ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

টাইপ রাইটার

মাহামুদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
টাইপ রাইটার

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

|| মাহামুদ হাসান ||

রোজকার মতোই কম্পিউটার টেবিলে বসে খট খট আওয়াজে সামনের তারিখে কোর্টে পেশ করার জন্য একটা দলিল টাইপ করছিলো অবলাকান্ত দাসগুপ্ত। তার বাবু, মানে ব্যারিস্টার চৌধুরী নিজামুদ্দিন সাহেব কতবার তাকে বলেছে ওটা টাইপ রাইটার নয়, আধুনিক কম্পিউটারের কী-বোর্ড। গায়ের শক্তি প্রয়োগ করে টাইপ করলে দু-দিনেই কী-বোর্ডখানা নষ্ট হয়ে যাবে। আর ওভাবে টাইপ করতে গিয়ে যে এক ঘেয়ে শব্দ তৈরি হয় সেটা বড়ই বিরক্তিকর। তাছাড়া নিজের বাড়ির লাইব্রেরি কাম চেম্বারটাকেও কোর্ট পাড়ার সেই বিরক্তিকর টাইপ রাইটারদের প্রতিযোগিতামূলক বাজারের মতো মনে হয় নিজামুদ্দিন সাহেবের কাছে। যদিও ব্যক্তিগত সহকারী কাম টাইপিস্ট অবলাকান্তের কাছে তিনি মুখ ফুটে এই কথাটা কখনো বলেন নি। অবলাকান্ত অবশ্য চেষ্টা করে তার বাবুর কথা মতো শব্দ না করে টাইপ করতে। কিন্তু টাইপ করতে করতে খট খট শব্দটা মনের অজান্তেই হয়ে যায় কিনা, সেটা সে নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। তবে টাইপ রাইটারের খট খট শব্দটা তাকে খুব করে টানে। কেমন যেন একটা ঘোরের মাঝে সেটা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যার তার শৈশবে।

অবলার বাবা শ্রী শশীকান্ত দাসগুপ্ত কোর্ট বাজারে টাইপ রাইটারের কাজ করতেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কোটে কাজ-কর্ম করে বিকেল যেতেন চৌধুরী বাড়ীতে; নিজামুদ্দিন সাহেবের বাবার চেম্বারে ফরমাশ খাটতে। রোজগার মন্দ না, খেয়ে পরে দিব্যি যাচ্ছিল। মা ননী বালা টুকটাক লেখাপড়া জানা গৃহিণী। বাসায় সেলাইয়ের কাজও কিছু করতেন। আর ছিল হাই স্কুল পড়ুয়া বোন নিরুবালা। অবলা তখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি। স্কুল থেকে এসে নিরু তার মাকে এতে-ওতে সাহায্য করে। আর সুযোগ পেলেই রুপাকে তাদের বাড়ি থেকে ডেকে এনে পুতুল-হাঁড়িপাতিল খেলে। রুপা পাশের বাড়ির রহমত মোল্লার মেয়ে, বাড়িতে নিরুর একমাত্র খেলার সাথী। অবলাও মাঝে মাঝে নিরুর সাথে খেলত। খেলার সময় অবলাকে নিরু শুধু বাজারে পাঠাত চাল-নুন (ধুলো), তেল (পানি) নিয়ে আসতে, কিন্তু কখনো পুতুল ধরতে দিত না। এই নিয়ে অবলা কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে গিয়ে রোজ নালিশ করত যে নিরু তাকে পুতুল ধরতে দেয় না। এই জন্য মা নিরুকে বকা দিত। বলত নিরু, ‘তুই এত্তো বড় হয়ে গেছিস, তবু তোর খেলা গেল না রে।’ আর নিরু তার জবাবে প্রতিবার বলত, ‘পড়া তো শেষ মা, এখন একটু খেললে কি হয়?’
 
