ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ঘর্মাক্ত সন্ধ্যায় তুমি

খালিদ মারুফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৭, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঘর্মাক্ত সন্ধ্যায় তুমি

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

|| খালিদ মারুফ ||

প্রজাপতি গুহাপথের দেয়ালগাত্রে ঝোলানো বিশালাকার চিত্রকর্মগুলোর দিকে বার কয়েক তাকিয়ে, কোনো ক্যাপশন না পড়েই তুমি বুঝতে পারবে এগুলি এস এম সুলতানের বিখ্যাত সেইসব ফিগর, কেননা ঝুলন্ত চিত্রগুলির একটিতে থাকবে পেশীবহুল সেইসব মানুষের চিত্র যারা বল্লম আর টেটা হাতে দখলিযুদ্ধে লিপ্ত কিংবা ব্যস্ত ধান মাড়াইয়ে। যদিও এইসব খুঁজতে আজকের এই সন্ধ্যায় তুমি পথে বাহির হও নাই, তোমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে একটি গন্ধ যা গতকাল রাত্রে তোমার নাকে এসে লেগেছে এবং এখনও তা যায় নি।

সেই মোহাবিষ্ট গন্ধ তোমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে এই পথে এবং ঠিকঠাক প্রজাপতি গুহাপথ পাড়ি দিয়ে সমুখের গলিটা দিয়ে কিছুদূর গিয়ে তুমি বুঝতে পারবে, তুমি সঠিক পথে হাঁটছো না। কেননা যেখানে তুমি পৌঁছাতে চাও এই পথ ধরে সেখানে পৌঁছানো হয়তো যাবে তবে তা হবে অনেকখানি ঘূর্ণি পরিক্রমা। তবে তুমি আর,পেছনে ফিরবে না, এই আপাত দীর্ঘপথ হেঁটেই তুমি সেই বিল্ডিংটার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে, যদিও বিল্ডিংটার সম্মুখদেয়ালে ঝোলানো যে আলোকোজ্জ্বল, হতে পারে নিয়ন সাইনের একটি নীল বোর্ড, যা হবে তোমার কাছে অচেনা অথবা নতুন। যদিও তুমি মনে করতে পারবে না যে পূর্বের বোর্ডে ঠিক কী লেখা ছিলো কিংবা কী ছিলো তার রং কিন্তু তুমি নিশ্চিত হতে পারবে যে এই বোর্ডটি সেই বোর্ড নয়। তবে বিল্ডিংটার সামনে তুমি একটা ছোট মানবজটলা দেখতে পাবে আর দেখতে পাবে কাঁচা তরকারি বয়ে আনা নানান সাইজের পিকআপ ভ্যানকে সারবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকতে। এ ছাড়া এই জটলার মানুষগুলোর মধ্যে তুমি আগের মতোই জিজ্ঞাসু উত্তেজনা লক্ষ্য করবে, তাদের প্রত্যেকের হাতে থাকবে সেলফোন যা তারা টিপতে থাকবে মনোযোগহীনভাবে, হয়তো অভ্যস্ততায়।

তুমি তোমার নিরাপদ দূরত্বটা অক্ষুণ্ন রেখেই সামনের চা’য়ের দোকানটিতে গিয়ে দাঁড়াবে। সিগারেট জ্বালাবার পূর্বে তুমি এক গ্লাস পানি পান করবে এবং ততক্ষণে তুমি একজন কালো ও কিছুটা মিষ্টি চেহারার লোককে দেখতে পাবে, যাকে দেখার পর তোমার মনে হবে লোকটা যেন তোমাকেই অবলোকন করছে এবং অন্তিমে তা-ই প্রমাণিত হবে। এর মধ্যে বার দু’য়েক তুমি লোকটার চোখ থেকে নিজের চোখকে আড়াল করবে তবুও লোকটা সামনে এগিয়ে আসবে এবং তোমার কাঁধের সমান্তরালে দাঁড়িয়ে খানিকটা ফিসফিসানির মতো, তবে স্পষ্ট স্বরে জানতে চাইবে তুমি রাত্রি যাপনের জন্য একটা উৎকৃষ্ট রুম চাইছো কি না?

