’ তিনি যোগ করেন, ‘আমি মনে করি, চিকিৎসকদের গবেষণার ক্ষেত্রে এটি বৈপ্লবিক হবে।’

৬. কোলরেক্টাল ক্যানসার ওয়েক-আপ কল
আপনার বয়স ৫০ বছরের নিচে বলে ভাববেন না যে আপনি কোলরেক্টাল ক্যানসার থেকে রেহাইপ্রাপ্ত। এ বছর আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণায় আবিষ্কার হয় যে, তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এ রোগ উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ গবেষণা অনুসারে, ১৯৫০ সালে জন্মগ্রহণকারী লোকদের তুলনায় ১৯৯০ সালে জন্মগ্রহণকারী লোকদের কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি দ্বিগুণ এবং রেক্টাল ক্যানসারের ঝুঁকি চারগুণ বেশি। ভালো স্ক্রিনিংয়ের কারণে এসব ক্যানসারের ঝুঁকি হ্রাস পাচ্ছে, কিন্তু তরুণদের মধ্যে এসব ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে যা উদ্বেগজনক।

প্রধান গবেষক রেবেকা সাইগেল বলেন, ‘তরুণদের মধ্যে প্রচলিত ট্রেন্ড হচ্ছে ভবিষ্যতে তাদের এ রোগ হওয়ার প্রধান কারণ।’ তিনি যোগ করেন, ‘ক্লিনিশিয়ান এবং সাধারণ জনগণকে কোলরেক্টাল ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি সম্পর্কে সচেতন করতে শিক্ষামূলক প্রচারাভিযানের প্রয়োজন আছে যা তাদেরকে বিলম্ব ডায়াগনোসিস (যা তরুণদের মধ্যে বেশি) হ্রাস করতে এবং সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যসম্মত খাওয়া ও আরো অধিক সক্রিয় জীবনধারা মেনে চলতে উৎসাহিত করবে।’ কোলন ক্যানসার ও রেক্টাল ক্যানসার অথবা কোলরেক্টাল ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধির স্পষ্ট কারণ এখনো জানা যায়নি, কিন্তু এ রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধির এই জ্ঞান ডাক্তার ও রোগীদের জন্য একটি ওয়েক-আপ কল বা সচেতন হওয়ার আহ্বান হতে পারে এবং শিগগির ডায়াগনোসিসের দিকে ধাবিত করবে।

৭. ক্যানসারে অন্ত্রের ভূমিকা থাকে
অন্ত্রের স্বাস্থ্যকর মাইক্রোবায়োম ক্যানসারের জন্য ইমিউনোথেরাপি চিকিৎসার প্রতিক্রিয়াকে মডারেট করে আপনার জীবনে কয়েক বছর যোগ করতে পারে। ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস এমডি অ্যান্ডারসন ক্যানসার সেন্টারের গবেষকদের দ্বারা সম্পাদিত এক গবেষণায় আবিষ্কার হয় যে, মেলানোমার চতুর্থ পর্যায়ে চলে যাওয়া রোগীদেরকে ইমিউনোথেরাপি দেওয়াতে অধিকতর ভালো ফলাফল পাওয়া যায়, যেখানে ইমিউনোথেরাপির প্রতিক্রিয়া তাদের পরিপাকতন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়ার অধিক বৈচিত্র্যপূর্ণ দল বা মাইক্রোবায়োম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কারণ, এসব ভালো ব্যাকটেরিয়া হুমকির প্রতি ইমিউন প্রতিক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। স্বাস্থ্যকর মাইক্রোবায়োমের মানে হচ্ছে, ক্যানসারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ইমিউন সিস্টেমকে ব্যবহার করা চিকিৎসার প্রতি আরো বেশি ভালো প্রতিক্রিয়া। আপনার মাইক্রোবায়োম খাদ্য, প্রোবায়োটিক ব্যবহার এবং ব্যায়ামের মতো জীবনধারার পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে।