অবলারা থাকতো কোর্ট পাড়ায়। দু-রুমের টিনশেডের একটা ভাড়া বাড়িতে। পাশাপাশি দু’টি ঘর। সামনে কোমর সমান উঁচু পাঁচিল ঘেরা বারান্দা, তার এক কোণায় রান্নার জায়গা। বারান্দার সামনে থেকে বাড়ির সীমানা দেয়াল পর্যন্ত সামনের জায়গাটা আগে খোলাই ছিল। বিয়ের পর শশীকান্ত যখন এখানে এল তখন টিন দিয়ে ঘিরে নিয়েছে। তাতে ছোট্ট গোল মত একটা আঙিনাও হয়েছে। বারান্দায় দাঁড়ালে নাক বরাবর বাড়ির দরজা। দরজার সাথেই একটা পেয়ারা গাছ। তারপর দু’টো পাতাবাহার গাছ। ডান দিকে কোনায় টিন-কাঠ দিয়ে বানানো মুরগির ঘর। উত্তর দিকে গোসলখানা, তার উল্টোদিকে দখিন দেয়ালের কাছাকাছি মাটি দিয়ে গোড়া উঁচু করে বাঁধা একটা তুলসী গাছ। বিশ-বাইশটা বাড়ি মিলে ছোট্ট কোর্ট পাড়া। অবলাদের বাড়িটা একেবারে শুরুতেই, পাড়ায় ঢোকার মুখে। বাড়ির পেছনে একটা ডোবা মতো জায়গা। তারপর একটা ছোট আমের বাগান আর খানিকটা খোলা জায়গা। বাঁ দিক দিয়ে রাস্তা চলে গেছে পাড়ার ভিতরে। বাড়ির মালিক, শশীকান্তের দূর সম্পর্কের খুড়ো, সপরিবারে ইন্ডিয়ায় চলে গেছে সেই সাতচল্লিশ সালে দেশভাগের পরপর। তার আত্মীয়স্বজন অনেকেই থেকে গেছে এপারে, আর কিছু জমি জমাও আছে। তাই বছরে এক-আধ বার আসা হয় এপার বাংলায় আর সেই সময় ভাড়ার টাকা একবারে নিয়ে যায়।
 
চৌধুরী বাড়ির কাজ শেষ করে ফিরতে ফিরতে শশীকান্তের রাত হয়ে যেত। ছোট্ট অবলা প্রতিদিন বাবার ফেরার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ত, নিজেও টের পেত না। সকালে ঘুম ভাঙতেই শুনতে পেত টাইপিং এর খট খট শব্দ। বিছানা ছেড়ে উঠে দেখত খোলা জানালার সামনে বসানো টেবিলের ওপর টাইপ মেশিন। আর চেয়ারে বসে তার বাবা একমনে টাইপ করছেন। টেবিলের ওপর লাল রেডিওটা বেজে চলেছে। শশীকান্ত খবর শুনতেন। খবরের সময় মাঝে মাঝে মনোযোগ দিয়ে শুনতে টাইপিং করা বন্ধ রাখতেন। সেই থেকেই খট খট শব্দটার সাথে অবলাকান্তের নিবিড় আত্মীয়তার সম্পর্ক।
 
অবলা তার বাবার সাথে বেশ কয়েক বার চৌধুরী বাড়ি গেছে। কখনো পাশে বসে শশীকান্তকে একমনে টাইপিং করে যাওয়া দেখেছে। কখনো বা চৌধুরী বাড়ির সামনের অংশের বিশাল ফুল বাগানে ঘুরে ঘুরে হরেক রকমের ফুল দেখেছে। আবার কখনো বাবার কাজের ঘরের দরজায় বাঁধা বড় বড় লোমওয়ালা সাদা ছোট্ট কুকুরটির সাথে খেলেছে। যেদিন অবলা সঙ্গে যেত সেদিন তার বাবা সন্ধ্যায় একবার বাড়ি ফিরত। তাকে রেখে, হাতমুখ ধুয়ে কিছু খেতে খেতে অবলার মায়ের সাথে খোশ-গল্প করে আবার কাজে চলে যেতেন। বাবা-মায়ের গল্প শুনে অবলা কিছু বুঝত না। বাবাকে বলতে শুনতেন- ‘দেশের অবস্থা ভালো না, ননী। শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন, তখন অবস্থা আরও খারাপ হবে। কি হয় বলা যায় না। যুদ্ধ লেগে যেতে পারে।’
এসব শুনে অবলার মা বলতেন, ‘চৌধুরী সাহেবকে বলে কাজটা ছেড়ে দাও তুমি। চলো, আমরা অন্য কোথাও চলে যাই। ননীবালার মুখে এসব শুনে শশীকান্ত চোখমুখ শক্ত করে বলতেন, ‘যাই হোক, বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে কোথাও যাব না আমি।’ তারপর আর কিছু না বলেই দ্রুত বেরিয়ে যেতেন। এমন শক্ত কথা শুনে মা শেষে কোনরকমে বলতেন, ‘সাবধানে যেও, আরা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসো।’

