ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

কেমন হলো ঢাকা লিট ফেস্ট?

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৪, ১২ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কেমন হলো ঢাকা লিট ফেস্ট?

মাছুম বিল্লাহ: তিনদিনব্যাপী অষ্টম ঢাকা লিট ফেস্টের পর্দা নামল। ২০১১ সালে ‘হে ফ্যাস্টিভ্যাল’ নামে যে আয়োজনের  যাত্রা শুরু, ২০১৫ সালে তার নতুন নাম  হয়- ঢাকা লিট ফেস্ট। এটি এখন একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব। এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে এ সময়ের লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে এবং উত্তরোত্তর এর পরিসর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ৯০টির বেশি অধিবেশন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৫টি দেশের দুই শতাধিক কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-প্রকাশক- সব মিলিয়ে জমজমাট এক সাহিত্য উৎসব। সেশনগুলাতে নানাদিকে আলোকপাত করা হয়। এটি হলো শিল্পের বৈচিত্রকে উদযাপন করা। এর মধ্য দিয়ে বহুত্ববাদী একটি জায়গা তৈরি হলো। ফলে দেশের ও বিশ্বের মানবতার বর্তমান সংকট ও আগামী সম্ভাবনা জেগে উঠেছিল অশংগ্রহণকারীদের কথায়, আলোচনায় ও বিশ্লেষণে। ফেস্টের ভেতরের শক্তির সৌন্দর্য মানুষের আগ্রহ ধরে রেখেছে। সেই শক্তিটি হলো দেশের সীমানায় বিশ্বের আহ্বান শুনতে পাওয়া। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা ভাষা ও সাহিত্যের খ্যাতনামা মানুষ এসে বলেছেন তাদের নিজেদের কথা, অন্যদিকে  আমরা আমাদের দেশে বসে তাদের কথাগুলো শুনতে পেরেছি। জানতে পেরেছি তাদের সাম্প্রতিকতম পরিস্থিতি।

আমাদের বিখ্যাত অনেক লেখকের কালজয়ী রচনাবলী বাংলার বাইরে প্রচারিত হয়নি। সোমালিয়া বা আলবেনিয়ার মতো অনেক ছোট বা সংকটময় দেশের লেখকরাও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত। তারা পেয়েছেন গ্লোবাল মর্যাদা।  অথচ বাংলা সাহিত্যের সমকালীন অনেক বিখ্যাত লেখক রয়েছেন যাদের লেখা পৃথিবীতে এখনও অনেকটাই অচেনা, অজানা। তাই প্রয়োজন এগুলোকে বিশ্বের মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া সাবলীল সহজ অনুবাদের মাধ্যমে। আমাদের যেমন পড়তে হবে বিশ্বসাহিত্য, তেমনি আমাদের সাহিত্যকেও বিশ্ব দরবারে নিয়ে যেতে হবে। ঘটাতে হবে তাদের এবং আমাদের ভাবনার মিথস্ক্রিয়া। সেই কাজটি করার চমৎকার এক মঞ্চ হচ্ছে ঢাকা লিট ফেস্ট।

এ উৎসবে বিভিন্ন ভাষা থেকে বাংলায় এবং বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদে বই প্রকাশিত হয়। এবার বাংলাদেশের কবি মোহাম্মদ রফিকের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বিখ্যাত অনুবাদক ক্যারোলিনা ব্রাউন দীর্ঘদিন ধরে তার কবিতা অনুবাদ করে আসছিলেন। কিন্তু সেটি প্রকাশিত হচ্ছিল না। এবার সেই সুযোগ হলো। কথাশিল্পী মোস্তফা কামালের তিনটি উপন্যাস ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। এখানে ছিল দেশি-বিদেশি বইয়ের সম্ভার। একে একটি বিকল্প বইমেলাও বলা যায়। বিদেশের বইপত্রের চোখধাঁধানো এক সম্ভার বিপুল মানুষের সামনে হাজির করার সুযোগ ছিল এটি। আমরা জানি সাহিত্যের সঙ্গে এখন জমেছে ব্যবসা। কারণ লেখকের সৃষ্টি তার কাছে মূল্যবান। কিন্তু এর প্রকাশক ও বিক্রতার কাছে এটি পণ্য। ফলে এই পণ্যের মান, গুণ ও সঠিক বিপণনের ভার ও দায়িত্ব তাদের উপর। এই লিট ফেস্টে বাণিজ্যের সঙ্গে মিলেছে এক অনিন্দ্য নান্দনিকতা। লিট ফেস্টের মতো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এবং আরও বহুভাবে বিশ্বসংস্কৃতির ভাণ্ডার থেকে আমরা নিচ্ছি, ঋদ্ধ করছি আমাদের লেখা, সাহিত্য। অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় আলাপে আমাদের সংস্কৃতিও নতুন বিবেচনায়, নতুন করে যাচাইয়ের সুযোগ ঘটেছিল এই ফেস্টের মাধ্যমে।

ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ফিলিপ হেনশের, বুকারজয়ী ঔপন্যাসিক জেমস মিক, কলকাতার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সাংবাদিক হুগো রেস্টন, প্যাট্রিক উইন, নন্দিত অভিনেত্রী ও পরিচালক নন্দিতা দাস, বলিউড অভিনেত্রী মনীষা কৈরালা, ব্রিটিশ অভিনেত্রী টিলডা সুইনটন, পুলিৎজার বিজয়ী মার্কিন সাহিত্যিক অ্যাডাম জনসন, পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ লেখক মোহাম্মদ হানিফ,  ভারতীয় জনপ্রিয় লেখিকা জয়শ্রী মিশ্র, লন্ডন ন্যাশনাল একাডেমি অব রাইটিংয়ের পরিচালক রিচার্ড বিয়ার্ড, ভারতীয় লেখিকা হিমাঞ্জলি শংকর, শিশুতোষ লেখিকা মিতালি বোস পারাকিন্স, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এশিয়ার প্রধান হুগো রেস্টল, মার্কিন সংবাদিক প্যট্রিক উইন, লেখক ও সাংবাদিক নিশিদ হাজারি প্রমুখ এবারকার লিট ফেস্টকে সমৃদ্ধ করেছেন। গত আট বছরে ৫০টি দেশের ৩৩০ জন অতিথি এসেছেন এই উৎসবে। এবার  নারীকে তুলে ধরা হয়েছে ভিন্নভাবে- নন্দিতা দাসের ছবি, ছয় নারী কবি, রোহিঙ্গা নারীদের কথা, নারী বাউল শিল্পীসহ নারীদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্যহারে।

ঢাকা লিট ফেস্ট কি শুধুই সাহিত্যের আসর? এবার নন্দিতা দাস এসেছিলেন তাঁর সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘মান্টো’ নিয়ে। সাহিত্য বাদ দিয়ে চলচ্চিত্র হয় না। আর সাহিত্যের চরিত্রগুলোকে জীবন্ত করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন অভিনয়শিল্পীরা। এ যোগসূত্রের অভিজ্ঞতা পাঠক আর লেখকের আগ্রহের বিষয়। তাই এই শিল্পীদের কাছ থেকে তাদের অভিজ্ঞতার কথা শোনার সুযোগ করে দিয়েছিল এই সাহিত্য উৎসব। উৎসবের প্রথম দিন ‘মান্টো’র প্রদর্শনী হয়। এরপর এ ছবি নিয়ে ‘ডিরেক্টরস কাট’ অধিবেশনে কথা বলেছেন নন্দিতা দাস। অসাধারণ এক মানুষের উপর তৈরি এই চলচ্চিত্র। উর্দু সাহিত্যের এক অনন্য প্রতিভা সাদাত হাসান মান্টোকে ভারত ও পাকিস্তানের দুই দেশই তাদের লোক মনে করেন। তাঁর উপর ২০১৫ সালে পাকিস্তানেও ‘মান্টো’ নামেই ছবি তৈরি হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় পাঞ্জাব ও বাংলাকে বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তানকে একেক টুকরো করে দেওয়া হয়। এ সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পাঞ্জাব ও বাংলার অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারান। লাখ লাখ মানুষ বাস্তচ্যূত হন।  দেশ বিভাগের এই নির্মমতার ছবি একে যে কজন উর্দু লেখক উর্দু সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট ধারা প্রবর্তন করেছেন, তাঁদের পুরোভাগে আছেন মান্টো। তাঁর লেখার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ ওঠায় বারবার তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতে যেমন তেমনি পাকিস্তানেও। সব সময় দুই দেশের মুক্তমনা মানুষ তার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। নিজের লেখা সম্পর্কে আদালতে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন, আমি তো পর্নোগ্রাফি লেখক নই, আমি সাহিত্যিক। আমার চোখের সামনে যা ঘটেছে, যা দেখতে পেয়েছি তাই লিখেছি, তাতে আপত্তি কেন?  তার লেখা সমাজের রূঢ়, অপ্রিয় বাস্তবতা, অসংগতির অকুণ্ঠ প্রকাশ সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিচলিত করে তুলত। তাকে জরিমানাও দিতে হয়েছে। দেশে দেশে  লেখকদের উপর এখনও নিপীড়ন বন্ধ হয়নি। এমনকি বিশ্বব্যাপী ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়া হচ্ছে বাকস্বাধীনতা। কিন্তু সৃজনশীল মানুষ থেমে থাকে না।

