ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আমাদের বিজয় দিবস ।। আহমদ রফিক

আহমদ রফিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০২, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমাদের বিজয় দিবস ।। আহমদ রফিক

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

গ্রেগরিয়ান কালেন্ডারের হিসাব মতে দিনটি ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ, বাঙালির অনেক আদরের ‘বিজয় দিবস।’ বাঙালি এ দিনটিকে বাংলা সন-তারিখে চিহ্নিত করেনি। তবে একুশে ফেব্রুয়ারি কিছুটা হলেও ৮ই ফাল্গুনকে মেনে নিয়েছিল। বহুবার লেখা কথা, এসবই বাঙালি মনে উপনিবেশ শাসনে সৃষ্ট হীনমন্যতার প্রকাশ। সে যাই হোক, ১৬ ডিসেম্বরে রেসকোর্স ময়দানে মানুষের ঢল। সবাই জেনে গেছেন পাকসেনারা পরাজিত, তাদের আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান রেসকোর্সে। আয়োজন শেষ। সাদামাঠা একটা টেবিল ও দুটি চেয়ার। তাতে বসা পরাজিত পাকসেনা অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজি ও ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের প্রতিনিধি জেনারেল অরোরা। এদের ঘিরে নিরাপত্তা বলয়। বাইরে শোকার্ত ও ক্রুদ্ধ মানুষের স্লোগান। পারলে পাকসেনাধ্যক্ষকে ছিঁড়ে খায়। কারণ, তার কীর্তিকলাপে মানুষ ছিল অতিষ্ঠ। হয়তো তাই স্বাক্ষর-অনুষ্ঠান শেষ হতেই ছোট্ট একটি নিরাপত্তা গ্রুপ নিয়াজি-ফরমানদের অনেকটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায় নিরাপদ আস্তানায়, সেনানিবাসে।

 

অযৌক্তিক হলেও মানুষ ক্ষুব্ধ ভারতীয় কমান্ডের প্রতি। এ ক্ষোভ পরে নানা কারণে বেড়েছে। তবে পাকবিরোধী ক্রোধ ওই উদ্যান পার হয়ে আমাদের সমাজ থেকে কিছুকাল পরই কীভাবে হাওয়ায় উড়ে গেল তা এক বিস্ময় এবং রাজনৈতিক নিরীক্ষার বিষয়। রেসকোর্স মাঠে সেদিন লাল ফুলের সমারোহ ছিল না কিন্তু উপস্থিত মানুষের মনে ছিল স্বজন হারানোর বেদনায় রক্তক্ষরণ। অন্যদিকে বিজয়ের ফুল ফোটা আনন্দ। তাদের চোখের সামনে যেন বিজয়ের বেশে একটি রক্তাক্ত ‘লাল টুকটুকে দিন।’ এখন শান্তিতে-স্বস্তিতে ঘুমানো যাবে। আনন্দ-বেদনা এই দুই অনুভূতি নিয়েই মানুষ স্লোগান তুলেছে ‘জয় বাংলা।’

 

‘জয় বাংলা’ তখন মানুষের হৃদয় উজাড় করা স্লোগান, বিজয়ের গান। দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে স্লোগানের মতো, গানের কথার মতো শিরোনাম : ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়।’ বিজয় নিয়ে মানুষের উন্মাদনা তখন শিখর উচ্চতায়। রাজপথে, শিক্ষায়তনের ক্যাম্পাসে চেনা-অচেনা মানুষ পরস্পরকে আলিঙ্গন করছে গভীর আবেগের প্রকাশ ঘটিয়ে। তাদের চোখে আনন্দ ও বেদনার জল। কাউকে দেখা গেছে গাড়ির সামনের কাচে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ কাগজ কাটা শিরোনাম সেঁটে ঘুরে বেড়াতে। সে এক বিস্ময়কর আবেগ, যা ভোলা যায় না। অনেকে দিনটা রাজপথেই কাটিয়ে দিতে চেয়েছেন। এমনকি পরের দিনটাও। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের (বর্তমান রূপসী বাংলার) সামনে চলমান নানা বয়সী মানুষের একটি মিছিল। ফর্সা মুখ, গাঢ় লাল ফ্রক পরা বছর তিনেকের একটি মেয়ে তার বাবার কাঁধে চেপে ওই মিছিলে শামিল। তার হাতে ধরা সোনালি সুতোয় বাংলাদেশের ম্যাপ আঁকা একটি পতাকা, যেটা পুরো নয় মাস ফ্রিজের নিচে লুকানো ছিল। এখন সেটা হাল্কা হাওয়ায় দুলছে। ভোরের কাঁচা সোনা রোদে ঝিলমিল করছে সোনালি সুতোর বুনোনি। শিশুটির গলায় আধো স্বরে উচ্চারণ- ‘জয় বাংলা।’ মিছিলের মানুষ মহাখুশিতে সেদিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। জয়ের আনন্দ, জয়ের তৃপ্তি নানাভাবে প্রকাশ পাচ্ছে।

