ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘বিবেক তবে কবে ফিরবে?’

জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৩, ২ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘বিবেক তবে কবে ফিরবে?’

রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র পরীক্ষা করছেন একজন স্কুলছাত্র

জাফর সোহেল: ‘বিবেক তবে কবে ফিরবে?’- চার শব্দের একটা ফেস্টুন হাতে কাল ঢাকার রাজপথে নেমেছিল এক শিক্ষার্থী। হাজারো ব্যানার, পোস্টার আর ফেস্টুনের ভিড়ে কিশোরের মাথার ওপরে তুলে ধরা এই এক বাক্যের ফেস্টুনটি আমার কাছে ভিন্নরকম মনে হয়েছে। সবাই যেখানে প্রশস্ত হাসির এক মন্ত্রী মশায়ের গদি ত্যাগ করার দাবি জানিয়ে ক্লান্ত, সেখানে এই কিশোরের মনে জেগেছে এই প্রশ্ন- আমাদের বিবেক কবে ফিরবে? এই যে এত এত আন্দোলন-সংগ্রাম, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ, মানুষের এত কষ্ট- সবকিছুর মূলে তো মানুষের বিবেকের একটা ভূমিকা আছে। বিবেক যখন ঘুমিয়ে থাকে কিংবা হারিয়ে যায় অলক্ষে, কিংবা কেউ ইচ্ছে করেই যখন তাকে নির্বাসনে পাঠায়, তখনই তো সমাজে দেখা দেয় অনাচার। মানুষ তখন মানুষ থাকে না। হয়ে যায় অমানুষ। তখন সে অন্যায় করে, অপকর্ম করে, যা করার নয় তা-ই করে কিংবা যা করার তা করে না।

বিবেকহীন মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। অনেক সময় সে নিজেও জানে না-সে কী করছে! বিবেকহীন মানুষ মাত্রই একেকটা অমানুষ। এই যে তিনজন পরিবহন শ্রমিক মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পায়েলকে ব্রিজ থেকে নদীতে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলল- এটা কি কোনো মানুষের কাজ? কখনোই নয়। এই তিনজন পরিবহন শ্রমিক দেখতে মানুষের মতো হলেও, তারা অন্য কিছু। কারণ তাদের বিবেক মরে গেছে। যদি বিবেক জাগ্রত থাকত তাহলে তারা আহত পায়েলকে চিকিৎসা করাতো, নদীতে ফেলে দিয়ে তারা ওভাবে পালিয়ে আসত না।  সুতরাং যে প্রশ্ন ফেস্টুন হাতে কিশোরের মনে এসেছে সে প্রশ্নটাই এই সময়ের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- আমাদের বিবেক তবে কবে ফিরবে?

বাংলাদেশের যে মন্ত্রী সড়কে ২ শিক্ষার্থীকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলার প্রতিক্রিয়ায় হেসেছেন এবং প্রতিবেশী দেশের সড়ক দুর্ঘটনার তুলনা টেনে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে চেয়েছেন ঠিক সেই মুহূর্তে তার বিবেক হয়তো ঘুমন্ত ছিল। তিনি পরিস্থিতি গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করতে পারেননি। আর এ কারণেই হয়তো ফেস্টুনে কথাগুলো লিখে ওই কিশোরকে রাস্তায় নামতে হয়েছে। তরুণের প্রদর্শিত বাক্যটি হাস্যোজ্জ্বল সেই মন্ত্রীর জন্যই হয়তো। অথবা ঐসব মানুষদের জন্য যারা এই মন্ত্রী মহোদয়ের মতোই কথা বলছেন, কাজ করছেন। আমি বলতে চাই না কিংবা মানতেও চাই না, শিক্ষার্থীরা তার প্রতি আস্থা হারিয়েছে। কিন্তু তারা যদি আস্থা হারায় তাহলে কি তাদের দোষ দেয়া যাবে? অবশ্যই তাদের দোষ দেয়া যাবে না।

গত চারদিন ধরে ঢাকার রাজপথে যেন প্রজাপতির নাচন চলছে। ঝাঁকে ঝাঁকে কিশোর-কিশোরী গোটা ঢাকার রাজপথ-অলিগলিতে একটা ঝংকার তুলেছে। প্রতিবাদের ঝংকার। সহপাঠী হত্যার বিচার তারা চাইছে। চাইছে পরিবহনের শৃঙ্খলা। তারা নিজেরা ধরে ধরে গাড়ির লাইসেন্স চেক করছে, চালকের লাইসেন্স চেক করছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ ক্ষোভে দুএকটি গাড়ি ভাংচুর করলে অন্যরা রাস্তা পরিষ্কারও করে দিচ্ছে। এরা পুলিশ সদস্যদের বলছে, ‘আংকেল, আপনার চায়ের টাকা আমরা দিয়ে দিচ্ছি, তবু আমাদের প্রতিবাদ করতে দিন’! এমন প্রতিবাদ বাঙালি কবে দেখেছে শেষ? ইতিহাস বলে, বাঙালির সব মুক্তি আন্দোলনের পেছনে ছিল এমন নিঃস্বার্থ তরুণ দলের অকাতর শ্রম আর আত্মত্যাগ। বাঙালি ভাষার অধিকার পেয়েছে তার জমিনের তরুণ দলের হাত ধরেই। পৃথিবীর বুকে নতুন জাতির সম্মান নিয়ে স্বাধীনতার স্বাদও পেয়েছে বড় অংশে তরুণ-যুবাদেরই শক্ত বাহুতে ভর করে। তাই আকাশে যত মেঘ তার চেয়ে বেশি আশা আর স্বপ্ন হঠাৎ করে পরশ বোলাতে শুরু করেছে আমাদের মনে- তবে কি মুক্তি এবার মিলবেই?

