ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

একটি প্রশ্নবিদ্ধ ভালোবাসা

সুপন সিকদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ৭ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একটি প্রশ্নবিদ্ধ ভালোবাসা

শরতের এক সন্ধ‌্যার অবুঝ বৃষ্টির ফোঁটা শ্বেতপাথরের সান্নিধ্যে সৃষ্টি করছে অমর এক প্রেমকাহিনী। শরতের যতো প্রেম আজ প্রকৃতিতে ঝরছে বৃষ্টি হয়ে। শরতের খুব পরিচিত সাদা কাশবন ভালো লাগছে না, আজ ভালো লাগছে এই অবুঝ বৃষ্টিকে।

বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে মঞ্চায়িত হল তরুণ নাট্যদল এম্পটি স্পেসের প্রথম প্রযোজনা ‘এ নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’।

নাটকের রচয়িতা সাইমন জাকারিয়া। লেখক এ নাটকে অনেকটা উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘দ্য ট্র্যাজেডি অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’-এর আখ্যানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে লিখেছেন। পাঠক রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট সম্পর্কে যা জানেন, নাটকটিতে তার পুরোপুরি ব্যতিক্রম ঘটনা দর্শকের চোখে পড়েছে। দর্শক অনেকটা ভেবেছিল পুরো নাটকটিতে রোমান্টিকতার ছোঁয়া থাকবে। রোমান্টিকতা ছিল, কিন্তু তার থেকেও বেশি  রোমাঞ্চকর ছিল নাটকটি। এতে লেখক স্বয়ং উইলিয়াম শেক্সপিয়ারকে দাঁড় করিয়েছেন তার সৃষ্টির সামনে। লেখক খুব নিপুণ হাতে চেষ্টা করেছেন রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট নাটকের ভেতরকার ষড়যন্ত্রকে খুঁজে বের করার। বলা যায়, লেখক এখানে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন । রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট নাটকে যেমন এক প্রেমময়তা প্রকাশ পায়, এই নাটকে প্রেমকে দেখা যায় কাঠগড়ায়, তবে প্রেমের মাঝে সৃষ্টি হয় মিথ্যা কিংবা সত্যের বেড়াজাল।

পূর্ণিমা রাতের প্রাকৃতিক নির্মল আলোয় এক কবি যান গ্রেভইয়ার্ডে। সেখানে কবি প্রত্যেক সমাধির গায়ে লতা বা ফুলের সুভাষ নিতে থাকেন। কবি আবিষ্কার করে প্রত্যেক মানুষের যেমন গায়ের গন্ধ আলাদা, ঠিক তেমনি সমাধিক্ষেত্রের প্রত্যেক ফুলের গন্ধও আলাদা আলাদা। কবি ব্যাকুল হয়ে উপভোগ করতে থাকেন সে সুবাস। হঠাৎ সমাধি ক্ষেত্রে আবির্ভাব হয় এক প্রেমিক যুগলের। কবি তাঁদের দেখে অনেকটা ঘাবড়ে যান। তাদের কাছে জানতে চান, কী তাদের পরিচয়। তাঁরা পরিচয় দেন, রোমিও-জুলিয়েট। আপনি এতক্ষণ আমাদেরই খুঁজছিলেন। এভাবেই এগোতে থাকে গল্প। কবি রোমিওর প্রাক্তন প্রেমিকা রোজালিনকে নিয়ে রোমিও জুলিয়েটের সম্পর্কের মধ‌্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করেন। জুলিয়েট রোমিওকে অবিশ্বাস করেন এবং প্রতারক ভাবেন। তবে রোজালিনের সাথে প্রেমের বিষয়টি সত্যি। রোমিও তো আসলে ভালোবাসতো রোজালিনকেই। কিন্ত শেষ পর্যন্ত সে রোজালিন থেকে মুখ ফিরিয়ে জুলিয়েটের সাথে দেহজ প্রেমে মেতে উঠেন। একসময় রোমিওর মন থেকে মুছে যায় রোজালিনের নাম। জুলিয়েট এই বিষয়টিই কবির কাছ থেকে জেনে ভালোবাসার প্রতি প্রশ্ন তোলেন। এভাবেই নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে এগোতে থাকে গল্প। এক সময় কবি ফাদার ফায়ারের দিকে প্রশ্ন তোলে তাকে মুখোশধারী ভণ্ড প্রমাণ করতে চান, কিন্তু জুলিয়েট তা মানতে পারেন না। সে কবির কথার প্রতিবাদ করেন এবং এক পর্যায়ে বাধ্য হন ফাদার ফায়ারকে স্মরণ করতে।