 

‘সাকুরা’র সামনে দিয়ে গড়িয়ে চলছে একটি ট্যাঙ্ক। তার উপর একজন শিখ সেনা। কয়েকজন তরুণ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে সেদিকে ছুড়ে দিচ্ছে লাল-হলুদ গাঁদা ফুল। সৈনিকটি মহাখুশিতে দু-একটি ফুল লুফে নিয়ে মাথায় ঠেকাচ্ছে। হাত তুলে হাসিমুখে পাল্টা অভিবাদন জানাচ্ছে যদিও কথাগুলো বোঝা যায়নি।

 

বিজয়ের দিনটি এমনই ছিল একাত্তরে, আবেগ-উল্লাস-আনন্দের। সেই সঙ্গে হৃদয়ে রক্তক্ষরণেরও সময়, যখন খবর আসছিলো বধ্যভূমি থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ক্ষতবিক্ষত লাশ সম্পর্কে। যাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না তার নিকটজনদের কান্নার শব্দ সহ্য করার মত ছিলো না। তবু বড় স্বস্তির ছিলো বিজয়ের এই দিনটি যখন নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, মানুষ নামের পাকিস্তানি বর্বরগুলো আর কারো ওপর হামলে পড়তে পারবে না। ওরা এখন নজরবন্দি।

 

নতুন সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত নুতন দেশের মুখ, স্বাধীন ভূখণ্ড, নাম তার বাংলাদেশ। নতুন পতাকা, নতুন মানচিত্র নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। প্রত্যাশা পূরণ হলো স্বাধীনতাকামী বাঙালির। কিন্তু এই অর্জনের বিপরীত ধারার মানুষও সেদিন ছিল আবেগে-উচ্ছ্বাসে। আমরা মুদ্রার অপর পিঠের দিকে তাকাইনি। ভেবে দেখিনি জামায়াত, নেজামে ইসলাম বা মুসলিম লীগের মতো পাকিস্তানপন্থি দলের সমর্থক বাঙালি তথা রাজাকারের সংখ্যা কি খুব কম ছিল- এ কথা।

 

 

যুক্তিহীন ভাবাবেগে ওদের আমরা হিসাবের বাইরে রেখেছি। শুধু ঘাতক বিহারিদের প্রসঙ্গই বারবার সামনে এসেছে। এমনকি শহর ঢাকায় কৌতুকচ্ছলে কথিত ‘ষোড়শ ডিভিশনের মুক্তিযোদ্ধা’ অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধানামী শত্রু আমাদের উদাসীনতায় গোকুলে বেড়েছে। ক্রমে এদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটেছে। ভাবিনি সুশাসনের অভাব জ্যামিতিক হারে এদের বৃদ্ধি ঘটাবে। বাস্তবে হয়েছেও তাই। বহু তথ্য, বহু ঘটনা প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশবিরোধী এই শক্তি এদেশে নানাভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এক কথিত মাওলানা মুক্তি পেয়েছে এবং সমাজে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরে ঘাতক শিরোমণি গোলাম আযম ও তার সহযোগীরা দীর্ঘ সময় মহানন্দে শাসকবলয়ের সঙ্গে থেকেছে। ব্যাংক-বীমাসহ জাতীয় জীবনের সর্বখাতে তাদের বিত্তবৈভব, প্রবল ক্ষমতা পরিলক্ষিত হয়েছে। তাদের পায়ের নিচের মাটি অনেক মজবুত হয়ে উঠেছে। তাদের হাতে তৈরি হয়েছে ঠ্যাঙ্গারে বাহিনী, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তাদের হাতেই জিম্মি। তারা শাসন ক্ষমতা নির্ধারণের অনেকটা কব্জায় নিতে পেরেছে। সমাজে তাদের যথেষ্ট প্রাধান্য। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবস্থা সামাজিকভাবে দুর্বল।