গবেষণা প্রধান এবং সার্জিক্যাল অনকোলজি অ্যান্ড জেনোমিক মেডিসিনের সহযোগী অধ্যাপক জেনিফার ওয়ারগো বলেন, ‘আপনি আপনার মাইক্রোবায়োমকে পরিবর্তন করতে পারেন, এটি আসলে কঠিন কোনো কাজ নয়, তাই আমরা ধারণা করছি এই আবিষ্কার প্রচুর নতুন সুবিধা প্রাপ্তিসাধ্য করবে।’

৮. ক্যানসারের উপর জেনেটিক টেস্টিং
আপনি সম্ভবত স্তন ক্যানসার ও ডিম্বাশয় ক্যানসারের জন্য বিআরসিএ জিনের কথা শুনে থাকবেন। কিন্তু ক্যানসার নির্ণয় ও চিকিৎসার ভবিষ্যৎ অন্যান্য অনেক জেনেটিক পরিবর্তনের জন্য রোগীদের স্ক্রিনিং করানোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে। এরকম একটি উদ্যোগের অংশ হচ্ছে, প্রিসিশন মেডিসিন। প্রিসিশন মেডিসিন মানে হচ্ছে, রোগীদের টিউমারে জেনেটিক পরিবর্তন ব্যবহার করে তাদের চিকিৎসা নির্ধারণের প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় দেখা হয় যে প্রত্যেক রোগীকে কিভাবে সর্বোত্তম চিকিৎসা দেওয়া যায়। এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক অগ্রগতি হচ্ছে, ক্যানসার রোগীদের টিউমারে শতশত বায়োমার্কার (প্রাকৃতিকভাবে আবির্ভূত মলিকিউল, জিন বা বৈশিষ্ট্য যার মাধ্যমে রোগগত বা শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, রোগ ইত্যাদি শণাক্ত করা হয়) শণাক্ত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অনুমোদিত প্রথম বিস্তৃত পরীক্ষা। এটি ডাক্তারদেরকে দ্রুত জানতে সাহায্য করবে যে কিভাবে রোগকে আক্রমণ করা যায়।

অন্য খবরে জানা যায়, গবেষকরা প্রাণঘাতী অগ্ন্যাশয় ক্যানসারে বেঁচে থাকার হার আবিষ্কার করেছেন যা চারটি জিনের পরিবর্তনের সঙ্গে সংযুক্ত। গবেষণা সহ-লেখক, ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টার মেডিক্যাল সেন্টার’স উইলমট ক্যানসার ইনস্টিটিউটের হেমাটোলজি/অনকোলজি বিভাগের প্রধান এবং পাকস্থলী ও অন্ত্র ক্যানসার বিশেষজ্ঞ অ্যারাম হেজেল এক প্রেস রিলিজে বলেন, ‘এই গবেষণা অগ্ন্যাশয় ক্যানসারের আণবিক বৈশিষ্ট্য কিভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আরোগ্য সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করে তা বুঝতে আমাদেরকে সাহায্য করে এবং রোগীদেরকে গাইড করার জন্য আমাদের অধিক তথ্য প্রদান করে, বিশেষ করে ভবিষ্যত গবেষণা অধ্যয়ন পরিকল্পনা করতে।’

৯. শর্করা ও ক্যানসার
শর্করা বাদ দেওয়ার সঙ্গে কি ক্যানসার হ্রাসের সম্পর্ক আছে? নতুন গবেষণা বলে যে, এটা সম্ভব। কয়েক দশক ধরে গবেষকরা জেনে আসছেন যে, ক্যানসার কোষ স্বাভাবিক কোষের তুলনায় তাদের ক্রমবিকাশ বাড়ানোর জন্য প্রচুর পরিমাণে শর্করা ব্যবহার করে। অস্বাভাবিক উপায়ে কোষ কর্তৃক শর্করা ব্যবহারের ফলে ক্যানসার হয় নাকি শর্করার কারণে ক্যানসার হয়- এ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত ছিল না। এ বছর বেলজিয়ামে ৯ বছরের একটি প্রকল্পের ফলাফল প্রকাশিত হয় যা থেকে জানা যায় যে, শর্করা ক্যানসার কোষকে জাগিয়ে তুলে ক্রমবিকাশের দুষ্ট চক্রের দিকে চালিত করে। ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডোর গবেষকরা কিছু জিনকে থামিয়ে শর্করা ধ্বংসের মাধ্যমে ক্যানসার কোষের ক্ষমতার অবসান ঘটানোর একটি উপায় খুঁজে পেয়েছেন।

