ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

টেক-অফ ফ্রম পোখারা || খোরশেদ খোকন

খোরশেদ খোকন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৯ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
টেক-অফ ফ্রম পোখারা || খোরশেদ খোকন

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

চোখ কচলাতে কচলাতে মোবাইল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে শহীদ দেখে রাত ৪টা বাজে। নিশা হোটেলের মালিক বলেছিল- সরনকোট রওনা হয়ে যাওয়ার উৎকৃষ্ট সময় হচ্ছে সকাল সাড়ে চারটা। শহীদ শরীরের একরাশ ক্লান্তি নিয়েই দুই বন্ধু হাফিজ আর আলমকে ডেকে তুলল। তিনজন শীতের কাপড় পরে তিনতলা থেকে হোটেলের নিচের তলার লবিতে নেমে গেল। লবিতে দাঁড়িয়ে আলম মাফলার ঠিক করতে করতে দেখল হোটেলের মালিক রাস্তায় একটি গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ড্রাইভারের সাথে কী একটা বিষয় নিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে।

 

তিন বন্ধু গাড়ির কাছে যেতেই হোটেল মালিক পরিচয় করিয়ে দিল ড্রাইভারের সাথে। ড্রাইভার নিজেই আগ বাড়িয়ে বলল, ‘স্যার, আপনারা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন? আমিও বাংলাদেশের মানুষ, আমার পূর্বপুরুষেরা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় বসবাস করত। আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন তাদের সাথে নেপাল চলে আসি। আজ সকালে আপনাদের পেয়ে আমার খুবই ভালো লাগছে। আশা করছি, আজ দিনটা ভালোই কাটবে; আমরা অন্নপূর্ণা ভালোভাবেই দেখতে পাব। চলেন স্যার আমরা এগিয়ে যাই।’

 

তিন বন্ধু শীতে কাঁপতে কাঁপতে গাড়িতে উঠে গেল। গুগলে সার্চ দিয়ে আলম দেখল, সরনকোট জায়গাটা সমতল থেকে ষোলো শ’ মিটার ওপরে। পোখারা শহরের ফেউয়া লেকের কাছে নিশা হোটেল থেকে ওরা রওনা হয়েছে, সেখান থেকে ১০ কিলোমিটার দূরেই সরনকোট; যেতে সময় লাগবে ৩০ মিনিটের মতো।

 

পোখারার মতো এমন সুন্দর পরিপাটি করে গোছানো শহর তিন বন্ধুর কেউ কোনোদিন দেখেনি। পোখারা শহরটা সকাল-দুপুর-রাত একেক সময়, দেখতে একেক রকম। এ শহরের দৃশ্যগুলো মেঘ-বৃষ্টি-রোদের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়ে যায়! সকালের নির্জনতা দেখতে দেখতেই, চেনা শহরের সীমানা শেষ হয়ে যায়; আর শহরটাকে পেছনে ফেলে গাড়িটা পাহাড়ের উঁচুর দিকে ধীরে ধীরে উঠতে থাকে। তিন বন্ধু নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে গোটা শহর, যার বুকে মিটি মিটি জ্বলছে জোনাকির মতো আলো।

 

সরনকোট পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত একটা গ্রাম; আকাশ পরিষ্কার থাকলে যে গ্রাম থেকে তাকিয়ে সবচেয়ে সুন্দর পর্বত মানে অন্নপূর্ণা দেখা যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ অন্নপূর্ণা দেখতে এই গ্রামেই এসে ভিড় করে। তিন বন্ধু যখন সরনকোট গিয়ে পৌঁছাল, তখনো অন্ধকার রাত, আলো ফোটেনি আর আকাশে সাদা সাদা পেঁজা তুলার মতো মেঘ, চারপাশে হিম ধরানো ঘন কুয়াশা। শত শত মানুষ রাত জেগে অপেক্ষা করছে কখন সকাল হবে? পরিষ্কার একটি সকাল; যেখানে কোনো মেঘ থাকবে না। সেই মেঘমুক্ত আকাশের জন্যই সবার মনে মনে প্রার্থনা চলছে।

 

হ্যাঁ, মানুষের প্রতীক্ষার প্রহর পেরিয়ে পূর্ব আকাশে ঝলমল করে হেসে উঠল একটি নতুন সূর্য। চারদিকে মানুষ হই হই করে উঠল; যেন নিজ দেশের ছেলেরা বিদেশের মাটিতে বিশ্বকাপ জিতেছে, তেমন একটা উচ্ছ্বাস আর চিৎকার! সোজা সামনে তাকিয়ে ছিল শত শত মানুষ, যাদের বেশির ভাগ অল্প বয়সী যুবক-যুবতী আর স্কুল পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী, বাকিরা বয়সী বুড়ো মানুষ; তারা জানে না অন্নপূর্ণা আসলে আকাশের কোন দিকে উদিত হবে? মানুষের কি আকর্ষণ, কি উৎকণ্ঠা!

