ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

২৫ মার্চ ৭১ : গণহত্যার ভয়াবহ রাত

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৪৪, ২৫ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
২৫ মার্চ ৭১ : গণহত্যার ভয়াবহ রাত

সেই রাতে পথের পাশে সাধারণ মানুষকেও ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়

শাহ মতিন টিপু : বাঙালি নিধনযজ্ঞে মেতে উঠল পাকিস্তানী দানবরা। ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাপিয়ে পড়ল হায়েনার মতো। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে চলল ‘অপারেশন সার্চলাইট’।

ঢাকাসহ দেশের অনেকস্থানে একটি রাতেই নির্মমভাবে হত্যা করল অর্ধ লক্ষাধিক ঘুমন্ত বাঙালিকে। সময়টা ছিল এমন তখন ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিল ব্যস্ত ঢাকা শহর। অনেকে ঘুমিয়েও পড়েছে। ঠিক এমনি সময়েই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানো হলো।

লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর প্রতিবেদক সাইমন ড্রিং-এর বর্ণনা মতে, ২৫ মার্চ ৭১-এ রাত দশটার দিকে শুরু হয় সেই পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ। যদিও পরিকল্পনা অনুযায়ী জিরো আওয়ার বা আক্রমণের নির্ধারিত সময় ছিল রাত একটা।

রাতের অন্ধকারে পাক জল্লাদ বাহিনী দানবীয় নিষ্ঠুরতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর। চলল বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তান্ডব। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হকচকিত বাঙালি ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। শহরের রাজপথ, অলিগলি, ফুটপাথ, খেলার মাঠ, ক্যাম্পাস সর্বত্রই লাশ আর রক্তস্রোত। মধ্যরাতে ঢাকা হয়ে উঠল লাশের শহর।

বিভীষিকাময় ঘটনার কারণে ২৫ মার্চের রাতটি ‘কালরাত’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। স্বজন হারানোর বেদনায় শোকাতুর হয়ে পড়েছিল গোটা বাঙালি জাতি। প্রতি বছর এ দিনটি এলেই আমাদের হৃদয় কষ্টে ভরে ওঠে, পুরানো ক্ষতচিহ্ন ফের জেগে ওঠে ‘দেগদগে ঘা’ হয়ে।

সে রাতে আঘাত হানা হয় গণমাধ্যমেও। পিপলস ডেইলি, গণবাংলা, দৈনিক সংবাদ, ইত্তেফাক, জাতীয় প্রেসক্লাব অগ্নিসংযোগ করে, মর্টার সেল ছুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাক হানাদাররা। নিহত হন বেশ ক’জন গণমাধ্যম কর্মী।

মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকে ট্যাঙ্ক-লরি নিয়ে শ্বাপদের দল। ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল) জগন্নাথ হল ও রোকেয়া হলে প্রতিটি রুমে রুমে ঘুমন্ত ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে । গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ হলের ১০৩ হিন্দু ছাত্রকে। হলের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে ঢুকে তাদের স্ত্রী-বাচ্চাসহ পুরো পরিবারকে একে একে নির্মমভাবে হত্যা করে। রক্ষা পাননি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও। চলার পথেও রাস্তার দুই পাশে চলতে থাকে ব্রাশফায়ার। মেডিক্যাল কলেজ ও ছাত্রাবাসে হত্যা করা হয় অজস্র মানুষ। চারদিক রক্ত আর রক্ত, লাশ আর লাশ। হিংস্র শ্বাপদদের থেকে রক্ষা পেতে রোকেয়া হলের ছাদ থেকে প্রায় ৫০ ছাত্রী লাফ দিয়ে পড়েছিল।

আর্চার কে ব্লাড এর বই ‘The cruel birth of Bangladesh’ থেকে জানা যায়, ছাত্রীনিবাস রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় এবং ছাত্রীরা আগুন থেকে বাঁচতে হলের বাইরে আসা শুরু করলে পাকবাহিনী তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাথে আর্মি ইউনিট ৮৮ এর কথোপকথন থেকে জানা যায়, আনুমানিক ৩০০ জন ছাত্রীকে সে রাতে হত্যা করা হয়।

হত্যার পাশাপাশি চলছিল ধর্ষণ ও লুট। সেই রাতে রাজারবাগে নিহত হয় ১১০০ বাঙালী পুলিশ। রক্তের স্রোতে ভেসে যায় রাজারবাগের সড়ক।

মধ্যরাতে ঢাকাকে লাশের শহরে পরিণত করা ছাড়াও দেশের অন্যান্য বড় শহরগুলোতেও নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বরোচিত হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেই রয়েছে। পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল তাতে বলা হয়- ‘১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’

২৫ মার্চ রাত সোয়া একটার দিকে ট্যাঙ্ক সাঁজোয়া গাড়ি ও এক লরি সৈন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।

বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু বীর বাঙালির মতোই দোতলার ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ান। রাত ১টা ২৫ মিনিটের দিকে এ বাড়ির টেলিফোনের লাইন কেটে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়।

এর আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধু ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন। ইপিআরের ওয়্যারলেসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে।

এই ওয়্যারলেস বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দফতরে পৌঁছায়। চট্টগ্রামে স্বাধীনতার ঘোষণা সে রাতেই সাইক্লোস্টাইল করে শহরবাসীর মধ্যে বিলি হয়। 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ মার্চ ২০১৮/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়