পরিবহন খাতের নৈরাজ্য থেকে মুক্তি আমরা চাইছি অনেকদিন ধরেই। কিন্তু কে দেবে মুক্তি? তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনিরকে মহাসড়কে চাপা দিয়ে মেরে ফেলার পর দেশজুড়ে একটা হৈ চৈ হয়েছে, পত্রিকা আর টেলিভিশনে আলাপ হয়েছে বিস্তর, মন্ত্রীর হাসিও তখন কিছুটা ফিকে হয়েছিল বটে, কিন্তু ঐ পর্যন্তই। মুক্তি আর মেলেনি। বরং ঐ ঘটনায় চালককে শাস্তির আওতায় আনতে গেলে ঘোষণা ছাড়াই সারাদেশ অচল করে দিয়েছিল পরিবহন শ্রমিকেরা। আচ্ছা, পরিবহন শ্রমিকেরা তাদের বিবেককে সঙ্গে নিয়ে বাঁচেন তো? নাকি তারাও তাদের বটবৃক্ষ নেতার মতো বিবেককে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন?

মুক্তির অন্যতম শর্ত এদেশের পরিবহন মালিকদেরও বিবেক নিয়ে বাঁচা। তারা কি বাঁচেন বিবেকে? বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা তুলে এনেছেন গল্প- যে গল্পে আছে, পরিবহন শ্রমিকদের একপ্রকার জোর করেই অমানুষ বানাচ্ছেন পরিবহনের মালিকেরা। তাঁরা ‘যত আয় তত বায়’ নীতিতে চালিত করেন শ্রমিকদের। ‘জাবালে নূর’ নামে যে বাসটির চালক বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে চাপা দিয়েছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের তার মাথায় তখন ঘুরছিল একটাই চিন্তা- কী করে বেশি যাত্রী ওঠানো যায়, কী করে আয় বাড়ানো যায়। এই চিন্তা করতে করতে ক্লান্ত চালক কী করে নিয়ন্ত্রণ করবেন স্টিয়ারিং হুইল? সেই গাড়িতে চাপা পড়া শিক্ষার্থী দিয়ার বাবাও একজন বাস চালক। তিনি বলছেন, তিনি জানেন এই চালক সঠিক প্রশিক্ষণ পায়নি, সহকারী থেকে তাকে চালক বানানো হয়েছে। যে গাড়ির মালিক সঠিক প্রশিণক্ষপ্রাপ্ত চালক নিয়োগ না দিয়ে কম মূল্যে সহকারীর হাতে স্টিয়ারিং তুলে দেন, তার কি বিবেক বলতে কিছু আছে?

ব্যক্তিগতভাবে জাবালে নূর পরিবহনের দু’একজন মালিককে আমি জানি। জানি তারা কীভাবে পরিবহন পরিচালনা করেন, কাদের দিয়ে পরিচালনা করেন। রাস্তার পুলিশকে তারা কত টাকা দেন, পাড়ার মাস্তানকে কত টাকা দেন, দুর্ঘটনা হলে কীভাবে কম টাকায় মীমাংসা করেন- এসব আমি জানি। আমার ধারণা, গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী খবর কিংবা অন্য কোনভাবে এদেশের বেশিরভাগ মানুষই এসব জানেন। তাহলে আসুন এবার আমাদের যার যার বিবেক ঠিকঠাক জায়গামতো আছে কি না বা কার্যকর কি না তা চেক করি। যে বাস মালিকেরা আমার পরিচিত আমি কি তাকে কখনো বলি- ‘এই যে ভাই, লাইসেন্সবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামাবেন না, ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ে ব্যবসা করবেন না, যথার্থ প্রশিক্ষণহীন চালক নিয়োগ দেবেন না’? বলি না, আমরা কেউ কাউকে কিছু বলি না। কারণ আমরা মনে করি, এতে সম্পর্ক নষ্ট হবে। সে অন্যায় করলে আমার কী?