১০. ব্যক্তিগত শর্তাধীন ক্যানসারের টিকা
গ্রীবার ক্যানসার প্রতিরোধের একটি সাধারণ উপায় হচ্ছে, এইচপিভি ভ্যাকসিন নেওয়া। ক্যানসার প্রতিরোধে অন্যান্য ভ্যাকসিন চিকিৎসাও পর্যবেক্ষণে রয়েছে এবং এই ক্ষেত্রে পৃথক ক্যানসার রোগীর টিউমারকে লক্ষ্যবস্তু ধরা হচ্ছে। ডানা-ফারবার ক্যানসার ইনস্টিটিউট এবং ব্রড ইনস্টিটিউট অব এমআইটি অ্যান্ড হার্ভার্ডের এক পরীক্ষামূলক গবেষণায় প্রথম সফল ব্যক্তিগত শর্তাধীন ভ্যাকসিন বা টিকা ছয়জন মেলানোমা রোগীকে সফলভাবে চিকিৎসা করার জন্য ব্যবহার করা হয়। গবেষকরা মিউটেড অ্যান্টিজেন বা নিওঅ্যান্টিজেন পর্যবেক্ষণ করতে প্রত্যেক টিউমারের ডিএনএ নির্দিষ্ট ক্রমে বিন্যাস করেন। ক্যানসার কোষকে শণাক্ত করে ধ্বংস করার জন্য ভ্যাকসিন ইমিউন কোষকে প্রশিক্ষিত করে তুলে।

ডানা-ফারবার ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক-গবেষক ক্যাথারিন জে. ওউ বলেন, ‘ক্যানসারের ক্ষেত্রে আমরা উপলব্ধি করেছি যে প্রত্যেক রোগীর টিউমার ভিন্ন।’ প্রযুক্তির সাম্প্রতিক অগ্রগতির ফলে এখন একটি থেরাপি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে যা একজন ব্যক্তির টিউমারকে লক্ষ্যবস্তু করার জন্য উপযুক্ত। আমরা প্রুফ-অব-প্রিন্সিপল (ক্লিনিক্যাল ড্রাগ উন্নয়নের প্রথম পর্যায়) প্রদান করেছি যাতে ব্যক্তিগত শর্তাধীন টিকা প্রস্তুত করা যায় এবং এই টিকা প্রদানের পর রোগীর টিউমারের প্রতি নির্দিষ্ট ও উচ্চ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।’ এ বিষয়ে আরো অধিক গবেষণা প্রয়োজন আছে, কিন্তু এ আবিষ্কার আশাপ্রদ।

১১. প্রায় অর্ধেক ক্যানসার মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য
আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির এক নতুন গবেষণা থেকে জানা যায় যে, ৪৫ শতাংশ ক্যানসার প্রতিরোধযোগ্য। এই গবেষণায় ২৬ রকম ক্যানসারের উপাত্ত ও ক্যানসারের ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়সমূহ বিশ্লেষণ করা হয়। এসব ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়সমূহ হচ্ছে: সিগারেট ধূমপান, সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোক, অতিরিক্ত শারীরিক ওজন, অ্যালকোহল সেবন, লাল ও প্রক্রিয়াজাত মাংস ভক্ষণ, ফল-শাকসবজি-আঁশ-ক্যালসিয়াম অল্প ভক্ষণ, আল্ট্রাভায়োলেট লাইট এবং শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা। ৪২ শতাংশ সবরকম ক্যানসার এবং ৪৫ শতাংশ ক্যানসার মৃত্যু এসব ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। এসব ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় ৪০ শতাংশ পুরুষ ও নারীর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে যাদের জীবনে ক্যানসার নির্ণয় হবে। এ আবিষ্কার প্রতিরোধযোগ্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়সমূহের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ক্যানসার রোগের হার ও ক্যানসারজনিত অকাল মৃত্যু হ্রাস করতে প্রতিরোধযোগ্য ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য জোর দিচ্ছে।

তথ্যসূত্র : রিডার্স ডাইজেস্ট



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ ডিসেম্বর ২০১৭/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়