দুপুর থেকে মেঘ গুড় গুড় করে শেষ বিকেলে বৃষ্টি শুরু হলো। খুব দ্রুতই চারিদিকে সন্ধ্যা নেমে এলো। সন্ধ্যার পর বৃষ্টিও একেবারে কমে গেল। বিছানার ওপর বসে অবলা বালিস দিয়ে আপন মনে কিছু একটা খেলা খেলছিল। এমন সময় চার-পাঁচ জন মানুষ এসে ঘরে ঢুকল। এদেরকে অবলা আগে কখনো দেখেনি। তাদের মধ্য থেকে মোটাসোটা একজন বলল, ‘কই, বাড়ীতে কে আছে?’
লোকজনের কথা শুনে পাশের ঘর থেকে ননীবালা বের হয়ে এলেন। তার পেছনে পেছনে নিরুও এলো। হঠাৎ করে দু’জন সামনে এসে মা আর বোনকে হাত ধরে টানতে টানতে বাইরের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। ভয় পেয়ে ননীবালা বলতে শুরু করলেন- ‘আরে আরে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? ছাড়েন, ছাড়েন; আমাদের ছেড়ে দিন।’ নিরু ভয় পেয়ে মা, মা বলে কান্না জুড়ে দিলে লোকগুলো তাদের দু’জনরেই মুখ চেপে ধরল। অবলা কিছু বুঝতে না পেরে দৌড়ে গিয়ে মায়ের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। লোকগুলো টেনে হিঁচড়ে ননীবালা আর নিরুকে বাড়ির বাইরে নিয়ে যেতে থাকল। অবলাও কাঁদতে কাঁদতে মায়ের শাড়ি ধরে পেছন পেছন গেল।

দরজার কাছে পৌঁছে অবলা বাইরে একটা গাড়ি দেখতে পেল। ইঞ্জিন চালু করা ছিল। গাড়ির পাশে সাদা পাঞ্জাবি পরা একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। মাথায় তার কালো রঙের বড় একটা টুপি। তার পাশে অরো একজন আছে, পাঞ্জাবি পরা লোকটির মাথায় ছাতা ধরে। অন্যদিন যদিও দু-একজন মানুষ থাকে রাস্তায়, কিন্তু বিকেলের বৃষ্টির কারণে আজ কাক পক্ষীটিরও দেখা নেই। সবাই ঘরে ঘরে ঠাঁই নিয়েছে। লোকগুলো ননীবালা আর নিরুকে টানতে টানতে গাড়ির কাছে নিয়ে এলো। তারপর জোর করে গাড়িতে টেনে তুলে দরজা আটকে দিল। একে একে সবাই গাড়িতে উঠলো। গাড়িটা সামনের দিকে চলতে শুরু করলো।

অবলাও গাড়ির পেছন পেছন দৌড়াতে শুরু করলো। কিন্তু বাষ্প ইঞ্জিনের গাড়িটি খুব দ্রুতই দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল তার মা আর বোনকে নিয়ে। ধীরে ধীরে তার দৌড়ের গতি কমে গেল। ভয় আর ক্রোধে চিৎকার করে কাঁদা ছাড়া কিছুই করতে পারলো না। অগত্যা ঘুরে বাড়ির দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে ভাবল-বাবা এলে রাতে সব বলে দেবে। কিন্তু বাড়ি ফিরে শূন্য ঘরের মেঝেতে বসে কিছু ভাবতে না পেরে কাঁদতে লাগলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় মেঝেতেই ঘুমিয়ে গেল। ঘুমের ঘোরে সাদা পাঞ্জাবি, কালো বড় টুপি দেখতে পেয়ে মা, মা বলে ডুকরে কেঁদে উঠল অবলা।  



লেখক : গল্পকার। জন্ম ১৯৮৭, দিনাজপুর।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫/তাপস রায়  

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়