প্রথমত ‘না’বলে সহজ উত্তরটা দিয়ে তুমি তাকে জানাবে যে, তুমি মূলত একটি গন্ধের সন্ধানে এসেছো। একটি অনুচ্চ হাসি দিয়ে লোকটা তোমাকে জানাবে গন্ধের কারবারির সনদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় তা আর আপাতত এখানে নেই, তবে সে তোমার ভরসা পেলে পাশেই একটি উৎকৃষ্ট জায়গায় তোমাকে নিয়ে যাবার প্রস্তাব করবে যেখানে তুমি নাক ডুবিয়ে গন্ধ নিতে পারবে অফুরান। যখন তুমি কাছের জায়গাটার নাম জানতে চাইবে তখন লোকটা তোমাকে ‘তিব্বত ক্রসিং’নামক একটা জায়গার কথা নির্দেশ করবে যদিও তোমার যাতায়াতের পথে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে ওঠা একজন শহরবাসী হিসেবে ‘তিব্বত ক্রসিং’নামক কোনো জায়গা তুমি চিনতে পারবে না। তবে তুমি লোকটার সাথে সেখানেই যেতে সম্মত হবে। তুমি তোমার পরিচিত উদাস ভঙ্গিমায় চারপাশ দেখতে দেখতে টের পাবে লোকটা তোমার জন্য রিকশার দরদাম ঠিক করছে। তারপর তোমরা এক বৃদ্ধের রিকশায় চেপে ‘তিব্বত ক্রসিং’-এর উদ্দেশে যাত্রা করবে। কিছুদূর গেলে দানব রেল তোমাদের কিয়ৎক্ষণের জন্য যাত্রা বিরতিতে ফেলে দেবে। এই সুযোগে তুমি জানতে পারবে তোমার সাথে থাকা লোকটা অথবা তোমার পথপ্রদর্শক একজন অধূমপায়ী। এ ছাড়াও তুমি তাকে জানাবে তুমি তার পার্শ্ববর্তী জেলার মানুষ। এবং তোমাদের ভ্রমণসন্ধ্যাটা হবে টানা হরতাল শুরুর পূর্বের সন্ধ্যা তাই শহরে বেশ খানিকটা ভীতি বিরাজ করবে।

যানবাহনের ঘাটতি দেখা দেবে আর সময়টা যেহেতু কর্মময় মানুষের ঘরে ফেরার তাই রাস্তা ভর্তি মানুষ পোকার মতোই এক অন্যের শরীরে ঘাই খেয়ে খেয়ে প্রত্যেকে প্রত্যেকের বিপরীত দিকে ছুটতে থাকবে বলেই তোমাদের রিকশাটাও চলতে থাকবে কিছুটা ধীর গতিতে। জ্বলতে থাকা প্রতিটি ইলেকট্রিক ল্যাম্পপোস্ট থেকে যে আলোক ঠিকরে বেরুবে তা নগরের আলোকস্বল্পতাকেই অক্ষুণ্ন রাখবে,এবং এই স্বল্প আলোতেও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নিয়োজিত পুলিশ নির্দিষ্ট দূরত্বে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় থাকবে। এভাবে একসময় তোমাদের রিকশাটা দোতলা রাস্তার ঠিক নিচে এসে দাঁড়াবে। তোমরা দু’জনে নেমে দাঁড়ানোর পর তোমার পথনির্দেশক লোকটা আনমনে রাস্তার উল্টাদিকে তাকিয়ে থাকবে এবং ভাড়া পরিশোধের দায়িত্ব পড়বে নিশ্চয়ই তোমার কাঁধে। এই এতটুকু পথের ভাড়া পঞ্চাশ টাকা ন্যায্য কি না এমন একটা ক্ষীণ প্রশ্ন তুমি একবার উত্থাপন করলেও শ্মশ্রুহীন বৃদ্ধ রিকশাচালক তোমাকে জানাবে, পূর্বের যাত্রী তাকে এই পথে এবং একই দূরত্বে সত্তর টাকা পরিশোধ করেছেন, বিধায় তোমার আপত্তিটা আর টিকবে না।

