ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

এক ডাবের মূল্য তের হাজার রুপাইয়া

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৫, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এক ডাবের মূল্য তের হাজার রুপাইয়া

(ভিয়েতনামের পথে: ৪১তম পর্ব)

ফেরদৌস জামান: আজ কোনো তাড়া নেই। সব কিছুর আগে চাই ঝরঝরে একটা গোসল। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া এই তিন দেশের মধ্যে একটি বিষয়ে দারুণ মিল আছে, যে মিল খুঁজতে হলে প্রবেশ করতে হবে গোসলখানায়। গোসল করার জন্য ছাদ ঝরনার ব্যবস্থা নেই। সবখানে হাত ঝরনা। অথবা শুধুমাত্র একটি প্লাস্টিকের নল, কল ঘুরালে গলগল করে পনি আসে। এর বাইরে আরও অন্যান্য মিল থাকতে পারে কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় মনে হয় ঝরনা অন্যতম।

এখন পর্যন্ত যে মানের গেস্টহাউজ বা হোটেলে থাকা হলো তার গড়পড়তা ধরন মধ্যবিত্ত। অতএব, এখান থেকে ধারণা করা যায় তিন দেশের কোথাও ছাদ ঝরনার প্রচলন নেই। যাই হোক, হাত ঝরনায় গোসল এবং গোসলের পর বের হলাম ইন্দোনেশিয়া ঘুরতে। দ্বিতীয় তলার সম্মুখ ভাগে রেলিং দেয়া প্রশস্ত খোলা জায়গা বা বারান্দা। এক সেট সোফা ও বেঁতের চেয়ার পাতা। দেয়ালে বইয়ের তাক। তাকে কিছু বই সাজানো। এর মধ্যে পর্যটন বিষয়ক বইয়ের আধিক্য। এদিকে আমাদের হাতেও কিছু ভ্রমণ প্যাকেজের কাগজপত্র এবং বালির মানচিত্র- গতকাল বিমন বন্দর থেকে সংগ্রহ করা। ভাবলাম আজকের ভ্রমণ পরিকল্পনাটা সাজানো দরকার। কারণ রাতে কোনো পরিকল্পনা তৈরি না করেই ঘুমিয়ে পরেছিলাম। তার পেছনে দায়ী কিঞ্চিত হতাশা। হোটেল অভ্যর্থনা এবং ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বালি ঘুরে দেখা বেশ ব্যয়বহুল। তার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ পরিবহণ। এখানে সাধারণত কোনো বাস অথবা রেল সেবা নেই। গণপরিবহণ বলতে শুধু ট্যাক্সি এবং মোটর সাইকেল। প্রচলিত প্যাকেজ মূল্যের প্রায় সবই আমাদের সাধ্যের বাইরে। ট্যাক্সি ভাড়া করতে গেলেও লাখ লাখ রুপাইয়ার হিসাব। বাকি থাকে মোটর সাইকেল। সেও মিলবে কি না অনিশ্চিত। তারপরও আশায় বুক বেঁধে বের হয়েছি। এতক্ষণ লক্ষ্য করা হয়নি পাশের টেবিলে সকালের নাস্তা সাজিয়ে রাখা। হোটেলের পক্ষ থেকে অতিথিদের জন্য অতিরিক্ত সেবা। হঠাৎ আবিষ্কৃত এমন বন্দোবস্ত পেয়ে আমরা পুলকিত। সাথে কফিও আছে। বাঁশের তৈরি ডালিতে সব কিছু সাজিয়ে রাখা এবং ফ্লাস্কে গরম পানি।