 

এবার শত শত মানুষের চিৎকার, কোলাহল আর করতালি। হ্যাঁ, ওই তো মানুষের মাথা যতটা ওপরে উঠানো যায়, ততটা ওপরে মেঘের ওপরে সাদা উজ্জ্বল আলো নিয়ে জেগে উঠেছে অন্নপূর্ণা! আর তার রূপসী গায়ে পরেছে সূর্যের কাঁচা সোনালি রঙের মোহনীয় প্রলেপ। কী অসাধারণ এই অন্নপূর্ণা! আর তাকে নিয়ে এত মানুষের এত আগ্রহ এত উচ্ছ্বাস আর এত ভালোবাসা!

প্রকৃতি যে এত সুন্দর আর মনোহর; যারা অন্নপূর্ণা দেখেনি, তারা কোনো দিনই সেটা বুঝবে না। আসলে অন্নপূর্ণার সৌন্দর্য ছবি তুলে বা ভিডিও করে মানুষকে দেখানো যায় না। কিছু কিছু সৌন্দর্য আছে, যা কেবল চোখেই দেখা যায়; আর অনুভব করা যায় কিন্তু বলা যায় না। মানুষ হয়তো অন্নপূর্ণার আসল সৌন্দর্য কোনো দিনই ভাষায় বর্ণনা করতে পারবে না। তিন বন্ধু হোটেলে ফেরার রাস্তায় একটি এয়ারলাইন এজেন্টের অফিসে গিয়ে কথাবার্তা বলল, জানতে পারল এখান থেকে এয়ারে কাঠমান্ডু গেলে হিমালয় পর্বতের রেঞ্জগুলোকে পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। এদিকে আলম হিন্দি টিভি দেখে দেখে সাউথ ইন্ডিয়ান একসেন্টে ভালোই হিন্দি শিখেছিল। সে খুব আগ্রহ নিয়ে এয়ারলাইন এজেন্টের সাথে হিন্দিতে গল্প-গুজব জমিয়ে ফেলল।

 

তিন বন্ধু কাঠমান্ডু থেকে পোখারা আসার দিন দেরিতে রওনা হওয়ার জন্য ট্যুরিস্ট বাস মিস করেছিল; তারপর ভাড়া করা মাইক্রোবাসে পোখারা আসতে পাহাড়ি রাস্তার যে দৃশ্য তারা দেখেছে, তাতে তিনজনের কেউই ওই রাস্তায় গাড়িতে কাঠমান্ডু ফিরে যাওয়ার সাহস করছে না। যাই হোক, হাতে সময় কম আর এদিকে জনপ্রতি মাত্র ৪৫ ডলার এয়ার ফেয়ার দেখে তিনজনে তিনটা টিকিট কিনে ফেলল। এয়ারলাইন এজেন্ট জানালো, পোখারার বিমান ছাড়ে আকাশের মেজাজ-মর্জি মতো; মানে সময় অনুযায়ী বিমান থাকলেও সেটা পুননির্ধারিত হয় আবহাওয়া বুঝে।

 

