ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

নাট্যকার নজরুল || শাহাদৎ রুমন

শাহাদৎ রুমন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ২৪ মে ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নাট্যকার নজরুল || শাহাদৎ রুমন

অলঙ্করণ : অপূর্ব খন্দকার

বাংলা সাহিত্যের নানা শাখায় অবদান রেখে গেছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি উভয় বাংলায় কবিতা ও গানের জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয় হলেও শিল্পের অন্যান্য বিভাগেও তাঁর পদচারণা ছিল। বিশেষ করে গল্প, উপন্যাস, নাটক, অভিনয় এবং চলচ্চিত্র মাধ্যমেও তাঁর অবদান সবিশেষ। তবে, গান ও কবিতা মূল্যায়নের পাশাপাশি তাঁর লেখা নাটক কিংবা চলচ্চিত্রে অবদানের গুরুত্ব প্রায়শই বিচার-বিবেচনা করা হয় না। অথচ তৎকালীন বাংলা নাটকের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, তাঁর নাটকে স্বদেশ ভাবনা এবং জাতীয় চেতনার প্রস্ফুটন বিদ্যমান। হাজার বছরের বাংলা নাটকের অন্যতম উপাদান সংগীত। এই সংগীতের ব্যাপক প্রয়োগ তাঁর নাটকে লক্ষ্য করা যায়। একইসঙ্গে এ কথা বলাও অপরিহার্য, লেটো দলের পালা রচনার মাধ্যমেই কাজী নজরুল ইসলামে সাহিত্যচর্চায় হাতেখড়ি। অর্থাৎ নাটক লেখার মাধ্যমেই কাজী নজরুল সাহিত্যচর্চা শুরু করেন।

এ কথা সকলেই অবগত যে, কাজী নজরুল ইসলাম গান রচনার ক্ষেত্রে সংগীতের প্রায় সবকটি শাখার চর্চা করেছেন। ফলে বহুধা বিচিত্র গানের সমাহার ঘটেছে নজরুল সংগীতে। তাঁর প্রায় ৩৫-৪০ ধরনের গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : রণসংগীত, শ্যামাসংগীত, ঠুমরী, গজল, খেয়াল, দেশাত্মবোধক, হোরী, কাজরী, কীর্তন, মুসলিম জাগরণী সংগীত, পল্লীসংগীত, নাত, ভাটিয়ালি, ছাত্রদের গান, কৃষকের গান, শিশুদের গান, নারী জাগরণীর গান, নৃত্য-সংগীত, শ্রমিকের গান, লেটোর গান, ধীবরের গান, ঋতু সংগীত প্রভৃতি। একইভাবে তাঁর রচিত প্রায় শতাধিক নাটকে শ্রেণিগত ভিন্নতার পরিচয় দেখতে পাই। তিনি নাটক রচনার প্রাথমিক পর্ব লেটো দলের পালা লেখার মাধ্যমে শুরু করলেও অচিরেই শ্রুতি নাটক, মঞ্চ নাটক প্রভৃতি অভিধায় বিভক্ত নাটক রচনায় পারঙ্গমতার পরিচয় দেন। তবে সমকাল কিংবা বর্তমান সময়েও প্রায় ক্ষেত্রে তাঁর নাটক সম্পর্কে বিজ্ঞজনের আগ্রহ তেমন দেখা যায় না। এমনকি সমকালে বাংলা নাটকের আরেক দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাটকও মঞ্চায়নের তেমন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে নিজের নাটক মঞ্চায়ন করেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম সেটা পারেননি সঙ্গত কারণেই। যে কারণে সমকালে তাঁর অধিকাংশ নাটকই মঞ্চস্থ হয়নি। অথচ সে সময়ের নাট্য-পরিচালকগণ অন্য রচয়িতার নাটকের গান কবিকে দিয়ে লিখিয়েছেন।