নাস্তা তো হলো, এখন যেভাবেই হোক ভ্রমণ স্বার্থক করে তুলতে হবে, আপাতত মাথাজুড়ে এই একই ভাবনা। জালান বুয়ানাকুবু থেকে বেরিয়ে হাঁটছি আর হাঁটছি। ভ্রমণ নিয়ে অনিশ্চয়তা নতুন কিছু নয়। আমাদের মত পর্যটকদের ভ্রমণগুলি কোন দিনই সৌখিন নয়। কাজেই অনিশ্চয়তা সর্বক্ষণ পিছু লেগে থাকবে এটা স্বাভাবিক। এতদিনে অর্জিত অভিজ্ঞতার ফলস্বরূপ মনের মধ্যে যে আত্মবিশ্বাসের বিনির্মাণ হয়েছে তা এক বিরাট সম্পদ। সেই সম্পদের উপর ভরসা আছে বলেই এ ধরনের অনিশ্চয়তা আর গায়ে লাগে না। দেখা যায় পথে বের হলে ব্যবস্থা একটা হয়ে যায়। গলি পথ থেকে বেরিয়ে চওড়া রাস্তায় চলে এসেছি। রাস্তার পাশে স্থাপনা ও বৃক্ষের লকলকে সবুজ ছাপিয়ে ঐ দূরে নীল রেখার মত দেখা দিয়েছে সমুদ্র। কড়া রোদ উঠেছে সাথে ফুরফুরে বাতাস। আপাতত এই রাস্তা ফুরালো তবে তা মিশে গেল আর এক বড় রাস্তায়। অনেক গাড়িঘোড়া চলছে তবে তার সবই ট্যাক্সি আর মোটর সাইকেল। বামে মোড় নিয়ে দুই মিনিট এগিয়ে চোখে পড়ল গাছের ছায়ায় দুই-তিনটি ভাঙা স্কুটি। স্কুটি সারাইয়ের দোকান কিন্তু কোনো মানুষ নেই, ফাঁকা পরে আছে। ভাঙ্গা টেবিলে গোটা বিশেক এবসুলুট ভদকার বোতল। বোতলগুলি রঙ্গিন তরল পদার্থে পূর্ণ। চলতি পথে আরও কয়েক জায়গায় এমন দৃশ্য চোখে পড়লে একটু অবাকই বনে গিয়েছিলাম। এবার বিষয়টি পরিস্কার হলো- চলতি পথে যানবাহণে পেট্রোলের যোগান দিতে এই ব্যবস্থা। তবে পাত্র হিসেবে শুধু ভদকার বোতলই কেন তা আরও ভাবনার দাবি রাখে বিধায় আপাতত মনোযোগ ফিরিয়ে নিলাম।

একটি স্কুটির ব্যবস্থা করতে হবে। ভাঙ্গা স্কুটির পাশে লাম্বা একটি বেঞ্চ। বসতেই একজন নারী এগিয়ে এলেন। এক কথা, দুই কথায় জানতে চাইলাম স্কুটি ভাড়া নেয়ার উপায় কী? সাথে সাথে কাউকে ফোন দিলেন। কথা শেষে বললেন একটু অপেক্ষা করুন, দেখি কি করা যায়। পনের মিনিট পর দোকানদার এলেন। অল্পক্ষণেই সম্পর্ক পৌঁছে গেল হাসি-ঠাট্টায়। বাংলাদেশ থেকে এসেছি জানার পর বললেন, ‘ও টেরোরিস্ট!’ তারপর বিরাট গালভরে হা হা করে হেসে উঠলেন। ঠাট্টার ছলে হোক বা যে কোনো ধরণের সম্পর্কের খাতিরেই হোক, এমন নেতিবাচক সমার্থক সম্বোধন বোধহয় কারও প্রত্যাশিত নয়। একই সাথে বিষয়টি ভাবনারও বটে। দিনে দিনে বহির্বিশ্বে আমাদের পরিচয় কি তাহলে এমনভাবেই উচ্চারিত হচ্ছে! যাহোক, সব শেষে ফলাফল দাঁড়াল স্কুটির কোনো ব্যবস্থা তিনি করতে পারলেন না। তবে কোথায় গেলে পাওয়া যাবে সেই তথ্য দিয়ে দিলেন। তিনি কি কারণে স্কুটির ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হলেন তা অস্পষ্ট। কারণ তিনি যদি নাই পারবেন তাহলে খামাখা আমাদের এতক্ষণ অপেক্ষায় রাখলেন কেন?



