ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কেমোথেরাপি যেভাবে কাজ করে

এস এম গল্প ইকবাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৬, ৩০ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কেমোথেরাপি যেভাবে কাজ করে

কোনো সন্দেহ নেই, ক্যানসার দমন করার একটি শক্তিশালী অস্ত্র কেমোথেরাপি। কিন্তু এটি কীভাবে কাজ করে? পাঠক চলুন তার আগে জেনে নেই কেমোথেরাপী কি?

সাধারণত ক্যানসারের চিকিৎসার সঙ্গে কেমোথেরাপির সম্পৃক্ততা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে শব্দটি চিকিৎসায় ব্যবহৃত যেকোনো ওষুধকেই বুঝানো হয়। ক্যানসার দমনের অন্যান্য থেরাপির (যেমন- সার্জারি ও রেডিয়েশন থেরাপি) চেয়ে কেমোথেরাপি ভিন্ন। কারণ এ থেরাপিতে শরীরের কোনো নির্দিষ্ট স্থানের পরিবর্তে পুরো শরীর প্রভাবিত হয়।

শরীরের একটি স্থান থেকে অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়া ক্যানসারের চিকিৎসায় কেমোথেরাপি ব্যবহার করা হয়। কেমোথেরাপির প্রধান লক্ষ্যগুলো হচ্ছে:

* ক্যানসার পুরোপুরি ধ্বংস করা (সর্বোত্তম ফলাফল)

* ক্যানসার ছড়ানো ও বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করা

* প্যালিয়েশন বা রোগের উপসর্গ বা ব্যথা প্রশমিত করা।

ক্যানসারের ধরন, রোগীর মেডিক্যাল ইতিহাস, শারীরিক স্থানের প্রকৃতি, শারীরিক ওজন, বয়স ও ক্যানসারের পর্যায়ের ওপর কেমোথেরাপির ডোজ, শিডিউল ও ওষুধ নির্ভর করে। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কতবার কেমোথেরাপি দিতে হবে রোগীভেদে ভিন্ন হতে পারে।

কেমোথেরাপি কীভাবে ক্যানসার নিরাময় করে?

কেমোথেরাপির সর্বোচ্চ কার্যকরণ হচ্ছে ক্যানসার পুরোপুরি নির্মূল করা। এর মানে হলো ক্যানসার কোষগুলো পুরোপুরি ধ্বংস করা ও সেগুলো আর ফিরে আসবে না। অধিকাংশ চিকিৎসক ক্যানসারের ক্ষেত্রে ‘কেমোথেরাপি’ শব্দটি ব্যবহার করেন না, যদিও তারা থেরাপির সম্ভাব্য ফল হিসেবে শব্দটি মেনশন করতে পারেন। অন্যান্য ওষুধ সম্পর্কিত চিকিৎসার মতো কেমোথেরাপিতেও গ্যারান্টি নেই যে পুরোপুরি নিরাময় হবে, যদিও ক্যানসারের চিকিৎসায় এটাই হচ্ছে চূড়ান্ত লক্ষ্য। কেমোথেরাপি শুরু করার পর অনেক বছর ধরে এটা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে এবং থেরাপিতে শরীরের সকল ক্যানসার কোষ ধ্বংস নাও হতে পারে।

কেমোথেরাপি কীভাবে ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ করে?

ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, কেমোথেরাপিতে ক্যানসার পুরোপুরি নিরাময় হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। যেখানে কেমোথেরাপির পক্ষে ক্যানসার সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব হয় না, সেখানে এই থেরাপি অন্তত ক্যানসারের বিকাশ ও ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এটি টিউমার সংকুচিত করতে পারে এবং উৎপত্তির স্থানে আটকে রাখতে পারে। যদিও অধিকাংশ সময় কেমো ক্যানসারের সকল পদচিহ্ন দূর করতে পারে না, কিন্তু ক্রনিক রোগের ব্যবস্থাপনায় এই থেরাপি বিশেষ কার্যকর হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি দিয়ে শুরুতে সফলভাবে ক্যানসারের চিকিৎসা করা গেলেও পরবর্তীতে ফিরে আসে। এ ধরনের ঘটনায় পুনরায় কেমোথেরাপি দেয়া যেতে পারে।

কেমোথেরাপি কীভাবে উপসর্গের তীব্রতা কমায়?

ক্যানসার রোগীদের জন্য কেমোথেরাপির শেষ প্রধান ব্যবহার হচ্ছে প্যালিয়েশন, যেখানে ক্যানসারের উপসর্গ প্রশমন করা হয়। এই থেরাপিকে সাধারণত প্যালিয়েটিভ কেমোথেরাপি বলা হয়। আরো সরলভাবে বলতে গেলে প্যালিয়েশন বলতে পারেন। সাধারণত ক্যানসার দ্বারা সৃষ্ট উপসর্গের মাত্রা কমাতে প্যালিয়েশন ব্যবহার করা হয়।

সাধারণত অগ্রসর বা শেষ পর্যায়ের ক্যানসারে এই থেরাপি প্রয়োগ করা হয় এবং এটি ইতোমধ্যে গেড়ে বসা দীর্ঘস্থায়ী ক্যানসার ছড়ানো নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করতে পারে না। এ অবস্থায় ব্যথা বা চাপ সৃষ্টিকারী এক বা একাধিক টিউমারকে সংকুচিত করতে প্যালিয়েটিভ কেমোথেরাপি দেয়া হয়।

কেমো চিকিৎসা কীভাবে কাজ করে?

