ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

অনিশ্চয়তায় জীবন

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪২, ২৮ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অনিশ্চয়তায় জীবন

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : উর্মি আক্তার। বয়স ১১ পেরিয়েছে। বাড়ি কেরানীগঞ্জে হলেও এক বছর ধরে সদরঘাটে বসবাস। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। সদরঘাট ও গুলিস্তান এলাকায় চকলেট বিক্রির পাশাপাশি ভিক্ষা করে নিজের খাবার যোগাড় করে।

মো. রাসেল, বয়স ১২। তিন বছর ধরে সদরঘাটে টোকাইয়ের কাজ করে। ঘাটে লঞ্চ এলে কুলির কাজও করে। রাসেলের মা-বাবা গাজীপুর থাকলেও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। পরিবার তাকে এতিমখানা মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলে হুজুরের মারধর সহ্য করতে না পেরে সে পালিয়ে ঢাকায় আসে। সেই থেকে সদরঘাটই তার ঠিকানা। সদরঘাটের আরেক বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম রাব্বি, বয়স ১৩। দিনে ভ্যান ঠেলা আর পানি বিক্রির পর রাত কাটে সদরঘাটেই।

সাথী আক্তার, বয়স ১১।​ নোয়াখালীর এই শিশুটিকে মাত্র ছয় বছর বয়সে কাজে দেয় দরিদ্র পরিবার। ঠিকমতো কাজ না করতে পারায় গৃহকর্তী তাকে প্রায়ই মারধর করতো। তবুও বছর চারেক ওই বাড়িতে কাজ করে সাথী। একদিন গৃহকর্তী সাথীকে কল্যাণপুর বাস স্টেশনে রেখে চলে যায়। সাথীর কান্নাকাটিতে আশেপাশের লোকজন পুলিশে খবর দেয়। পরে পুলিশ সাথীকে উদ্ধার করে বেসরকারি সংস্থা লিডো’র আশ্রয় কেন্দ্রে রাখে। শুরু হয় সাথীর অন্যজীবন।

উর্মি, রাসেল, রাব্বি, সাথীর মতো হাজারো শিশু শেকড় বিচ্ছিন্ন। নগরীর বিভিন্ন স্থানে এমন বহু শিশুর দেখা মেলে। ওদের বেশিরভাগেরই বাড়ি নেই, পরিবারিক বন্ধন নেই, নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই, নেই বলার মতো পরিচয়টুকুও। মাথায় বাবার আদরের ছোঁয়া নেই, মায়ের মমতার পরশ নেই। নাড়ির টান নেই। ভবিষ্যত গন্তব্যের কোনো নিশানা নেই।

ইউনিসেফ পথশিশুদের সংজ্ঞায়িত করেছে, ‘যে শিশুরা রাস্তায় আছে, যাদের পিতামাতা বা আইনী অভিভাবকও নেই।’

ক্ষুধার জ্বালায় ওরা ভিক্ষা করে, কেউ ভ্যান ঠেলে, কেউ করে ঘাটে কুলির কাজ। সমাজের কিছু অসাধু মানুষের প্রলোভনে ওদের কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ে যৌনতায়, মাদক নেশায় কিংবা ভয়াবহ কোনো অপরাধে। যখন উন্নয়নের ডামাডোলে রাজধানী ঢাকা ঝলমল করে, তখন ঢাকার পথেঘাটে ভাসমান পথশিশুদের এমন বেহাল দশাও চোখে পড়ে। সরেজমিনে ঘুরে রাজধানীল সদরঘাট, কমলাপুর রেলস্টেশন, বিমানবন্দর, মিরপুর মাজার, গুলিস্তান, ধানমন্ডি লেক, ঢাবি টিএসসি, ভিক্টেরিয়া পার্ক এলাকায় ভাসমান শিশুদের অবস্থান বেশি লক্ষ্য করা গেছে।

ভাসমান শিশুরা প্রায়ই যৌন নির্যাতন, শোষণ, চরম অবহেলার শিকার হয়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে রাজধানীতে সর্বাধিক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৬৭টি শিশু ধর্ষণের খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সংস্থাটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে শহরকেন্দ্রিক ভাসমান মানুষের বসবাস, যেখানে কেউ কারো খবর রাখে না। শ্রমজীবী বাবা-মায়ের অবর্তমানে সুরক্ষা বলয় না থাকায়।

 



ভাসমান পথশিশুদের একটি অংশ অজ্ঞাত বাবা-মায়ের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জন্ম লাভ করা অনাকাঙ্ক্ষিত শিশু। সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে জন্মদানকারী বাবা মা রাস্তায়, ডাস্টবিনে, ঝোপের আড়ালে রেখে চলে যায়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে ১৭টি অজ্ঞাত পরিচয় নবজাতক কুড়িয়ে পাওয়া গেছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, এই জরিপ কেবল ১০টি পত্রিকার সংবাদের ভিত্তিতে করা হয়েছে। বাস্তবে অজ্ঞাত পরিচয়ের নবজাতকের সংখ্যা আরো অনেক বেশি, যাদেরকে কিছু সিন্ডিকেট বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষাবৃত্তিসহ নানা নেতিবাচক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

