ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বহিবারে দাও শকতি || অজয় দাশগুপ্ত

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩০, ১২ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বহিবারে দাও শকতি || অজয় দাশগুপ্ত

বিজয় দিবস নিয়ে লেখাটা আমার কাছে সবচেয়ে গর্বের, আবার বেদনারও বটে। গর্বের কেন সেটা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন পড়ে না। একশ বছর আগে বা আরো শতবর্ষ পরেও এমন কোনো দিন আসেনি আসবে না। সেই হিমসন্ধ্যা, সেই উত্তেজনা, সেই জয় আজ ইতিহাস। ভালো করে ইতিহাস পাঠ করলেই জানা যাবে বাঙালি এমন জয় কোনোকালে পায়নি। যৌথবাহিনী বা মিত্রবাহিনী যাই বলি না কেন, এই বিজয় মূলত আমাদের জয়। যার সূচনা পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে, আর যার পরিসমাপ্তি ঘটে একাত্তরে। মাঝখানে যত কাহিনি, যত আখ্যান- সব আমাদের অর্জন। এই গর্ব আনন্দের ধনকেও আমরা নিজেদের বুকে রাখতে পারিনি। বেদনা সেখানেই।

যখন এত বছর পর আমরা ষোল ডিসেম্বর পালনে অর্থ-বিত্ত বা প্রাচুর্যে ঝলসে উঠতে পারি কিংবা জৌলুসে চোখ ধাঁধায় তখন আরেক চোখে আমাদের বিষাদের ছায়া নামে। কেন এই বিষাদ? আজ আওয়ামী লীগ সরকারে। তারা এদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল। আজ তাদের চ্যালেঞ্জ জানানোর কোনো শক্তিও আসলে মাঠে নেই। একদা আমাদের যৌবনে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটিও বলা যেত না। কত কষ্ট করে আতিকুল হক চৌধুরী বিটিভির এক নাটকে ‘জয় বাংলা’ শব্দটি জুড়ে দিয়েছিলেন। শুনে দেশব্যাপী কি আলোড়ন! কি উত্তেজনা! যেবার হুমায়ূন আহমেদ তাঁর নাটকে ‘তুই রাজাকার’ বলালেন সেবারও কি আনন্দ আমাদের! তখন সময় ছিল বৈরী। বিএনপি, এরশাদ এরা কেউই সঠিক ইতিহাস সামনে আসতে দিতো না। আজকাল খবরের কাগজ বা মিডিয়া খুললেই দেখি আ স ম রব সাহেব কী কী যেন বলেন। একাত্তরে চার খলিফাখ্যাতদের এক খলিফা জনাব রব। তার কাহিনি নিয়ে বিজয় দিবসের লেখা ভারাক্রান্ত করতে চাই না। শুধু বলি, ইতিহাসের নিবিড়তম ঘনিষ্ঠ এই  মানুষটিও একসময় এরশাদকে মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক এবং কেউকেটা বলে ঘোষণা দিতে শুরু করেছিলেন। এই পাপ করেননি এমন মুক্তিযোদ্ধা হাতে গোনা।

কে না জানে, আমাদের বিজয় দিবসে দেশের অনেক বড় বড় নেতা যোদ্ধারা মাঠে ছিলেন না। রেসকোর্সে থাকতে পারেননি। ছিলেন এ কে খন্দকার সাহেব। বহু বছর আগে আমি একবার ‘মেলবোর্ন এজ’ পত্রিকার সাংবাদিক ব্রুস উইলসনের ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম ফোনে। তিনি তখন লন্ডনের একটি নার্সিংহোমে শয্যাশায়ী। জানি না এত বছর পর তিনি আদৌ বেঁচে আছেন কিনা। দারুণ রসিক আর মজার মানুষটি একাত্তরে আমাদের যুদ্ধের খবর সরবরাহ করতেন। প্রায় সাত-আট মাস তিনি ছিলেন ভারতে। আর ষোলো ডিসেম্বরে ছিলেন রেসকোর্স ময়দানে। তিনিও অনেকের মতো কনফিউজড আর বিরক্ত ছিলেন। স্বাধীনতার পরপর বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীনসহ অন্যান্যদের নিহত হবার ঘটনা এঁরা ভালোভাবে নিতে পারেননি। তাদের একটাই কথা, তাহলে কি দরকার ছিলো এত আত্মত্যাগ আর সংগ্রামের? এ কে খন্দকারের কথা বলেছিলেন এজন্যে যে, তিনি যখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন তখন এত মিথ্যা আর গুজব কীভাবে জায়গা পায় সমাজে? তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন।