মুহুর্তেই মঞ্চে দেখা যায় শেক্সপিয়ার ও ফাদার ফায়ারকে। তার কাছে জানতে চান, কেনো রোমিও জুলিয়েটের বিয়ে গোপনে দেয়া হয়েছিল। ফাদার ফায়ার তার মতো বললেও শেষ পর্যন্ত তিনি যে তার নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য এসব করেছেন, তার প্রমাণ হয়। আর এদিকে শেক্সপিয়ার তো নিজের স্বার্থের জন্য সত্যের মুখোশধারী তথা সত্য গোপনকারী ফাদার ফায়ারকে রক্ষা করেন কথার মায়াজালে! এই দৃশ্যটিই বর্তমান সমাজে দেখা যায়। লেখক এই নাটকের ভেতর দিয়ে নিজের সময়ের উপলব্ধিকেই বুনন করেছেন।

লেখক সাইমন জাকারিয়া বলেছেন, ‘আমাদের সমাজে-রাষ্ট্রে এখনো ফাদার ফায়ারের মতো মুখোশধারীরা ধর্ম রক্ষকদের পৃষ্টপোষকতা করে আসছেন। এদিকে এ নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট রচনার দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও ঢাকার কোনো নাট্যসংগঠন, এই নাটকটি মঞ্চায়ন করার সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সেখানে একটি নতুন নাট্যদল এম্পটি স্পেস এই সাহসটুকু দেখিয়েছেন, সে জন্য দলের সবাইকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। আসলে এই উপমহাদেশে নতুন চিন্তা নতুনরাই গ্রহণ করে। এটা প্রমাণিত।’

এদিকে নাটকটির অভিনয়ের দিকে তাকালে বলতেই হয়, কবি চরিত্রে গোলাম শাহরিয়ার সিক্তের  অভিনয় ছিল অভূতপূর্ব। তিনি একাই নাটকটি বয়ে নিয়ে গেছেন শেষ পর্যন্ত। রোমিও চরিত্রে নির্দেশক নূর জামান রাজ নিজেই অভিনয় করেছেন। তার অভিনয় বেশ ভালো, তবে সংলাপ এবং মঞ্চে চলাফেরায় কিছুটা অপরিপক্কতা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি নির্দেশক হিসেবে যতখানি নাম কুড়িয়েছেন, অভিনেতা হিসেবে ততটা পারেননি। অন্যদিকে জুলিয়েট চরিত্রে লোবা আহমেদের অভিনয় দর্শকের বেশ ভালো লেগেছে। তবে তার সংলাপ বলার ভঙ্গির দিকে আরেকটু নজর দেয়া উচিৎ ছিল বলে দর্শক মনে করেন।

অন‌্যদিকে, ফাদার ফায়ার চরিত্রে প্রকৌশলী ফকির বিপ্লবের অভিনয় বেশ ভালো, তবে ফাদার ফায়ার চরিত্রে যতখানি প্রাণবন্ত থাকা উচিৎ ছিল, তিনি ততখানি থাকতে পারেনি এবং ঢুকতে পারেননি গল্পের ভেতরে। অন্যদিকে শেক্সপিয়ার চরিত্রে স্বাধীন বিশ্বাসের অভিনয় চোখে পড়লেও তার সংলাপ উপস্থাপন কিছুটা অস্পষ্ট ছিল। মঞ্চের আরো দুইজন সারথি স্ট্যাচু-১ এবং স্ট্যাচু-২ চরিত্রে বাপ্পি সরদার এবং মো. রফিদুল আউয়াল দু’জনই স্ট্যাচু হিসেবে বেশ ভালো করেছেন।

মঞ্চের দিকে তাকালে প্রথমেই বলতে হয়, মঞ্চ ছিল শুভ্র দেশের শুভ্রতায় আঁকা চবির মতো। লাইটিং ছিল অসাধারণ। এই জায়গাতে নির্দেশক প্রশংসা কুড়িয়েছেন।

নাটকের আবহ সঙ্গীতগুলো বেশ রোমাঞ্চকর ছিল। আবহ সঙ্গীত নাটককে নিয়ে গেছে অন্য এক মাত্রায়। গোলাম শাহরিয়ার সিক্ত যেমন অভিনয়ে প্রশংসিত, ঠিক তেমনি কোরিওগ্রাফিতেও অনবদ্য। নাচের মুদ্রাগুলো যেন নাটকে বহন করে।

সুন্দর এই নাটকটি দেখানোর জন‌্য শ্রদ্ধাভাজন অধ‌্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস স‌্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা। সাথে ছিলেন বিশ্ববিদ‌্যালয়ের বিভাগীয় বড় ভাই হাকিম মাহি। স্মৃতির পাতায় অক্ষত হয়ে থাকবে আপনাদের সাহচর্য। 

আসলে তরুণরা বরাবরই সাহসী। সকালের শিউলি ফুলের শুভ্রতার মতো এম্পটি স্পেস শোভা ছড়াক এই কামনায়। জয় হোক রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েটের। জয় হোক এম্পটি স্পেসের। জয় হোক মঞ্চ নাটকের।

পর্যালোচক: শিক্ষার্থী, জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ‌্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।



এসইউবি/সুপন সিকদার/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়