রাজধানীর অধিকারবঞ্চিত পথশিশুদের নিয়ে ১০ বছর ধরে কাজ করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস। কারিতাসের প্রজেক্ট অফিসার (চিলড্রেন) সাহেদ ইভনে ওবায়েদ ছোটন বলেন, পথশিশুরা একই সঙ্গে খাদ্য ঝুঁকি, স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকে। রোদে বৃষ্টিতে তারা খুব কষ্ট করে, রাতে ঘুমানোর জায়গা থাকে না। কোনো শিক্ষা তারা পায় না। শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহও থাকে না। অপরাধ ও মাদকের সঙ্গে তারা খুব দ্রুত জড়িয়ে পড়ে।

তিনি জানান, সাধরণত চার ধরনের ভাসমান শিশু দেখা যায়। প্রথমত যাদের জন্ম পথে, বেড়ে উঠা পথে। দ্বিতীয়ত পারিবারিক দারিদ্রতার কারণে কিংবা মা-বাবার বিচ্ছেদের কারণে। তৃতীয়ত বস্তি এলাকায় বাস, বাবা মা শ্রমজীবী হওয়ায় শিশুরা পথে থাকে। চতুর্থত এতিম শিশুরা যারা জন্মের পর থেকে অন্যের কাছে বেড়ে উঠেছেন।

লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনোমিক্স ডেভলেপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (লিডো) তথ্যমতে, রাজধানীর পথশিশুদের মধ্যে দারিদ্র্যতার কারণে গ্রাম থেকে আসা শিশুর সংখ্যা ৫০%, রাস্তায় জন্মগ্রহণকারী শিশুর সংখ্যা ৭%, শিশু পাচারে শিকার হয়ে আসে ৫%, পারিবারিক বিচ্ছেদ ও সহিংসতার কারণে ১০%, বাড়িতে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে আসে ৬%, প্রাকৃতিক দুর্যোগে শিকার হয়ে আসে ৩%, পরিবার বা আত্মীয় দ্বারা ঢাকা পরিদর্শন কালে হারিয়ে যাওয়া শিশুর সংখ্যা ৫%।

সংস্থাটির তথ্যমতে, ভাসমান শিশুরা পরিত্যক্ত ভবন, কার্ডবোর্ডের বাক্স, পার্ক, রেলপথ প্ল্যাটফর্ম বা রাস্তায় নিজেদের মধ্যে বসবাস করে। তারা সাধারণত রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পরিত্যক্ত খাবার খায়, যা স্বাস্থ্যকর খাদ্য নয়। তাদের অনেকের পুষ্টিকর খবার সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। রাস্তার শিশুরা সাধারণত বিপজ্জনক এবং অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় থাকার কারণে রোগে ভোগে। রাস্তার শিশুদের মধ্যে জ্বর সবচেয়ে সাধারণ অসুস্থতা। অন্যান্য প্রাদুর্ভাবের অসুস্থতাগুলো দুর্ঘটনাজনিত আঘাত, জন্ডিস, চিকেন পক্স, অ্যালার্জি, হাম, হাঁপানি এবং ডায়রিয়া রয়েছে। রাস্তায় শিশুদের অধিকাংশই শিক্ষাগত এবং বিনোদনমূলক সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হয়।

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ (১৯৮৯) অনুযায়ী শিশুর স্বার্থ রক্ষা, শিশুর প্রতি দায়িত্ব, শিশুর জন্মনিবন্ধনকরণ, শিশুর আইনসম্মত পরিচিতি, পিতামাতার সঙ্গে বসবাসের অধিকার, শিশু পাচার প্রতিরোধ, শিশুর মত প্রকাশের অধিকার, শিশুর শারীরিক এবং মানসিক উন্নয়ন, শিশুর লালন পালন, শিশুর প্রতি আচরণ, পরিবার বঞ্চিত শিশুর যত্ন, শিশু স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, শিশুর চিকিৎসা পরিচর্যা, শিশুর সামাজিক নিরাপত্তা, শিশুর উন্নয়ন, শিশুর শিক্ষা লাভের অধিকার, শিশুর অবসর ও বিনোদন, শিশুর বিকাশের সুযোগের কথা থাকলেও ভাসমান পথশিশু ক্ষেত্রে এই অধিকারগুলো পুরোপরি উপেক্ষিত হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন প্রফেসর নেহাল করিম রাইজিংবিডিকে বলেন, পথশিশুরাও সমাজের অংশ। সমাজের নানা অসংগতি ও বৈষ্যমের কারণে দিন দিন পথশিশুর সংখ্যা বাড়ছে। যতদিন পর্যন্ত সরকার প্রান্তিক মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হবে, ততদিন পর্যন্ত ভাসমান পথশিশু সংকট থেকে যাবে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ মার্চ ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়