সময় অনুযারী বুদ্ধা এয়ারের বিমান ছেড়ে যাবে দুপুর ১২টায়। তিন বন্ধু যখন দেখল, আগামীকাল সন্ধ্যায় কাঠমান্ডু থেকে ওদের ঢাকা যাওয়ার ইউনাইটেড এয়ারের ফ্লাইট ধরতে হবে, তাই আগামীকাল সকালের ট্যুরিস্ট বাস ধরা আর আবহাওয়ার ভরসায় না থেকে আজই পোখারা থেকে কাঠমান্ডু চলে যাওয়াই উচিত কাজ হবে। তিন বন্ধু শেষবারের মতো ফেউয়া লেকের পাড়টা ঘুরে ডেভিলস ফলস দেখে দুপুরের আগেই রওনা হয়ে গেল পোখারা এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্টে দুই ভাগে চেক হয় বিদেশিদের। এক ভাগে ইমিগ্রেশনের লোকজন আর অন্য ভাগে এয়ারলাইনের লোকজন যাত্রীদের পরীক্ষা করে। তারা ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে তিনটা ফরম পূরণ করল আর পাশে ব্যাংকের বুথে এয়ারপোর্টের ট্যাক্স দিয়ে দিল। ইমিগ্রেশন ফরম পুলিশের হাতে দিতেই পুলিশ অফিসার বলল, আপনি ইন্ডিয়ান?

 

আলম বলল, ‘জি না, আমি বাংলাদেশি, আমরা তিনজনই বাংলাদেশি।’

পুলিশ অফিসার বলল, ‘আপনার পাসপোর্ট বাংলাদেশি কিন্তু টিকিট তো ইন্ডিয়ান!’

আলম বলল, ‘স্যার আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না? আমরা আজ সকালে এক এয়ার এজেন্টের কাছ থেকে এই তিনটা টিকিট কিনেছি। আমাদের খুব জরুরি কাঠমান্ডু যাওয়া প্রয়োজন। কেননা আগামীকাল সন্ধ্যায় আমাদের ঢাকায় যাওয়ার ফ্লাইট শিডিউল আছে।’

পুলিশ অফিসার বলল, ‘দেখুন, নেপালে এয়ার টিকিট তিন রকমের দামে বিক্রি হয়। এক নেপালিদের জন্য, দুই ইন্ডিয়ানদের জন্য আর তিন হলো বিদেশিদের জন্য। আপনাদের তিনজনের ভাড়া ইন্ডিয়ানদের জন্য নির্ধারিত যে ভাড়া, সেই ভাড়ায় কেনা হয়েছে। আমরা এয়ারপোর্টের নিয়ম অনুযায়ী কোনো বিদেশিকে ইন্ডিয়ান ভাড়ায় ভ্রমণ করতে দিতে পারি না। আপনাদের জানা উচিত ছিল বিদেশিদের ভাড়া ১১০ ডলার আর ইন্ডিয়ানদের ভাড়া ৪৫ ডলার। আপনারা এখন এই ফ্লাইটে যেতে পারবেন কিন্তু আপনাদের সাড়ে এগারোটার মধ্যেই অতিরিক্ত ডলার দিয়ে টিকিট রি-কনফার্ম করতে হবে।’

 

শহীদ বলল, ‘স্যার, দেখুন আমাদের তো কোনো দোষ নেই, আমরা তো বলিনি যে আমরা ইন্ডিয়ান, ওই এয়ার এজেন্ট ভুল করেছে। আমাদের খারাপ উদ্দেশ্যও নেই। আমাদের সমস্যাটা বুঝতে চেষ্টা করুন প্লিজ।’

পুলিশ অফিসার বলল, ‘দেখুন আমাকে এত কথা কেন বলছেন? আপনারা নিয়ম মানলেই কেবল আমি পারমিশন দিতে পারি। আমার কথা না বুঝলে, আমি আমার থেকে উচ্চতর কর্মকর্তাদের কাছে আপনাদের নিয়ে যেতে পারি; কিন্তু নিয়ম আপনাদের মানতে হবেই।’

হাফিজ বলল, ‘স্যার, আমাদের কোনো উপায় নেই। আমাদের আজ অবশ্যই কাঠমান্ডু যেতে হবে; আগামীকাল সন্ধ্যায় ঢাকার ফ্লাইট ধরতে হবে। অন্যদিকে আমাদের চেক করে দেখতে পারেন, আমাদের কাছে টিকিটের অতিরিক্ত ভাড়া দেবার মতো ১৯৫ ডলার নেই। আমাদের হেল্প করুন প্লিজ।’

পুলিশ অফিসার বলল, ‘আমার কিছুই করার নেই। আমি আপনাদের এয়ারপোর্টের প্রধান পুলিশ কর্মকর্তার কাছে নিয়ে যাচ্ছি, আপনারা তার সাথে কথা বলে দেখতে পারেন।’

 