সেখানে দাঁড়িয়ে ও রাস্তা অতিক্রমের পথে তোমার মনে হবে যেন আতঙ্কগ্রস্ত নগরবাসী তাদের নিজ নিজ গৃহের পথ হারিয়ে এখানে এসে মিলিত হয়েছে এবং তারা তাদের হারানো গন্তব্যে ফিরতে অপেক্ষায় আছে একটি যুৎসই নাগরিক বাহনের। আবার তাদের অনেকের মুখে ঘরে ফেরার বাসনা কিংবা উত্তেজনা কোনোটাই থাকবে না, তারা যেন নিশ্চল জনারণ্যে হারিয়ে যাওয়া উদ্বাস্তু বিশেষ।

দ্বিতল রাস্তাটির নিচে গায়ে গা লাগিয়ে চলে যাওয়া চারলেনের বিশাল রাস্তাটি পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়ে তুমি ফুটপাতে উঠে দাঁড়াবে এবং বুঝতে পারবে তোমার গন্তব্য সমাগত। কেননা গতকাল তোমার নাকে লাগা গন্ধটা যেন এইমাত্র আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তোমার পথপ্রদর্শককে অনুসরণ করে তুমি এগিয়ে যাবে তারপর প্রায় সুড়ঙ্গের মতোই একটি সিঁড়িপথের সামনে এসে থমকে দাঁড়াবে তোমার পথপ্রর্শক। সে তার চোখের ইঙ্গিতে তোমাকে বুঝিয়ে দিবে এই হলো আপাতত তোমার যাত্রাপথের শেষ এবং এখান দিয়েই ঢুকতে হবে তোমার অভীষ্টে। সুড়ঙ্গের গোড়ায় দাঁড়িয়ে তুমি এক বোতল পানি সংগ্রহ করবে, তোমার মনে হবে যেন গতরাতের পর থেকেই দফায় দফায় তোমার তৃষ্ণা তোমার হৃৎপিণ্ড শুকিয়ে ফেলছে। বোতলের ছিপিতে লাগানো লেবেল দাঁতে কেটে ছিঁড়তে ছিঁড়তে তুমি তাকে অনুসরণ করবে এবং সুড়ঙ্গের প্রথম ধাপ অতিক্রম করলেই তোমার চোখে পড়বে অভ্যর্থনা ডেস্ক। যার পেছনে কালো অক্ষরে হলুদ বোর্ডটাতে লেখা থাকবে সমাগত অতিথিদের উদ্দেশে নিবেদিত নির্দেশাবলি।

উঠতে উঠতে তুমি বুঝতে পারবে সুড়ঙ্গটা এমনই যে, বিপরীত দিক থেকে আসা মানুষের গায়ের ছোঁয়া তোমাকে পেতেই হবে যদিও তারা কেউ বিষয়টতে একদমই উদ্বিগ্ন হবে না। সুড়ঙ্গ বেয়ে ঠিক তিনটি কি চারটি তলা অতিক্রম করলেই তোমার কানে আসতে থাকবে অসংখ্য মানুষের গুঞ্জন যাদের কারো মুখের কথাই তুমি আর বিশ্লিষ্ট করতে পারবে না। প্রতিটি কথাই অন্য একটি কথার চাপে ঢাকা পড়বে আর তা থেকে উত্থিত গুঞ্জরণ হাওয়ায় মেলাবার পথ না পেয়ে তৈরি করবে একটি শব্দগুমোট। তোমার পথপ্রদর্শক, যার নামটাই জানা হয় নি এখনো, সে এবার তোমাকে বাম দিকে নিয়ে যাবে যেখানে রয়েছে প্রণয়িনীদে বসবার জায়গা এবং তুমি সেখানে বিচিত্র সব প্রণয়িনীকে বসে থাকতে দেখবে যাদের কেউ হবে কালো, আবার কেউ বেঁটে, কেউ বা মধ্যবয়স্কা, কেউ ফর্সা আবার শীর্ণকায় ও শ্যামলা যাদের মুখে থাকবে মেকাপের মোটা প্রলেপ। যাদের কেউ কেউ তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা জটলার মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে উদাস ও দুঃখী চেহারায় আবার কেউ ভেংচি কেটে শিস বাজাতে থাকবে কারো ঠোঁটে ঝুলবে সিগারেট। তুমি বিভ্রান্তিতে তাদের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নেবে। ডান পাশের দেয়ালের গায়ে থাকবে সারবদ্ধ একটার পর একটা দরজা যার সবই থাকবে ভেতর থেকে বন্ধ।

