ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

নিঃস্ব মানুষের ক্ষোভ

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০৩, ১৬ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ২২:২৮, ১৯ জানুয়ারি ২০২৩
নিঃস্ব মানুষের ক্ষোভ

‘সাত-আট কিলোমিটার পশ্চিমে মেঘনা নদী ছিল। দ্যাখেন নদী ভাঙতে ভাঙতে এখন কোথায়? কি পরিস্থিতির মধ্যে আমরা আছি। চার-পাঁচবার নদীভাঙা শেষ। আমরা কতবার বাড়ি-ঘর পাল্টাতে পারি? জায়গা-জমি, ধন-সম্পদ যা ছিল, সব নদী নিয়া গেছে। এখন শুধু জীবনটা বাকি আছে।’ নদীতীরে দাঁড়িয়ে এক হাত উঁচিয়ে নদীতে হারানো বাড়ির সীমানা দেখিয়ে ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন আবদুল মালেক। বয়স ৬৫ ছুঁয়েছে। লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের লুধুয়া ফলকন গ্রামের সর্দার বাড়ি তার। ঠিকানা বদল করতে করতে আবদুল মালেক এখন জীবন সায়াহ্নে। নদী ভাঙনের শিকার হয়ে শুধু নিজের সহায়-সম্বল হারাননি, হারিয়েছেন গ্রাম, পাড়া-মহল্লার মানুষকেও। হারিয়েছেন স্বজনদের চিহ্ন মাখা কবরস্থান।

সব হারানো আবদুল মালেকের সঙ্গে দেখা হয় নদীপাড়ে। নদীতে হারানো ঠিকানার দিকে চোখ ফেরান তিনি। অশ্রুজলে চোখ ভিজে যায়। বললেন, ‘আমরা কোথায় থাকব এত বার নদী ভাঙলে? এখনো কোনো জমি কিনতে পারিনি। কি দিয়ে কিনমু?’ আবদুল মালেকের এবার হয়তো আর জমি কেনা হবে না। হয়তো শুরু হবে তার সংগ্রামী জীবন। থাকবেন রাস্তায় পাশে কোনোমতে একটি ঝুঁপড়ি ঘর তুলে, নয়তো অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে, না হয় নদীতে জাগা খাসচরে। যা আবদুল মালেকের এক অস্বাভাবিক জীবন যাত্রার সূচনা করবে। একই উপজেলার ৫ কিলোমিটার উত্তরে চর কালকিনির হাজিগঞ্জ এলাকা। সেখানে নদীতীরে দেখা মেলে শাহিনূর বেগম নামের ৩৫ বছরের এক নারী গাছের ডালপালা সংগ্রহ করছেন রান্নার জ্বালানির জন্য। কাছে গিয়ে নদী ভাঙন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই বিষণ্ন মুখে শাহিনূর বেগম বললেন, ‘কোথায় যামু, কোথায় থাকমু? আপনারা যদি কোনো ব্যবস্থা করে দেন, তাহলে বাঁচতে পারমু।’

শাহিনূরের সঙ্গে কথা শেষ না হতেই দেখা মেলে তারই প্রতিবেশী আলতাফ হোসেনের সঙ্গে। আলতাফের ভিটের অর্ধেক নদীতে। তবুও ভিটে ছাড়েননি তিনি। আলতাফের ভাষ্য, এ এলাকায় তাদের একশ-সোয়াশ কানি জমি ছিল, এলাকার হাজিগঞ্জ বাজার তাদের জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এসব এখন স্মৃতি। নদী ভাঙনে ভিটে বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় দিশেহারা এ মানুষটি। কোথাও ঘর উঠানোর মতো সামর্থ নেই তার। ভিটে এখন নদীতে। ঘর সরিয়ে রেখেছেন অন্যত্র। কোথাও তুলতে পারেননি। বিশাল বাড়িটি এখন জনশূন্য।

কয়েক কিলোমিটার উত্তরে নাছিরগঞ্জ বাজার নদীগর্ভে বিলীন হবার পথে। বাজারের মসজিদটি ইতিমধ্যে নদীগ্রাসে বিলীন। এ বাজারেই ব্যবসা করেছেন আবুল বাশার। নদী ভাঙনে প্রতিবন্ধী মানুষটির জীবন হয়ে উঠেছে আরো সংগ্রামী। নদীর ভাঙন ঘনিয়ে আসলেই দোকান সরাতে হয় তাকে। দোকান সরিয়ে আবার একটু দূরেই নির্মাণ করতে হয় দোকান। কারণ, আবুল বাশারের ক্রেতাগণ সবাই নদীতে জীবিকার খোঁজে যান। আবুল বাশারের ভাষ্য, নদী ভাঙনে তার প্রতিবার দোকান সরালে খরচ দাঁড়ায় ৪-৫ হাজার টাকা। যা তার জন্য বাড়তি চাপ। তবুও আবুল বাশারকে জীবিকার টানে দোকান সরিয়ে নিতে হয়। অন্য কোনো কাজ আবুল বাশারের পক্ষে করা সম্ভব নয়।

এভাবে নদী ভাঙনে ৩৫ বছর ধরে বিলীন হচ্ছে কমলনগর। ২৯ কিলোমিটার পশ্চিমে যে নদী ছিল, সে নদী এখন সরে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩ কিলোমিটারে। স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন, ভাঙনের পরিসংখ্যান বলছে এ তিন কিলোমিটার নদীতে ভাঙতে আর সময় লাগবে ৩-৪ বছর। তাই দ্রুত বেড়িবাঁধ নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের দাবি স্থানীয় মানুষের।

ফিরোজ/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়