এরপর আমরা যদি বীরোত্তম কাদের সিদ্দিকীর দিকে তাকাই কী দেখি? তাঁর মতো কজন যোদ্ধা ছিলেন আমাদের? খাঁটি মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম। এমন সাহসী যোদ্ধা কজন ছিলেন সেদিন? তিনি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর অনেক বছর মাংস খেতেন না। সে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে মাংস খাওয়া শুরু করার সাথে সাথে হাঁড় মাংসও পাল্টে গেল। কথা ও কাজে বকধার্মিক হবার পাশাপাশি তিনি কখনো কখনো এমন কথা বলেন, মনে হয় অচিরেই হয়তো একাত্তরের ভূমিকার জন্য মাফ চাইবেন। এইসব পরিবর্তনের কারণ আমরা কি খুঁজে দেখেছি? এদেশের প্রগতিশীলতা আর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি প্রকৃত আনুগত্যের দায় কি কেবল সংখ্যালঘু নামে পরিচিত কিছু মানুষ মুষ্টিমেয় প্রগতিশীল সংখ্যাগুরুর? বামদের আমরা যত গালমন্দ করি না কেন তারা কখনো স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বা মুক্তিযুদ্ধের বাইরে পা রাখে না। চৈনিক বামদের কথা আলাদা। অথচ যে বামেরা এমন তারা সরকারের সাথে নেই, আছেন উল্টোজনেরা।

মিডিয়া এবং সুশীল সমাজেও আছে ব্যাপক বৈপরিত্য। জানি না কেন অনেক আগে বদলে যাবার স্লোগান দেয়া মিডিয়াই এখনো সবার ওপরে। অথচ এরা কি বদলে দিয়েছে আসলে? আমাদের বিশ্বাস। আমাদের জানা আর মূল্যবোধ। এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে আপনি ভাবতে বাধ্য হবেন আসলেই কি পাকিস্তানিরা দুশমন? ভারত বন্ধু? না বঙ্গবন্ধু অবিতর্কিত। সে এক অপকৌশল যার নাম ষড়যন্ত্র। বদলে যাবার নামে খোল নলচে পাল্টে দেয়ার তরুণ-তরুণীরা এখন জানে- একটা পতাকা আছে, একটা গান আছে, আর আছে টাকা। ব্যস এর নামই স্বাধীনতা। আদর্শ, নীতিবোধ, ভালোবাসা, দেশপ্রেমের এই করুণ জায়গায় আমার মতো মানুষ কীভাবে ভরসা পাবে?

একমাত্র ভরসার জায়গা শেখ হাসিনা। একা লড়ে যাচ্ছেন। কি নিদারুণ ধার্মিক ও সভ্য নারীকে আমাদের পছন্দ না। আমরা চাই বিপরীত কাউকে। মুখে নৈতিকতা কাজে অনৈতিক, রাজনীতি ও মানুষদের সমর্থন করাই এখন জনপ্রিয়তা। এই জায়গা থেকে মুক্ত হতে না পারলে দেশ যতই এগিয়ে যাক সমাজ যত স্বচ্ছল হোক, আমরা জাতি হিসেবে বলিষ্ঠ বা সার্থক হতে পারব না। এই ডিসেম্বরে আমরা কি খাঁটি সাধারণ আদর্শপ্রিয় বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধনির্ভর দেশ গঠনের, জাতি গঠনের কাজ শুরু করতে পারব না? এর প্রভাব যে বিদেশেও আমাদের ওপর পড়ে। বাংলাদেশের জয় বা বিজয়হীন আমরা সকলে মূলত অসহায়। তাই বিজয় দিবসের লেখাটি মুলত আনন্দ আর বেদনায় একসাথে গাঁথা। এখন যারা নতুন প্রজন্ম তাদের কাছে বিজয় দিবস মানে আনন্দ। এই আনন্দ মন্দ কিছু না। কিন্তু তাদের মনের কোথাও কিন্তু ইতিহাস নেই। তারা জানেও না কেমন ছিলো সেই দিনের আবেগ। কেমন ছিল উত্তেজনা আর ভয়ের ভেতর বসবাসের আনন্দ। আর বিজয়ের নামে খুলে যাওয়া নতুন আকাশ কীভাবে আমাদের মন খুলে দিয়েছিল। আমি ভাবি কি স্বার্থপর আজকের এই প্রজন্ম। দোষ কেবল তাদের নয়। যে রাজনীতি বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাকে সহজগম্য করার নামে ছোট করার অপচেষ্টা চালায়, যে নেতা-কর্মীরা জয় বাংলাকে খেলো করে তোলে, তাদের কাছে কোনো প্রজন্মই নিরাপদ না। সাথে আছে নানাবিধ ইন্ধন। এ এক আশ্চর্য সমাজ। এখানে ধর্মের নামে এখনো তাণ্ডব চলে। সত্যি যদি আমাদের চার জাতীয় নীতি মানতো কোনো দল, সাম্প্রদায়িকতা এভাবে আঘাত হানতে পারত না। কি মুসকিল দেখুন, স্বাধীনতার পরের বছরেই দেশে মূর্তি ভাঙার শুরু। সেদিন একজন বামনেতা প্রশ্ন করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ যদি মুক্তির গাছ হয়, তাহলে একবছর পর তার ফলের নাম সাম্প্রদায়িকতা হয় কী করে? কেউ তার কথা শোনেননি। ভেবেছিলেন বঙ্গবন্ধু আছেন, নেতারা আছেন- সব ঠিক হয়ে যাবে। হয়নি। উল্টো তাদেরও বিদায় করা হয়েছিল নির্মম ও করুণভাবে।