যেতে হবে কুত বা কুতা বালি নামক জায়গায়। হাত তুলে সাত-আটটি ট্যাক্সি ইশারা দেয়া শেষ। কেউ থামে না। দেখা যাক না, হাঁটতে থাকি। শুধু শুধু একজায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করার মানে হয় না। পথের ধারে একাকি এক দোকান। মাথার উপর ছাতার মতো একটি গাছ। গাছের ছায়ায় জমে উঠেছে কয়েকজন মানুষের আড্ডা। দোকানে মালপত্র চোখে পরার মত নয়। তবে সব কিছু এড়িয়ে চোখে পরছে কেবল কয়েক বাঁধা ডাব। প্রতিটি ডাবের আকার দেড়-দুই কেজি চালের ভাত রান্ন করা যায় এমন একেকটি হাড়ির সমান। অনেকটা পথ চলে এসেছি, তৃষ্ণা নিবারণে এই চিত্তাকর্ষক ডাবের কোন বিকল্প হতে পারে না। এক ডাবের মূল্য তের হাজার রুপাইয়া। এখানে আসার পর থেকে মূল্য পরিশোধের ব্যাপারটি আমার নিকট বেশ ভালো লাগছে। কথায় কথায় হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ বের করতে হয়। তের হাজারের ডাব কেটে বড় একটি থালিতে রাখা হলো। তারপর নলের সাহায্যে পান করা ইন্দোনেশিয়ার হাড়ি সমান ডাব। সুমিষ্ট পানি, দুই জনে এক ডাব শেষ করতে হাপিয়ে উঠলাম। এখানেই মিলে গেল ট্যাক্সি। পঞ্চাশ হাজারে কুতার সাময়াক। ভালো মানের মোটর সাইকেল অথবা স্কুটি আছে ট্যাক্সি চালক এমন একটি দোকানে নামিয়ে দিলেন। অত্যাধুনিক নকশার বেশ কয়েকটি মোটর সাইকেল সাজানো। একজন বর্ণনা করলেন কোনটির ভাড়া কত। প্রক্রিয়া জটিল ও ইন্টারনেটভিত্তিক হওয়ায় এখানে কোনো ব্যবস্থা করা গেল না। আরও দু’একটি দোকান ঘুরে মূল সড়ক থেকে প্রবেশ করলাম অপেক্ষাকৃত ছোট গলিতে। এক পথচারী বলেছেন এই গলি ধরে দশ মিনিট এগিয়ে গেলে সহজ উপায়ে স্কুটি পাওয়া যেতে পারে। দশ মিনিটের আগেই ঠিকানা পেয়ে গেলাম।



ভেতরে প্রবেশ করে বাড়ির উঠান। মাঝখানে ছাউনির নিচে মূর্তি এবং তার সামনে কিছু ফুল পাঁপড়ি ছড়ানো। আশাপাশে বেশ কিছু ফুল গাছ কিন্তু মানুষের অস্তিত্ব নেই। পাশেই স্কুটি সার করে রাখা। এতক্ষণে একজন এগিয়ে এলেন। এক দেখাতেই বলে বসলেন, ইন্ডিয়ান? অর্থাৎ আমরা ইন্ডিয়ান কি না। এমন জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য যা বলার তা শেষ। সব কিছু জানার পর স্কুটি দেবেন কি দেবেন না তা নিয়ে যেন সামান্য দুশ্চিন্তায় পরে গেলেন। এরই মধ্যে সার করে রাখা স্কুটির মাঝ থেকে একটি পছন্দ করা সারা। তার চিন্তার কারণ কী হতে পারে? কোন বাংলাদেশী পাসপোর্টধারীকে স্কুটি ভাড়া দিতে যাচ্ছেন তাই? আমার অনুমান যে সঠিক, কিছুক্ষণ পর তার নিজ মুখেই তা উচ্চারিত হলো- ব্যবসায়ী জীবনে আমরাই প্রথম বাংলাদেশী যারা তার দোকানে স্কুটি ভাড়া করতে এসেছি।

দুই দিনের ভাড়া এক কি দেড় লাখ। জমা দিতে হল শুধু পাসপোর্টের ফটো কপি। নিয়ম অনুয়ায়ী ট্যাঙ্কিতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ তেল ভরে দিয়ে চাবি হাতে তুলে দিলেন। এবার ‘শুভ বিদায়’ বলে রওনা। সাড়ে সতের হাজার দ্বীপের দেশ ইন্দোনেশিয়া। আমাদের অবস্থান তার মাত্র একটিতে। এর বাইরে যাওয়ার আপাতত কোনো সুযোগ নেই। অতএব, পঙ্খিরাজ স্কুটির ঘারে চেপে চষে বেড়াব বালি দ্বীপের আনাচে-কানাচে!



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়