ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পার্সেল

নাহিদা আশরাফী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৯, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পার্সেল

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

|| নাহিদা আশরাফী ||

জাগতিক জটিলতা সেরে ঘরে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধে ছুঁই ছুঁই। আর ফেরা মানেই তো মুক্তি নয়। দায় দেনার ফিরিস্তি,কর্ম আর কর্তব্যের চুল চেরা হিসেব বুঝিয়ে দিয়ে তবেই না একটু খোলা বারান্দার দেখা মেলে,যেখানে দখিন হাওয়া আমার অপেক্ষায়। অথচ ঘর পেড়িয়ে এই বারান্দাটুকুতে পৌঁছুতে প্রতিদিনই তহমিনা বানুর সেই মধ্যযামিনী।আর অই সময়টুকুতেই তার যত নিজস্বপনা। সকালে অফিসে বেরুবার মুখে কুরিয়ার বয়-এর দিয়ে যাওয়া পার্সেলটি নিয়ে বসবার এখনই উপযুক্ত সময়।

‘আপনিই কি তনু? তৃতীয় তলা পূর্ব পাশে থাকেন?’
কুরিয়ার বয়-এর এই প্রশ্নের কি জবাব দিয়েছিলো তহমিনা এখন আর তা মনে করতে পারছেন না। কী করে পারবে? কম করে হলেও পঁয়ত্রিশ বছর। হ্যাঁ, পঁয়ত্রিশ তো হবেই, বেশিও হতে পারে এ নামে কেউ তাকে ডাকেনি।অথচ জীবনের এতগুলো বছর পার হয়ে সেই নামটিই গোটা গোটা হরফে পার্সেলটির গায়ে লেখা দেখে কি করে নিজেকে স্থির রাখেন তহমিনা বানু? তার হাত কাঁপছিল, সমস্ত শরীরজুড়ে কি এক অদ্ভুত শিহরণ। কিন্তু শারীরিক বয়সের একটা নির্দিষ্ট অবস্থানে এসে অন্তরের প্রগলভতার বাইরের প্রকাশ শোভনীয় নয়।তাই কোনো রকমে পার্সেলটি দরজায় দাঁড়ানো কাজের মেয়েটির হাতে দিয়ে তার রুমের কেবিনেটে রেখে দেবার কথা বলে অফিসমুখী হন তহমিনা বানু।

অফিসের পুরো সময় এক অদ্ভুত উচাটনে ভুগেছেন তহমিনা।পার্সেলটা মেয়েটা ঠিক মতো রেখেছে তো?একবার টেলিফোনে খোঁজ নিলে হয়।টেলিফোনটা হাতে নিয়েও আবার রেখে দেয় সে। কত শত গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক কাজ অফিসে এসে কত অবলীলায় ভুলে গেছে সে।ছেলেমেয়েরাও এ জন্যে তাকে কত অনুযোগ করে। অথচ আজ  সামান্য এই পার্সেলটার জন্যে মাকে ফোন করতে দেখলে কী ভাববে ওরা? এত কিছু ভেবে আর ফোন করা হয়ে ওঠে না।অথচ মনে হচ্ছে বাসায় গিয়ে এক ছুটে পার্সেলটা দেখে এলে বাকিটা সময় সে অফিসে মনযোগ দিতে পারতো।

আদৌ কি পারতো? কে জানে? চশমার ভারী গ্লাসটা দিন দিন আরও ভারী হচ্ছে।সামনে থাকা অনেক কিছু চশমা ছাড়া ভালো দেখতে পান না। কিন্তু কি আশ্চর্য রকমভাবে পঁয়ত্রিশ বছর আগের ঘটনা কত স্পটই না দেখতে পাচ্ছেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ডিপার্টমেন্টে প্রথম পরিচয়েই একে অপরের প্রতি এক অজানা অনুভূতি, একটু একটু করে কাছে আসা, সময়ের পরীক্ষায় নিজেদের পরিপূরক হিসেবে উত্তীর্ণ করানো, অভিমান, খুনসুটি- উত্তাল সব প্রেমময় দিন।ঠিক যেন ট্রেনের জানালায় বসে সতেজ সবুজ দৃশ্যপট একে একে দেখে যাওয়া। কোনো কিছুই ভোলেনিন তহমিনা বানু।

