ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

গানেই ইতিহাস ।। বুলবুল মহলানবীশ

শাহনেওয়াজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৩, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গানেই ইতিহাস ।। বুলবুল মহলানবীশ

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

কবে আসবে স্বাধীনতা? আর কত দিন? তারপর একদিন এলো সেই বহুল প্রতীক্ষিত সময়। ১৬ ডিসেম্বর সকাল এগারোটা কি সাড়ে এগারোটার দিকে শুনতে পেলাম এদিন বিকেল চারটায় (ঢাকার সময়) রমনার রেসকোর্স ময়দানে জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করবেন। বেতার কেন্দ্রে সবার চোখে-মুখে-দেহে আনন্দের সাড়া পড়ে গেল।

 

সংগীতশিল্পীদের ডাক পড়ল বেতার কেন্দ্রের নিচের হলঘরটায়, যেখানে তখন রিহার্সাল হতো। কণ্ঠশিল্পী এবং যন্ত্রী মিলিয়ে আমরা প্রায় পঁচিশ-তিরিশ জন জড়ো হয়েছি সেখানে। শহীদুল ইসলাম একটা গানের স্থায়ী আর প্রথম অন্তরা লিখেছেন। দিয়েছেন শ্যামদাকে সুর করতে। শ্যামদা সুর করে অজিতদাকে শুনিয়েছেন। তখনো দ্বিতীয় অন্তরা লেখা হয়নি। অজিতদা আর শ্যামদা আমাদের সবাইকে নিয়ে বসলেন। অজিতদা গাইলেন :
বিজয় নিশান উড়ছে ওই...
আমরা ধরলাম : উড়ছে ওই, উড়ছে ওই, উড়ছে ওই...
এভাবে অজিতদা লিড ভয়েস দিচ্ছেন আর আমরা সবাই সমবেত কণ্ঠে তার সঙ্গে ধুয়া ধরছি। স্থায়ী এবং প্রথম অন্তরা শেখা হয়ে গেল। এর মধ্যে শহীদ ভাই দ্বিতীয় অন্তরাও লিখে ফেলেছেন। সঙ্গে সঙ্গে সুরও হয়ে গেল। অবশ্য সেটা প্রথম অন্তরার মতোই। আমরা সঙ্গে সঙ্গে শিখেও নিলাম।

 

আমরা রিহার্সেল করছি। আমি বাইরের জানালার দিকে মুখ ফিরে বসে। হঠাৎ দেখি লালাবাবু, আমার স্বামী, বাইরে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আমি রিহার্সেল ভুলে ঝট করে উঠে দাঁড়াতেই অজিতদা দিলেন এক ধমক। আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়াতে লাগল। কল্যাণীদি আর রথীনদাও লালাবাবুকে দেখেছেন। ওরা চেনেন লালাবাবুকে। লালাবাবু যে মুক্তিযুদ্ধে ৫নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার, সে কথা অনেকেই জানে। ওরা লালাবাবুর কথা জানাতেই অজিতদা খুব আদার করে বললেন, ‘ও, এই কথা! আচ্ছা যা-কিন্তু একবার দেখা করেই চলে আসিস। একটু পরেই গান রেকর্ড করব।’ আমি পড়ি-কি-মরি করে ছুটতে লাগলাম।

 

বাইরে এসে দেখি লালাবাবু নেই। এদিক খুঁজি, ওদিক খুঁজি- কোথাও নেই। নেই তো নেই-ই। আমার ছোট বোন শুক্তিও এসেছিল আমার পেছন পেছন। সে-ও এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করে নিরাশ হয়ে ফিরে এলো। বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল। আমি কি তবে ভুল দেখলাম? ও কি এখনো যুদ্ধক্ষেত্রে! সিঁড়ির ওপর মুখ ঢেকে বসে পড়লাম। আমার দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিও রইল না। ওদিকে ভেতর থেকে গানের শব্দ ভেসে আসছে- অন্ধকারের আঁধার থেকে ছিনিয়ে আনব বঙ্গবন্ধুকে...

 

হঠাৎ মাথায় হাতের স্পর্শ পেয়েই লাফিয়ে উঠলাম। গলার ভেতর যেন হিমালয় পর্বত আটকে আছে। কোনো কথা বের হচ্ছে না। শুক্তি আমার অবস্থা দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় ছিলেন জামাইবাবু? রিহার্সাল থেকে বেরিয়ে এসে আপনাকে কত খোঁজাখুঁজি করলাম! মিনিটের মধ্যে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন?’ মাত্র ১২ বছরের মেয়ের ভেতরের প্রচ- উদ্বেগ প্রশ্ন হয়ে বেরিয়ে এলো! লালাবাবুও ওর প্রশ্নের ধরনে মনে মনে একটু যেন অপরাধবোধে আক্রান্ত হলেন। শুক্তির মাথায় হাত রেখে আদর করে বললেন, সরি, আমার সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছিল। তোমরা রিহার্সেল করছো দেখে রাস্তার উল্টোদিকের দোকানে সিগারেট কিনতে গিয়েছিলাম।

 

রিহার্সেলে একটু বাধা পড়ায় অজিতদাও তাড়াতাড়ি লাঞ্চ ব্রেক দিয়ে দিয়েছিলেন। গানটা সবার তোলাও হয়ে গেছে। লাঞ্চের পরেই রেকর্ডিং হবে। সেদিন প্রায় সবাই মিলে গেলাম পাঞ্জাবি খাবার দোকানে। পুরি-ভাজি, মাংস, আচার-রাইতা দিয়ে খুব মজা করে খেলাম। সবার ভেতরই প্রচণ্ড উত্তেজনা। চারটা কখন বাজবে! আমাদের গানও রেকর্ড করতে হবে তার আগে। বিজয় ঘোষণার প্রথম মুহূর্তেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বাজানো হবে সেই গান :

বিজয় নিশান উড়ছে ওই
খুশির হাওয়ায় ওই উড়ছে
বাংলার ঘরে ঘরে
মুক্তির আলো ওই ঝরছে।

 

বাংলাদেশের বিজয়ের ইতিহাসে এই একটি গানের মাধ্যমেই ইতিহাস হয়ে রইলেন শহীদুল ইসলাম, সুজেয় শ্যাম এবং অজিত রায়। তার অংশীদার হলাম আমরাও।



লেখক : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী


 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ ডিসেম্বর ২০১৫/শাহনেওয়াজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়