কিন্তু যেদিন আমি নিজে বা আমার পরিচিত কোন স্বজন ঐ অন্যায়ের কবলে পড়ে পস্তাই তখন আমাদের বিবেক হঠাৎ করে একবারেই নাড়া দিয়ে ওঠে। আমরা সকলে তখন বেশ সচেতন নাগরিক হয়ে যাই।  বিপ্লবী হয়ে উঠি, ফেসবুকের পাতায় পাতায় আমাদের বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে! এই যে উত্তরায় দিয়া খানম মীম আর আব্দুল করিম সজিব মারা গেল- এটাও তো কোন এক মালিকের অন্যায়ের ফসল, নাকি? এই মালিক এমন অন্যায় তো আগেও করেছে, হয়ত অনেকের অজান্তে চাপা পড়েছে আরও আরও মীম আর সজিবেরা- কজন তার খবর রাখি, রেখেছি? এখন এই ঘটনায় শাহাদাত নামে মালিকটিকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি, ভাল কথা। কিন্তু কতজন শাহাদাত এদেশে আছে, কতজনকে গ্রেপ্তার করলে মিলবে মুক্তি? আমাদের চিন্তা করতে হবে এই জায়গায়। এক-দুজন চালক মালিককে গ্রেপ্তার করলেই সব সমাধান হবে না।

দুদিন ধরে সরকারের মধ্যে যেন একটা অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। বুধবার সচিবালয়ে বেশ গুরুগম্ভীর পরিবেশে বৈঠক আর শলা-পরামর্শ করেছেন পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-এমপিরা। পুলিশ ও র‌্যাব প্রধানও ছিলেন সেখানে। বাংলাদেশের সব মানুষের মতো আমারও বিশ্বাস, তাঁরা প্রাথমিকভাবে কীভাবে শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনা সামাল দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যায় সেই আলোচনাই করেছেন। অন্যতম কৌশল হিসেবে বৃহস্পতিবার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ভালো কথা, প্রথম কাজ হলো সবকিছু শান্ত করা, সবাইকে শান্ত করা। সেটা করা হোক। কিন্তু অনুগ্রহ করে, দয়া করে মাননীয় মন্ত্রী-এমপি, পুলিশ-র‌্যাব কর্তারা একটু ঐ জায়গাগুলোতে হাত দিন। যেখানে হাত দিলে পরিবহন শ্রমিকেরা তাদের বিবেক বিসর্জন দিতে বাধ্য হবেন না। দয়া করে শ্রমিক ধরার আগে মালিক ধরুন; মালিক ধরার আগে চাঁদাবাজ নেতাদের ধরুন। অর্ধেক শৃঙ্খলা এতেই নিশ্চিত হয়ে যাবে।       

বিআরটিএ দেখলাম রাজধানীতে সাইনবোর্ড লাগিয়ে মোবাইল কোর্ট বসিয়েছেন। এমন তৎপরতা অতীতেও দেখেছি। কিন্তু ফল কই? এতে হিতে বিপরীত হয়েছে। বাসমালিকেরা সিন্ডিকেট করে কেউ গাড়ি বের করেনি। সাধারণ যাত্রীরা পড়েছেন চরম দুর্ভোগে। আরে মশাই, ফল পেতে হলে এভাবে রাস্তায় নয়, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করুন বাস টার্মিনালে। গোড়ায় ধরুন, দেখুন কয়টা গাড়ি ঠিকঠাক ফিটনেস আছে, কয়টার চালকের লাইসেন্স আছে। রাস্তায় বসলে তো কোন বাস এখানে ধরা দিতে আসবে না- এই সামান্য বিষয়টুকু কি আপনাদের মাথায় কাজ করে না? মোবাইল কোর্ট বসালে মালিকেরা বাস না বের করার ফন্দি করবে– এটাও এখন সবার জানা। তো এই পরিস্থিতিতে সরকারের কী প্রস্তুতি? সরকার কেন মানসম্মত গণপরিবহন রাস্তায় নামায় না? এই বিষয়টি একই সঙ্গে হুটহাট ধর্মঘট ডাকার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পরিবহনখাতে শৃঙ্খলা আনতে হলে ব্যক্তিমালিকানার পাশাপাশি সরকারি মালিকানার পরিবহনও রাস্তায় নামাতে হবে। এটা করা গেলে যেমন কর্মসংস্থান হবে তেমনি সাধারণ মানুষও মালিকদের হাতে যখন তখন জিম্মি হবে না। এ সমস্ত নসিহত অবশ্য বিভিন্ন সময়ে বিশেষজ্ঞরা দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কারণ কর্তৃপক্ষের এসব কথা শোনার সময় কোথায়? কিংবা বলা যায় তাদের বিবেকও ঠিকঠাক কাজ করছে না। যদি কাজ করত তাহলে ওই কিশোরকে ফেস্টুন নিয়ে আজ রাস্তায় দাঁড়াতে হতো না।

লেখক: সাংবাদিক 




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ আগস্ট ২০১৮/তারা   

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়