কাজী নজরুল ইসলামের নাটকের বিভাজনে লক্ষ্য করা যায়, তিনি লেটোর দলের পালা, গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানির জন্য শ্রুতি তথা রেকর্ড নাটক, গীতিনাট্য বা গীতি আলেখ্যের পাশাপাশি বৃহদাকারে মঞ্চ নাটকও রচনা করেছেন। বস্তুত, বাংলা কিংবা বিশ্ব নাটকের শ্রেণি বিভাজনে দৈর্ঘ্যকে আলম্বনপূর্বক যে বিভক্তি করা হয় সে আলোকে নজরুল ইসলামের অধিকাংশ নাটক সমালোচকগণ ‘একাঙ্ক’ বা ‘নাটিকা’ বলে অভিহিত করে থাকেন। উপরন্তু এ কথা সত্য যে, নাটকের শ্রেণি বিভাজনে দৈর্ঘ্য বা অঙ্ক বিভাজনরীতি পরিহার করা আবশ্যক। কেননা, দৈর্ঘ্য যতো স্বল্প হোক না কেন, নাট্যঘটনায় যদি পূর্ণতার ছাপ পরিলক্ষিত হয় তবে ‘নাটক’ নাটক বলেই গণ্য করতে হবে। নজরুল ইসলামের নাটকসমূহও তাই।

কাজী নজরুল ইসলাম দারিদ্র্যের কারণে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে লেটো দলে যোগ দেন। এর অব্যবহিত পরেই তিনি ওস্তাদের দায়িত্ব পান। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর উপর পালা রচনার দায়িত্ব অর্পিত হয়। ১৯১১ থেকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত লেটো দলের জন্য কাজী নজরুল ইসলাম বেশ কয়েকটি পালা রচনা করেন। কিন্তু, লেটো দলের পরিবেশনার জন্য তাঁর লিখিত সবগুলো পালা পাওয়া যায় না। কবি নজরুল লিখিত ১৩টি পালা উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে কালের অতল গ্রাস থেকে। তন্মধ্যে চাষার সঙ, রাজপুত্রের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, শকুনি বধ, মেঘনাদ বধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, কবি কালিদাস, ঠগপুরের সঙ, বিদ্যাভুতুম প্রভৃতি অন্যতম। কবি কাজী নজরুল ইসলাম কেবল পালা রচনাই করেননি, তিনি এই পালাগুলো ‘সুর, সংলাপ ও অভিনয়’র মাধ্যমে আসরে পরিবেশন করতেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাঁর উল্লিখিত পালাসমূহে সংযোগ ঘটেছে তৎকালের জনরুচি এবং দেশজ ঐতিহ্যিক নাট্যসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান।

কাজী নজরুল ইসলাম লেটো দলের পাট চুকিয়ে এক সময় কবি গানের দলে যোগ দেন। সেখানেও তাঁর অন্যতম দায়িত্ব ছিল দলের জন্য পালা রচনা করা। তিনি ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে বহরমপুর জেলে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় একটি পালা রচনা করেন।  কবি পালাটি জেলের বাইরেও পাঠিয়েছিলেন কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই পালাটির আর খোঁজ পাওয়া সম্ভব হয়নি। এরও আগে কবি মাদারীপুরের ‘শান্তি সেনা’ নামক একটি দলের অধিকারী পূর্ণচন্দ্র দাসের অনুরোধে একটি নাটক লিখেছিলেন বলে জানা যায়।