 

বিজয়ের ফসল শ্রেণিবিশেষের ঘরে ওঠার কারণে তাদের অস্বাভাবিক সমৃদ্ধি সমাজ বিন্যাসের হিসাব পাল্টে দিয়েছে। টেকনোক্র্যাট, ব্যুরোক্র্যাট, শিল্পপতি, বৃহৎ পুঁজির মালিক ও এলিট শ্রেণি বিজয়ের বিশেষ আশীর্বাদে ধন্য। ধনিক, বণিক ও রাজনীতিক মিলে সমৃদ্ধির যে ত্রিভুজ তৈরি করেছে, তাতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরও সমর্থন রয়েছে।

 

স্বভাবতই গরিব মুক্তিযোদ্ধা হেলাল উদ্দিন চালের গুদামের শ্রমিক। ৬৭ বছর বয়সেও যাকে দু’মুঠো অন্নের সংস্থানে দুইমনি চালের বোঝা পিঠে নিতে হয়। আশ্রাব উদ্দিন রিকশা শ্রমিক, তার সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধা বেকার, ভিক্ষায় সংসার চলে। এমনি অনেক অনেক নাম উদাহরণ হিসেবে খাতার পাতায় বন্দি। তারা এখন মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় থেকে, অসম্মানের হাত থেকে মুক্তি চান। মুক্তি চান বিজয়ের ফাঁপা সম্মান থেকে। এ সম্মানের ভার বহন তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেষ বিচারে এমনটাই সত্য হয়ে দাঁড়ায় যে, একাত্তরের আবেগ, উচ্ছ্বাস, একাত্তরের সোনালি-রুপালি অর্জন সবই সুবিধাবাদী-সুবিধাভোগী ছিমছাম সুশ্রী শ্রেণিবিশেষের জন্য। বিজয় তাদেরই ছায়া দেয়, ফি বছরে মাথায় আশীর্বাদের ফুল রাখে। তাদের বিত্তবৈভব, প্রভাব, প্রতিপত্তি অতীতের কত বাইশ পরিবারকে ছাড়িয়ে গেছে তার ঠিকানা নেই। সে সমৃদ্ধি যেমন উচ্চতায়, তেমন সংখ্যায় অর্থাৎ তা যেমন ঊর্ধ্বমুখী; তেমনি আনুভূমিক।

 

‘বিজয়’ বাংলাদেশে বড় অস্থির সময় কাটাচ্ছে, বড় বিপন্নবোধ করছে, নড়েচড়ে বসেও সর্বজনীন স্বার্থের দড়িদড়াগুলো গুছিয়ে নিতে পারছে না। তার চেতনায় রক্তক্ষরণ ঘটছে কি-না, আক্ষেপের লবণ গড়িয়ে পড়ছে কি-না, তা ঠিক বুঝতে পারা যাচ্ছে না। তবে হয়তো এমন সময় ঠিক আসবে যখন, বাতাস দিক বদলাবে। প্রকৃত দেশপ্রেমী, সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী চেতনার মানুষ ‘বিজয়ের’ সর্বজনীন আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বন্দিদশার অবসান ঘটাবে, অন্তত ঘটানোর চেষ্টা চালাবে। পরিবর্তন ঘটবে বিদেশি শক্তি ও কর্পোরেট পুঁজি নিয়ন্ত্রিত রাজনীতির, ধনিক-বণিক শ্রেণির প্রভাবিত রাজনীতির। পরিবর্তন ঘটবে বিজয়-এর ঈমান-নিশানের। সে অর্জন করবে সর্বজনীন স্বার্থের চরিত্র। সে অনুযায়ী ঘটবে বাংলাদেশের রাজনীতির চরিত্র বদল। আমরা তেমন একটি সময়ের অপেক্ষায় আছি। আছি তেমন একটি বিজয় দিবস দেখব বলে।

 

লেখক : ভাষা সংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক, কবি, প্রাবন্ধিক

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ ডিসেম্বর ২০১৫/শাহনেওয়াজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়