লিট ফেস্টের মহত্ত্ব এখানেই যে, জ্ঞান বিজ্ঞানের সব শাখা একই মঞ্চে উঠে এসেছে। প্রথম দিকে বিষয়গুলো এমন  ছিল না। আসর যত এগিয়ে যাচ্ছে, তত সম্প্রসারিত হচ্ছে বিষয় বৈচিত্র। সাহিত্য মানবজীবনের কোন বিষয় থেকেই বিচ্ছিন্ন নয়। সাহিত্য এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি যৌগিক শিল্পক্ষেত্র। একটু পেছনে ফিরে তাকালে আমরা দেখব উন্নয়নের নানা সমীক্ষায় আমরা এশিয়ার অনেক দেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি। এখন প্রয়োজন সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশকে বিশ্বে তুলে ধরা। এই আয়োজন তার একটি দুয়ার। বিশ্বের খ্যাতনামা লেখকদের পাশাপাশি মেধাবী তরুণ লেখকদের সঙ্গে আমাদের দেশের লেখকদের সাক্ষাৎ মাতবিনিময় ঘটছে। পরস্পর তারা শিল্পধারা, প্রবণতা ও উপস্থাপনা শৈলি সম্পর্কে অবগত হচ্ছেন। এগুলো কম অর্জন নয়। দৃশ্যত, প্রাপ্তির মধ্যে দেখা যায়, ক্যামব্রিজ শর্ট স্টোরি প্রাইজ কর্তৃপক্ষ লিট ফেস্টের মঞ্চকে তাদের পুরস্কার লঞ্চ করার জন্য বেছে নিয়েছে। এখানেই প্রথমবারের মতো এই পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে তারা। আন্তর্জাতিক সাহিত্য পত্রিকা গ্রান্টা ম্যাগাজিন একমাত্র বাংলাদেশের এই আয়োজনের সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মতো পার্টনার হিসেবে যুক্ত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের লেখকদের বই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে ‘সি গাল’ নামে একটি ভারতীয় প্রকাশনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঢাকা লিট ফেস্ট কর্তৃপক্ষ। লিট ফেস্টের বদৌলতে অস্কারবিজয়ী ব্রিটিশ অভিনেত্রী টিলডা সুইনটন বাংলাদেশের বয়স্ক শিক্ষাকে তাঁর একটি চলচ্চিত্রে যুক্ত করেছেন। তিনি ছবিটির শুটিং করবেন বাংলাদেশে। শব্দের শক্তিকে উদযাপন করার উৎসব এটি। বহু মানুষ বাংলায় কথা বলেন অথচ তার সাহিত্য সম্পর্কে  বিশ্বের বড় কোন ধারণা থাকবে না এটি কেমন কথা?  বাংলা ভাষার পাঠকরাও যাতে বিশ্বসাহিত্যের খবর কম না রাখেন  এই দুরত্ব ঘোঁচাতেই  শুরু হয়েছে এই সাহিত্য উৎসব। আমি মনে করি, বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের জন্য এই উৎসব একটি মাইলফলক হিসেবে দেখা দিয়েছে। আমরা যাদের বই পড়ি, সিনেমা দেখি যাদেরকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেখি, বক্তৃতা শুনি ইউটিউবে তাদের স্বশরীরে দেখতে পাওয়ার এক অপূর্ব সুযোগ। তাদের জীবন ও শিল্পচর্চার নানা প্রেক্ষিত ও প্রেক্ষাপটের কথা শোনার বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে এই ফেস্টের মাধ্যমে। ছোটখাট ভুল ত্রুটি ছাড়া বেশ সফলভাবেই শেষ হয়েছে ঢাকা লিট ফেস্ট।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ নভেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়