মানুষের ভিড়ে তুমি কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে পড়তে চাইবে তবে তখনই গলির শেষ কক্ষের দরজাটা খুলে যাবে হঠাৎ। বুকের কাপড় ঠিক করতে করতে ত্রিশোর্ধ্ব যিনি বেরিয়ে আসবেন তার চোখে মুখে থাকবে হাসির ঝিলিক, যদিও তার পেছন পেছন যে ঘর্মাক্ত মধ্যবয়সী বেরিয়ে আসবেন তার মুখটা থাকবে পাংশু। অনেকটা ছুটে গিয়ে খোলা দরজাটা টেনে আগলে দাঁড়াবে তোমার নাম না জানা পথপ্রদর্শক আর তোমার বুঝতে বাকি থাকবে না যে কেন সে দরজাটা আগলে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং তোমাকে তোমার কর্তব্য সম্পর্কে ভাবতে হবে একদণ্ড। তুমি পায়ে পায়ে এগিয়ে যাবে, যেতে যেতে ছিপি খুলে পানি খাবে এক ঢোক। তোমার পথপ্রদর্শক জানতে চাইবে তোমার সঙ্গী নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে কি না, সেই মুহূর্তে বিভ্রান্ত তুমি তাকে দরজা ঘেঁষে বসে থাকা কঙ্কালসার মেয়েটির কথা জানাবে। সে হবে সত্যিই খর্বাকৃতির, কঙ্কালে মানবচর্ম জড়িয়ে তৈরি করা মাংসহীন হাড্ডিসার এক মেয়ে, শুধু তার বুক হবে যেন একতাল অপরিশোধিত মোমে ও মায়ায় তৈরি ক্রমোচ্চ দুটি ঢিবি, ঠোঁটে থাকবে সিগারেট, পরনে লেহেঙ্গা। তোমার ডাকে যেন তার মুখে হাসি ফুটবে। প্রথমে সে এবং তার পেছন পেছন তুমি বা তোমরা প্রবেশ করবে পথপ্রদর্শকের আগলে রাখা কক্ষটিতে। উচ্চতায় সে এতটাই খর্ব যে দরজার ছিটকিনি লাগাবার কয়েক দফা প্রচেষ্টার পর তোমাকেই বলবে “দরজাটা লাগান”।

কক্ষের মেঝেতে জন্ম ও জীবাণুরোধের লুব্রিকেটিং রাবারের খোলস ও ব্যবহৃত রাবার ছড়ানো ছিটানো থাকবে ইতস্তত। বিছানায় পেতে রাখা তোষকের ওপর জীর্ণ ও শতচ্ছিন্ন চাদরটা টেনে সে এমনভাবে পাতবে যাতে আকাশমুখী শুয়ে সে নিজের পিঠটাকে বাঁচাতে পারে নোংরাধিক নোংরা তোষক থেকে। লম্বা ফর্সা ও স্ফীত বক্ষের যুবক! এবার তুমি প্রস্তুত হয়ে উঠে আসবে এবং তোমার নিচে আসন নেয়া মেয়েটিকে আরো একবার দেখে নেবে ভালো করে। আর এই মুহূর্তে তোমার চোখে পড়বে মেয়েটির দু’বাহুতে অগণিত কাঁটা দাগ যেন শান্ত মাথায় কেউ ব্লেড দিয়ে তার করূণ বাহুপটে এইসব স্থায়ী রেখা টেনে দিয়েছে। তবে তোমার বুঝতে কষ্ট হবে না যে এই চিত্রলিপির হেতু সে নিজেই। হয়তোবা নিজের অথবা অপরের কিংবা ততোধিক কোন বিষয়ের বিতৃষ্ণায় তার বাহুতে জন্ম নিয়েছে এই সব দাগ যার পশ্চাতে থাকবে তীব্র দৈহিক যন্ত্রণা।