আনুমানিক ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কবি গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগ দেন। এ সময় তিনি বেশ কিছু শ্রুতি নাটক তথা রেকর্ড নাটক রচনা করেন। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের বিনোদনের জন্য এ সময় তাঁর অনেকগুলো নাটক লেখার কথা জানা যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নজরুলের অধিকাংশ শ্রুতি নাটক গ্রামোফোন কোম্পানি সংরক্ষণ করার অবকাশ পায়নি। হারিয়ে যাওয়া সেই নাটকগুলোর মধ্যে কবির লড়াই, ঈদুল ফিতর, খুকী কাঠবিড়ালী, বনের বেদে, কালোয়াতি কসরত, পুতুলের বিয়ে, আল্লার রহম, জুজুবুড়ির ভয়, বাঙালীর ঘরে হিন্দি গান, বিলাতি ঘোড়ার বাচ্চা,  প্ল্যানচেট, খাঁদু দাদু, পণ্ডিত মশায়ের ব্যাঘ্র শিকার, চারকালা, কলির কেষ্ট, প্রীতি উপহার বা বিয়ে বাড়ি, ভ্যাবাকান্ত, বিদ্যাপতি, জন্মাষ্টমী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। লক্ষণীয় যে, কবি নজরুলকৃত অধিকাংশ ‘রেকর্ড’ নাটকের নামকরণে কৌতুকময়তার আভাস বিদ্যমান। ফলে এ কথা নিঃসন্দেহ যে, কবি শিশু-কিশোরদের মনোরঞ্জনের জন্য এগুলো লিখেছিলেন যাতে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের ভেতর দিয়েও আনন্দ লাভ করা সম্ভব হয়।

গ্রামোফোন কোম্পানিতে কাজের পরপরই কাজী নজরুল ইসলাম প্রত্যক্ষভাবে মঞ্চের সাহচর্যে আসেন। এ সময়ে তাঁর নাট্য-প্রকরণশৈলি নান্দনিকতায় পরিবর্তন সূচিত হয়। সমালোচকগণ তাঁর যেসব নাটককে ‘পূর্ণাঙ্গ নাটক’ অভিধায় অভিহিত করেন সেগুলো এ সময়েই লেখা। এ সময়ে কবির নাট্যাঙ্গিকের প্রতি দৃষ্টিপাত করে সমালোচকগণ বলেন ‘তিনি মঞ্চায়নের বিষয়টি শুধু বড় করে দেখেননি, নাটকের পাঠযোগ্যতাও বিবেচনায় রেখেছেন। দেখা ও শোনার এই অদ্বৈত রূপটি গড়ে উঠেছে বাংলা নাটকের হাজার বছরের সংগীতময়তাকে কেন্দ্রে রেখে। এখানেই নজরুলের স্বাতন্ত্র্য এবং শিল্পসিদ্ধি।’

কাজী নজরুল ইসলামের অধিকাংশ নাটক সংরক্ষিত হয়নি। ফলে সুনির্দিষ্টভাবে তাঁর নাটকের সংখ্যা নির্ণয় করা যায় না। তবে সমালোচকগণ তাঁর শতাধিক নাটকের কথা বলে থাকেন। তন্মধ্যে ৮০টির মতো নাটক পাওয়া যায়। উল্লিখিত নাটকগুলো ছাড়াও কবির আরো কিছু নাটক হলো : ঝিলিমিলি, সেতুবন্ধ, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, সাতভাই চম্পা, আলেয়া, শিল্পী, ভূতের ভয়, মধুমালা, কলির কেষ্ট, দেবীস্তুতি, নবার নামতাপাঠ, কে কি হবি বল, বাসন্তিকা, জাগো সুন্দর চির কিশোর, বিজয়া, হরপ্রিয়া, শাল পিয়ালের বনে, সেতু বন্ধ, গুল বাগিচায়, ঈদ, ঝি ও চাকর, কাফেলা, দশ মহাবিদ্যা, বিষ্ণুপ্রিয়া, অতনুর দেশ, বেয়াই-বেয়ান, মধুমালা প্রভৃতি।