যথারীতি তিন বন্ধু এয়ারপোর্ট প্রধান পুলিশ কর্মকর্তার রুমে গেল আর সেই কর্মকর্তা পুলিশের ওই অফিসারের চেয়েও তীব্রভাবে আইন ভাঙার জন্য তিন বন্ধুকেই দোষারোপ করতে থাকল। একসময় ফোন দিয়ে এয়ারলাইন এজেন্টকে ডেকে আনা হলো; আর সেই এজেন্টকে তার টিকিট বিক্রির ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতেও বলা হলো। এয়ারলাইন এজেন্ট বলল, ‘স্যার এই তিনজনের একজন খুব ভালো সাউথ ইন্ডিয়ান একসেন্টে আমার সাথে কথা বলেছিল, তাই আমি ভেবেছিলাম ওরা ইন্ডিয়ান, আমার ভুলের জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি।’

 

এয়ারপোর্টের জরিমানা ১৯৫ ডলার দিয়েই বিদেশিদের মতো ভাড়ায় পোখরা থেকে কাঠমান্ডু যেতে হবে, এটা ভেবে তিন বন্ধুই বিচলিত হয়ে গেল; কেননা তারা এত ভাড়া জানলে এই এয়ারের টিকিট ক্রয় করত না। ওদিকে পকেটে ডলার যথেষ্ট নেই, হাতে সময়ও নেই- এ যেন উভয়সংকট পরিস্থিতি। এদিকে এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে, যদি এই ফ্লাইট মিস হয়, তাহলে বুদ্ধ এয়ার কিংবা এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ কোনো পক্ষই তিনজনের বিমান ভাড়া বাবদ ১৩৫ ডলার আর ফেরত দেবে না।

 

এ রকম একটা আতঙ্কজনক সময়ে এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ থেকে একটি শেষ সুযোগ দিয়ে বলা হলো, ‘আপনারা ১০০ ডলার জরিমানা দিয়ে এখনো এই ফ্লাইটে যেতে পারেন; কেননা আপনারা তিনজন আর এয়ার এজেন্ট দুই পক্ষই টিকিট বেচাকেনায় ভুল করেছেন। আপনাদের জন্য এখন ইমিগ্রেশন পার হওয়া আর বোর্ডিং নেওয়ার জন্য মাত্র ২০ মিনিট সময় হাতে আছে। ভেবে দেখুন, এই স্বল্প সময়ে কি করবেন? যা করার এখনই করুন।’

তিন বন্ধু একজন অন্যজনের দিকে তাকিয়ে আর কোনো উপার খুঁজে পেল না। অবশেষে আলম পকেট থেকে ডলার বের করে জরিমানা দিয়ে দিল। তারপর রানওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা বিমানে ওঠার জন্য তিন বন্ধু বোর্ডিং এরিয়ার দিকে দ্রুত বেগে এগিয়ে গেল। তিনজনের ১১০ ডলার করে বিদেশি হিসেবে মোট ৩৩০ ডলারের টিকিট লাগার কথা ছিল। এ যাত্রায় তিনজনের টিকিট বাবদ লাগছে ১৩৫ ডলার আর জরিমানা ১০০ ডলার, সর্বমোট ২৩৫ ডলার। তার মানে হিসাব করলে ৩৩০ থেকে ২৩৫ বাদ; এই ফ্লাইট পোখরা থেকে টেক-অফ করে আবার কাঠমান্ডুতে ল্যান্ডিং করা বাবদ তাদের তিন বন্ধুর সাশ্রয় মাত্র ৯৫ ডলার!

 

হিসাবের খাতায় ৯৫ ডলার সাশ্রয় রেখে তিন বন্ধু বিমানে গিয়ে বসে পড়ল। বুদ্ধ এয়ার টেক-অফ করার পরেই শুরু হয়ে গেল হিমালয় পর্বতের রেঞ্জ দেখার মোহনীয় জাদুর খেলা। তিন বন্ধু আকাশ থেকে নেপালের আলোকিত পর্বত রেঞ্জ দেখতে দেখতে ভাবতে লাগল; কাঠমান্ডু এয়ারপোর্টে যখন ইমিগ্রেশন চেকিং হবে, তখন বিদেশি টিকিট না কিনে ভারতীয় টিকিট কেন কেনা হয়েছে- এ জন্য আবারও জরিমানা গুনতে হবে না তো?   

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জুন ২০১৬/এএন/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়