তুমি তার নিন্মাঙ্গের দিকে তাকাবে একবার। তুমি বুঝতে চেষ্টা করবে এই শীর্ণ শরীরের দু’পায়ের মাঝে সৃষ্টি হওয়া রহস্যের পরিমাপ। তুমি ভুলে যাবে সেই গন্ধের কথা যা তোমাকে টেনে এনেছে এই সুড়ঙ্গের শেষ মাথায়। নিরাপদ দূরত্বের ওঠা নামায় তুমি ঘেমে উঠবে এবার, আর ঘন নিশ্বাসে মাখামাখি মেয়েটির গলার স্বর শুনতে পাবে তুমি। একবার তুমি জানতে চাইবে তার নিবাসের জায়গা সম্পর্কে তবে জানতে চাইবে না তার নাম। কেননা এ বিষয়ে তোমার পূর্ণ জ্ঞান থাকবে যে নামের প্রশ্নটি অবান্তর, হয়তো সত্যি তার একটা নাম আছে এবং সে নামে কেউ তাকে সকালে ও রাতে একবার কি দু’বার সম্বোধন করে সাদরে কিংবা অনাদরে। কিংবা এমন কেউ নেই, যে তার সত্য নামটা জানে, তা উচ্চারণ করে সে বা তারা তাকে সকালে ঘুম থেকে ডেকে তোলে, খাবারের জন্য তাড়া দেয় অথবা তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে অনুরোধ করে ও অপেক্ষা করে। তুমি জানতে পারবে যে তার নিবাস শহরের কোথাও। এবার তোমার আরও জানতে ইচ্ছা করবে সে আসক্ত কি না, জবাবে তুমি জানবে ‘না’।

এইসব কথার ভেতরেই তুমি অনুভব করবে তোমার পিঠের চামড়ায় ও বাহুতে নখের আঁচড়, যা ততটা তীব্র নয়। তবু তা-ই তোমাকে শান্ত করতে যথেষ্ট। যদিও ইতোপূর্বে কামসূত্রে পাওয়া আরও  সহজ ও উপভোগ্য আসনের প্রস্তাবে তুমি প্রত্যাখ্যাত হবে। তুমি ক্লান্ত হয়ে আসবে, শুনতে পাবে নিজের নিঃশ্বাস। উঠে আসতে আসতে তুমি আরও  একবার তার চোখ মুখের দিকে তাকাবে সেখানে তুমি নীল বা এমন কোনো বর্ণের উপস্থিতি না দেখতে পেলেও যা তুমি দেখবে তা হয়তো বিষাদ আর তা কতখানি গভীর সে সম্পর্কে জানবে না কিছুই। শুধু জানবে তুমি ছিলে আজ  তার কাছে আসা যুবা-পুরুষদের মধ্যে ছাব্বিশতম। নিজেকে সে টেনে তুলবে এবং বসবে, তোমার বোতলের পানি খাবে, যদিও মাত্র দুই ঢোক।

গত রাতের কল্পিত দীর্ঘ সঙ্গমের তীব্র আকাঙ্ক্ষা তোমার মিটবে না যদিও তমি শ্রান্ত। দরজা খুলে তোমার ঈষৎ আগেই সে বেরিয়ে যাবে। শ্রান্তি, তৃপ্তি ও অতৃপ্তির বিবমিষায় তুমি আরও একবার সিগারেট জ্বালবে তারপর বেরিয়ে দেখবে তোমার পথপ্রদর্শকের সাথে মেয়েটির একটি পত্র কিংবা রশিদ বিনিময় হচ্ছে। সেদিকে তাকাতেই তোমার পথপ্রদর্শক সহাস্যে এগিয়ে আসবে, পাশে রাখা একটা জীর্ণ চেয়ার টেনে তোমার সামনে এগিয়ে দিয়ে বলবে, ‘ভাই, রেস্ট নেন।’