কাজী নজরুল ইসলামের উপর্যুক্ত প্রায় সব নাটকেই সংগীতের প্রাধান্য রয়েছে। এর পশ্চাতে মূলত দেশজ ঐতিহ্যিক নাট্যসংস্কৃতি সক্রিয় ছিল। তাছাড়া কবি লেটো দলে যোগ দিয়ে সংগীত সমেত ঐতিহ্যবাহী নাট্যাঙ্গিকের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার অবকাশ পেয়েছিলেন। হয়তো এ কারণেই তাঁর নাটকগুলোতে সংগীতের আধিক্য। একইসঙ্গে একথা ভুললেও চলবে না যে, কাজী নজরুল ইসলামের কালে বঙ্গীয় অঞ্চলে যাত্রাসহ বাংলা নাট্যাঙ্গিকের অন্যান্য রীতিগুলোর প্রভাব ছিল অনস্বীকার্য। অর্থাৎ কবি একাধারে লেটো গান, যাত্রা, পাঁচালী, গীতিকা, মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি নানা পরিচয়ে বিস্তৃত বাংলা নাট্যাঙ্গিকের পরিবেশনা উপভোগ করেছিলেন। তাই এ সকল নাট্যাঙ্গিকের প্রভাব তাঁর নাটকে প্রস্ফুটিত হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। এমনকি কাজী নজরুল ইসলাম নাটক বা পালা রচনা করেছেন বাঙালি দর্শকের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতেও। তিনি তৎসময়ের নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত দর্শকের চাহিদার গুরুত্ব দেয়ার অবকাশ তেমন পাননি বলেই অনুমেয়। ফলে সে সময় কলকাতায় গড়ে ওঠা পাশ্চাত্য প্রভাবজাত নাট্যাঙ্গিকের প্রতি তিনি ধাবিত হননি। বরং স্বদেশীয় সংস্কৃতি তথা ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকের শাশ্বত সংগীতময়তাকে কেন্দ্র করে যাত্রার ক্ষীণ প্রভাবে তাঁর নাটকসমূহ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল। তাঁর নাটকে গানের সংখ্যা যদি বিচার করা হয় তবে এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবেই বলা যাবে যে, আধুনিককালের কোনো লেখকই (নাগরিক জীবনের ছত্রছায়ায় অবস্থানপূর্বক) বাংলা নাটকে এতো বিপুল সংখ্যক গানের ব্যবহার করেননি। কাজী নজরুল ইসলামের আলেয়া নাটকে ২৮টি গান রয়েছে। মধুমালায় আছে ৪৩টি, বিদ্যাপতিতে ২১টি, মদিনাতে রয়েছে ৪৩টি গান। এমন উদাহরণ আরো দেয়া যায়।

কাজী নজরুল ইসলামের নাটকসমূহে গানের আধিক্য বিবেচনায় নিয়ে অনেক সময় সমালোচকগণ তাঁর কোনো কোনো নাটককে গীতি নাট্য কিংবা গীতি আলেখ্যরূপে অভিহিত করার প্রয়াস পান। কিন্তু গীতের আধিক্য গীতিনাট্য হলে বাংলাদেশের হাজার বছরের আসরে পরিবেশনামূলক গেয় কাব্যের অভিনয়রূপটি মিছে হয়ে যায়। কারণ বাংলা নাটকের প্রাণ লুকিয়ে রয়েছে গীতের শরীরে। এই বিচারে নজরুলের আলেয়া গীতিনাটক নয়, পরিপূর্ণ নাটক। গীত তার অবলম্বন, যেমন শরীর অবলম্বন করে থাকে আত্মা। আধুনিক সময়ের অধিকাংশ গবেষক এই মত পোষণ করেন যে, কথা-গান ও নৃত্য সহযোগেই বাংলা নাটকের নান্দনিক সৌকর্য এবং এই তিন অঙ্গের পারম্পর্যেই গঠিত বাংলানাট্যের গঠনশৈলি।