আর আজ? এক অদ্ভূত বিজয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা। এই বাংলাদেশ আমার বয়সী মানুষদের কাছে অচেনা। এর একদিকে জৌলুস, একদিকে সামনে যাবার তাড়া, একদিকে আনন্দ আর উদ্দীপনা। আরেকদিকে শুধু নিচে নামার প্রতিযোগিতা। বিজয় বা মুক্তি কোনো শব্দ নয়। তার পেছনে কত মানুষের ত্যাগ আর ভালোবাসা। যেদিন আমরা ভারত পালিয়ে যাচ্ছিলাম সেদিন রিকশায় আমার যুবতী দিদিকে বোরকার আড়াল থেকে খুঁজে নেয়া রাজাকারেরা যদি নামিয়ে নিত আমাদের পরিবারে নেমে আসত ঘোর দুর্যোগ। এমন কত পরিবার আর কত স্বজন হারানো মানুষের আর্তনাদে পাওয়া দেশে এখন আসলে কত পার্সেন্ট আনুষ বিজয় দিবস পালন করেন সেটাও গবেষণার বিষয়। আপনারা যাই বলুন আমার মনে হয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে পাকিদের আত্মসমর্পণ একটা বিষয়। সেটা আগে ও পরে অনেক মানুষই মেনে নিতে পারেননি। পারেন না। সাথে আছে ককটেল সমস্যা। এখন রাজনীতি এমন এক ককটেল দিচ্ছে যার নেশায় বুঁদ আমরা। সাথে আছে মিডিয়ার একাংশ সুশীল আর বুদ্ধিবৃত্তি। এই ককটেলে থাকে একমুঠো দেশপ্রেম, দুই চামচ পাকি লবণ, এক চিমটি ভারত আর আমেরিকা। ব্যস এটাই এখন মূল দাওয়াই।

এর একটাও আমাদের জন্য কল্যাণের হতে পারে না। বায়ান্ন থেকে একাত্তর অবদি টানা সংগ্রামে বাঙালি হবার যে ডাক, আর তার যে বিজয়, সে কিন্তু ইউটার্ন করে ফিরে গেছে আবার সাতচল্লিশে। কে তাকে টেনে আনবে? কারা তাকে আবার মাঠে এনে সঠিক জায়গায় দাঁড় করাবে কেউ জানে না। তবু ভরসা আছে। মাটি আকাশ হাওয়া পানি চাঁদ- এগুলো উপাদান কথা বলতে পারে না বটে কিন্তু এদের শক্তি অসীম। এরাই একদিন পথ দেখাবে। সাথে থাকবে কমে কমে শক্ত আর সবল হয়ে ওঠা মুক্তবুদ্ধির প্রজন্ম। এখনো বিশ্বাস করি, পরাজিত হবার জন্য জন্মায়নি বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা ইতিহাস শুদ্ধ করে দিয়ে গেছেন। হয়তো সে পথেই আসবে নতুন বিজয়ের জয়রথ। বলতে ইচ্ছে করে, পতাকা বা সংগীত বা মাটি পেলেই হয় না, তাকে বহনের যোগ্যতাও লাগে বৈকি। পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি হে জন্মভূমি। জয় বাংলা।

লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়