‘তোমার নামটা বড্ড লম্বা। ভাবছি কাটছাট করে আমার মনের মতো করে নেবো।’ নিখিলের এ কথায় শুধু মৃদু হেসেছিলেন তহমিনা।
‘হ্যাঁ,পেয়েছি। তনু, আজ  থেকে তনু ডাকবো তোমায়।’
সেই থেকে নিখিল তার জীবনে থাকা অবধি সে তনু হয়েই ছিলো।নিখিল তার জীবন থেকে চলে যাবার পর সেই যে তনু থেকে তহমিনা হয়েছে আজ  অবধি সেই ভূমিকাতেই যোগ্যতার সাথে কর্তব্য পালন করে আসছে।আজ  সকালে আসা পার্সেলটা এক নিমিষে তাকে আবার তহমিনা থেকে তনুতে ফিরিয়ে নিয়েছে। নাহ্ আর অফিসে বসে থাকার মানে হয় না।সময়ের বেশ আগেই উঠে পড়ে সে।রাস্তার জ্যামগুলো রোজকার চেয়ে দীর্ঘ মনে হয়।অথচ ঘরে ফিরতেই ছেলেমেয়ের অবাক করা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়।

‘এত তাড়াতাড়ি অফিস থেকে তুমি? কোন সমস্যা? শরীর ঠিক আছে তো মা?’ হাজারো প্রশ্নের দায় এড়ানো সত্যিই কঠিন। তবু দায়সারা গোছের একটা উত্তর দিয়ে ছেলেমেয়ের সামনে থেকে সরে গিয়ে হাপ ছেড়ে বাঁচেন তহমিনা। হয়তো সারাদিনের অস্থিরতা, টানাপোড়েন, অপেক্ষার তীব্রতা তার চেহারায় ছাপ ফেলেছিলো। ছেলেমেয়ে তাকে অসুস্থ ভেবে ভুল করে আর বেশি ঘাটায়নি।সেও বেঁচে গেছে। তবু সংসারে নিয়ম নামের কিছু অনিয়ম থাকে।তার দায় এড়ানো মুশকিল।তাই সব নিয়ম অনিয়মের নিয়মতান্ত্রিক পরিচালনা শেষে তহমিনা ফেরে তার নিজ ভুবনে।

সারাদিনের সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নেয়া প্যাকেটটি নিয়ে এখন বসবেন তহমিনা। ধীর পায়ে কেবিনেটের কাছে এসে তনু হয়ে দাঁড়ায় সে। বুকের ধুকপুক শব্দটা ঘড়ির টিক টিক শব্দকেও হার মানায়।কাপা কাপা হাতে কেবিনেট খুলে এ-তাক ও-তাক খোঁজে। কোথায় গেল প্যাকেটটি? পাশে লেখার টেবিল,ওয়ার্ডরব সব পাগলের মতো তন্ন তন্ন করেও খুঁজে না পেয়ে অবশেষে বাধ্য হয়ে সেজ মেয়েকে ডাকলেন।

‘সকালে একটা পার্সেল দিয়েছিলাম রোজির হাতে। কোথায় রেখেছে বলতে পারবে?’
‘মা তুমি না সত্যি বুড়িয়ে যাচ্ছো। পার্সেলটি পাশের ফ্ল্যাটের করিম চাচার ছেলের বৌ তনুর। অবশ্য দোষ পুরোটা তোমারও নয়।পার্সেলে তৃতীয় তলা পশ্চিম লিখতে গিয়ে প্রেরক ভুলবশত তৃতীয় তলা পূর্ব লিখে রেখেছিলো। আর তাতেই যত বিড়ম্বনা। তুমি পূর্ব দেখেই পার্সেলটা নিয়ে এসেছো। ওপরের নামটা দেখবে না?’
 
কী বলবেন তহমিনা বানু।পূর্বপশ্চিম নয়, মূলত নামটা দেখেই পার্সেলটা নিয়েছিলো সে। এ কথা মেয়েকে কি করে বলে তহমিনা? স্থবির তহমিনা ভাবেন একটা ভুল এত বছর পরে নিখিলকে কেমন করে তার জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। ভেবেই নিয়েছিলো তহমিনা তার সব আবেগ আর অনুভূতিকে সে নিজ হাতে গলা টিপে মেরে ফেলতে পেরেছিলো। একটা ছোট্ট পার্সেল তাকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেল বয়স তার শরীরে দানা বেঁধেছে বটে কিন্তু তার অপেক্ষা আজও  তনুতেই স্থির হয়ে আছে।


লেখক : ঢাকা থেকে




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়