উল্লেখ থাকে যে, কাজী নজরুল ইসলাম অন্যের রচিত নাটকের জন্যও বহু গান রচনার পাশাপাশি গানে সুরারোপ করেছেন। সে নাটকগুলো কিন্তু ‘গীতিনাট্য’ কিংবা ‘গীতি নাটক’ বলে অভিহিত করা হয় না। অথচ তিনি যে নাটকগুলোর জন্য গান রচনা করেছিলেন এর অধিকাংশই ছিল যাত্রাপালা, পালা কিংবা পাশ্চাত্য প্রভাবজাত অঙ্ক বিভাজনের রীতিতে বিকশিত নাটক। বলা আবশ্যক যে, কাজী নজরুল ইসলাম অন্য নাট্যকারের প্রায় ৫০টি নাটকের জন্য গান লিখেছিলেন। তন্মধ্যে, শচীন্দ্র সেনগুপ্ত’র সিরাজদ্দৌলা নাটকের জন্য ৭টি, রক্তকমল-এর জন্য ৯টি, হরপার্বতীর জন্য ১১টি গান লিখেছেন এবং সুরারোপ করেছেন। এমন উদাহরণ আরো রয়েছে। অথচ উপর্যুক্ত নাট্যকারদের নাটক ‘গীতিনাট্য’ হিসেবে মূল্যায়িত হয় না। কিন্তু নজরুল ইসলামের নাটকে গীতের বৈচিত্র্যময় ব্যবহারের জন্যই অনেক ক্ষেত্রে সমালোচকগণ সেগুলো ‘গীতিনাট্য’ অভিধা দিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে তাদের বিবেচনাবোধে পাশ্চাত্য প্রভাবিত নাট্য-বিভাজনরীতির তাত্ত্বিক কাঠামো সক্রিয় বলে অনুমান করা যায়। কেননা, কাজী নজরুল ইসলামের নাটকসমূহে পাশ্চাত্যের অঙ্ক বিভাজন নেই; বরং তাঁর নাটকসমূহ দেশজ নাট্যরীতির সংশ্লেষে বিকশিত হয়েছে।

বলা বাহুল্য, নজরুলের অধিকাংশ নাটকে গানের পাশাপাশি দৃশ্যের বৈচিত্র্যও বিদ্যমান। সেই সাথে ঘটনার নানামাত্রিক নান্দনিক পরিভ্রমণ তো রয়েছেই। বিষয়বস্তু, দৃশ্য, ঘটনা ও গানের বৈচিত্র্যময়তার জন্যই হয়তো তৎকালে, বিশেষত বাংলা চলচ্চিত্রের সূচনালগ্নে তাঁর কয়েকটি নাটক চলচ্চিত্রায়ণ হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে তাঁর বিদ্যাপতি নাটক অবলম্বনে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় বিদ্যাপতি চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৯৩০-এর দশকেই। এমনকি তাঁর মদিনা নাটকটিরও চলচ্চিত্ররূপ নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কবির অসুস্থতাজনিত কারণে তা আর সম্ভব হয়নি।

সর্বোপরি, কাজী নজরুল ইসলাম গান এবং কবিতাসহ সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতোই নাটকেও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। সমকালের নাট্যাঙ্গনে চলমান পাশ্চাত্য প্রভাবজাত নাট্যচর্চার বাইরে গিয়ে দেশজ নাট্যাঙ্গিকের প্রভাবে কাজী নজরুল নাট্যচর্চা করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি অগ্রজ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পাশে পেয়েছিলেন বলা যায়। কেননা, ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যাঙ্গিকের সাঙ্গীকরণের বাংলা নাট্যের বিনির্মাণ প্রক্রিয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতেই সূচিত হয়েছিল। তদ্রুপ কাজী নজরুল ইসলামও বাংলা নাটকের শ্বাশত সুর অবলম্বন করেই নাটকে সংগীতের ব্যবহার যেমন করেছেন, তেমনি পাশ্চাত্যের অঙ্ক বিভাজনরীতি পরিহার করেছেন। একইসঙ্গে তিনি হাজার বছরের বাংলা নাট্যাঙ্গিকের প্রাণভ্রমর সংগীতকে কেন্দ্র করে গীতল ও কাব্যগন্ধী নাট্যাঙ্গিক নির্মাণে সক্রিয় ছিলেন। ফলে সমালোচকের এ কথাই সত্য যে, ‘নজরুলের নাটক বিচার করতে হবে হাজার বছরের নৃত্যগীত ও কাব্যময় বাংলা নাট্যের প্রেক্ষাপটে।’ পাশ্চাত্যের নাট্যরীতির আলোকে নয়। তবেই কাজী নজরুল ইসলামের নাট্যকৃতিকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা যাবে। একই সাথে ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যাঙ্গিকের বিনির্মাণ প্রক্রিয়ায় কাজী নজরুল ইসলামের নাট্য-করণ কৌশল বিচার-বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ মে ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়