কেমোথেরাপি প্রয়োগের পর ওষুধ রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে রোগীর শরীরে পৌঁছে যায়। একারণে এটিকে এক ধরনের সিস্টেমিক ট্রিটমেন্ট বলা হয়। ওষুধগুলো এমনভাবে তৈরি করা, যেন ক্যানসার কোষকে টার্গেট করে দুটি কোষের বিভাজিত হওয়ার প্রক্রিয়া ধ্বংস করতে পারে। মানব শরীরে বিলিয়ন বিলিয়ন কোষ রয়েছে। যখন তারা পূর্ণ বিকশিত হয়, সাধারণত অধিকাংশ কোষই বিভাজিত হয় না ও সংখ্যা বৃদ্ধি করে না। কিন্তু শরীরের কিছু ড্যামেজ মেরামত করতে কোষের বিভাজন হতে পারে। এ অবস্থায় নিয়ন্ত্রিত ও অনুমেয় উপায়ে কোষের বিভাজন ঘটে। যুক্তরাজ্যের ক্যানসার রিসার্চের প্রতিবেদনে বলা আছে, ‘যখন কোষের বিভাজন ঘটে তখন ২টি অভিন্ন নতুন কোষে বিভাজিত হয়। এভাবে ১টি কোষ ২টি, ২টি কোষ থেকে ৪টি ও এই ৪টি কোষ থেকে ৮টি কোষের বিভাজন ঘটে। প্রয়োজন অনুসারে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে।’

অন্যদিকে ক্যানসার কোষগুলো কোষের একটি গোটা বা পিণ্ড তৈরি না করা পর্যন্ত বিভাজিত হতেই থাকে। ক্যানসার কোষের এ পিণ্ডকে টিউমার বলা হয়। যেহেতু ক্যানসার কোষগুলো প্রতিনিয়ত বিভাজিত হয়, তাই কেমোথেরাপির ওষুধ দ্বারা সেগুলো প্রভাবিত হওয়ার সর্বোচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে একই সময়ে এর পাশাপাশি স্বাভাবিক কোষের বিভাজনজনিত ড্যামেজও কেমোর আওতায় আসতে পারে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, কেমোথেরাপির এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়ানোর সম্ভাবনা খুব কম।

শরীরে সরবরাহকৃত কেমোর ওষুধ নিউক্লিয়াসে ক্যানসার কোষের জিন ধ্বংস করে অথবা ক্যানসার কোষ বিভাজনের সময় বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের ক্যানসার রিসার্চের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘কিছু ড্রাগস বিভাজনের শুরুতে ক্যানসার কোষ ধ্বংস করে। কিছু ড্রাগস বিভাজনের পূর্বে সকল জিন নকল করার সময় ক্যানসার কোষ ধ্বংস করে। কেমোথেরাপি দ্বারা অবশিষ্ট কোষ বা অধিকাংশ স্বাভাবিক কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা খুব কম। একজন ক্যানসার রোগীর বিভিন্ন কেমোথেরাপি ওষুধের সমন্বয় প্রয়োজন হতে পারে। এর মধ্যে এমন ওষুধ রয়েছে যা ক্যানসারের বিভিন্ন পর্যায়ে কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ার সময় ক্যানসার কোষকে ড্যামেজ করে- এর অর্থ হলো, বেশি ক্যানসার কোষ মারা যাওয়ার অধিক সম্ভাবনা রয়েছে।’

কেমোথেরাপির সফলতা কেমন?

কেমোথেরাপির সফলতার সম্ভাবনা নির্ভর করে ক্যানসারের ধরনের ওপর। উদাহরণস্বরূপ, অণ্ডকোষের ক্যানসার ও হজকিন লিম্ফোমার ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি খুব বেশি কার্যকর হতে পারে। কিন্তু অন্যান্য ক্যানসারের ক্ষেত্রে কেমো নিজে নিরাময় দিতে পারে না। এসব ক্ষেত্রে কেমো অন্যান্য চিকিৎসার প্যাকেজের অংশ হিসেবে কাজ করে। স্তন ক্যানসার অথবা অন্ত্রের ক্যানসারে প্রধান চিকিৎসা হচ্ছে সার্জারি, যেখানে ক্যানসারের প্রত্যাবর্তন প্রতিরোধে কেমোর কোর্সও সংযোজন করা হয়।

কেমো ক্যানসার নির্মূল করুক কিংবা না করুক, টিউমার সংকুচিত করতে, রোগের উপসর্গ থেকে মুক্তি পেতে ও জীবনের মান বাড়াতে রোগীরা এ থেরাপি গ্রহণের কথা বিবেচনা করতে পারেন।

২০০৬ সালের একটি গবেষণায় ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের কেমোথেরাপির সফলতার হার নির্ণয় করা হয়। গবেষক দল ৭৬১ টিউমার স্যাম্পল সংগ্রহ করেন। তারা আবিষ্কার করেন, যে টিউমারে ইআরসিসি-১ নামক বিশেষ প্রোটিনের উপস্থিতি রয়েছে সেখানে কেমোর কার্যকারিতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। গবেষণার ফল হচ্ছে, যেসব টিউমারে এই প্রোটিনের ঘাটতি ছিল সেগুলোতে কেমোর কার্যকারিতা বেশি ছিল এবং এসব টিউমারের রোগীরা গড়ে দেড় বছর বেশি সময় বেঁচেছিলেন। কিন্তু ইআরসিসি-১ বহনকারী টিউমারে কেমোর কার্যকারিতা উল্লেখ করার মতো ছিল না। আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির ২০১৬-১৭ সালের রিপোর্ট অনুসারে ক্যানসারে কেমোর চিকিৎসাজনিত বেঁচে থাকার হারকে সন্তোষজনক বলা যায়।



ঢাকা/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়