তুমি বসবে কিছুটা কিন্তু রেস্ট নেবে না, চতুর্পাশে ঘুরে বেড়ানো দুঃখী-সুখী গণিকা ও তাদের কাছে আসা অতৃপ্ত নাগরিকদের ঘাম ও সুগন্ধিমিশ্রিত বিশ্রী গন্ধ তোমাকে মনে করিয়ে দেবে সেই গন্ধের কথা যা তুমি খুঁজে বেড়াচ্ছো আতঙ্কিত নগরীর গলিতে গলিতে। ‘আর দেরি নয়’-এমন ভেবে তুমি তোমার পথপ্রদর্শকের হাতে গুঁজে দিবে তার চাহিদা মতো কতগুলো ‘টাকা’। সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরুতে বেরুতে তুমি বুঝতে পারবে এখানকার ভিড় যেন আরও বেড়ে উঠছে; গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগিয়ে তুমি নেমে যেতে থাকবে এবং নেমে যাবে একসময়। রাস্তায় নেমে ঘর্মাক্ত তুমি কিছুটা হালকা হয়ে আসা শরীরে একটি ঠান্ডা বাতাস অনুভব করবে তবু তোমার ঘামের প্রশমন হবে না। আতঙ্কের নগরীতে তখন থাকবে তীব্র যানজট। গাড়ির ফাঁকে সাবধানী পায়ে তুমি রাস্তা পেরুবে। উল্টো দিক থেকে আসা বাসগুলো তখন তীব্র মানুষে ঠাঁসা হয়তো সর্ষে দানাই শুধু ঢোকানো যাবে তাদের ঠাসাঠাসি শরীরের ফাঁকে। তুমি হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করবে সকল বাসের দরজাই বন্ধ এবং তখন কিছুটা নিশ্চলতা কেটে যাবে রাস্তায় একটু একটু করে গাড়ি এগুবে। তোমার ডান পাশে অত্যন্ত ধীর গতিতে এগুতে থাকবে যে বাসটি তার নাম ‘তরঙ্গ’। তুমি চকচকে চোখে তাকালে দেখবে সেই বাসটি যথেষ্ট পরিমাণ ঠাসা নয়, চাইলেই তোমার মতো অনেকেই সেটিতে চড়ে বসতে পারে। তুমি উঠতে গিয়ে দেখবে তার দরজা বন্ধ। ওঠার আকুতি জানাবে তুমি, আর তারা কিছুক্ষণ ভালোভাবে অবলোকনের পর তোমাকে তুলতে রাজি হবে। একদম শেষের দিকে দু’জনের মাঝখানে বসবার জায়গা পাবে তুমি।

পূর্ব থেকে বসে থাকা লোক দু’জন অত্যন্ত অন্তরিকতায় তোমার বসাকে অনুমোদন করবে। তোমার হাঁপানি কেটে যেতে থাকবে একটি মৃদু গন্ধে, সচকিত হবে তোমার স্নায়ু তবে কি সেই গন্ধটা তুমি পেয়ে যাচ্ছো অবশেষে? না! এই মুহূর্তে তুমি যে গন্ধ পাচ্ছ তা কর্পূরের কেবল মৃতের শরীর থেকেই যা ছড়ায়। অস্থির হয়ে উঠবে তুমি তাকাবে ডানে বায়ে জানালার দু’পাশে। দেখবে সারবদ্ধ মৃতেরা হেঁটে যাচ্ছে তুমি বুঝতে পারবে তারা যাচ্ছে মূলত মিছিল করে । যাদের ফেটে যাওয়া গলা দিয়ে বেরুনো দাবিনামাগুলো এতটা স্পষ্ট নয়, তবে তাদের প্রধান ও প্রথম দাবিটা তোমার কানে এসে পৌঁছুবে ঠিকঠাক। তারা বলে যাচ্ছে যেহেতু তারা মৃত তবু তাদের কবরস্থ করা হয় নি কেন সেটাই জানতে চেয়ে আগামীকাল তারা মহাবিক্ষোভের ডাক দিয়েছে নগরীর প্রধান ময়দানে। তীব্র কর্পূরের গন্ধে নাক লুকানোর কোনো জায়গা তুমি খুঁজে পাবে না তাই নিজের শরীরের ভাঁজেই আপাতত তুমি লুকোবে নিজের নাক এবং কিয়ৎক্ষণে তুমি অনুভব করবে ঐ একই গন্ধ তোমার বসনের পর্দা ভেদ করে ঢুকে পড়ছে দেহাভ্যন্তরে আর ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিটি কোষে। উপায়হীন তুমি অপেক্ষায় থাকবে বাস থেকে নেমে যাবার।






রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়