ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বৈশাখের অপেক্ষায় || ফিরোজ আলম

ফিরোজ আলম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৩, ১৬ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বৈশাখের অপেক্ষায় || ফিরোজ আলম

সকালে ঘুম থেকে উঠে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল ইরিন। হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দ শুনে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। চারদিক অন্ধকার করে মেঘের মেলা বসেছে ঢাকা শহরের আকাশে। শীতল হাওয়ার ঝাপটা বুঝিয়ে দিচ্ছে কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। আজ আষাঢ়ের কত তারিখ? মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন করলো ইরিন। ইংরেজি তারিখটা মনে থাকলেও বাংলা তারিখ মনে থাকে না। তবে তার বাবা আফজাল সাহেবের বাংলা তারিখ খুব মনে থাকে। তাকে জিজ্ঞেস করলেই বলে দেবে আজ কত তারিখ। মন ভালো থাকলে সাথে হয়তো আষাঢ়ের কোনো কবিতা জুড়ে দেবেন।

বাবাকে ডাকতে গিয়ে ইরিন দেখলো তিনি তখনো প্রাতঃভ্রমণ সেরে ফেরেননি। অথচ ৮টা বাজে। ফলে তারিখের কথাটা আপাতত তাকে মাথা থেকে ঝেরে ফেলতে হলো। দ্রুত তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। বৃষ্টি শুরু হলেই রিকশা ভাড়া বৃষ্টির পানির চেয়ে দ্রুত গতিতে বাড়ে। এর চেয়ে বড় সমস্যা রিকশা পাওয়া। হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তায় এসে হাতের ইশারায় এক রিকশাওয়ালাকে থামাল। ভার্সিটি যাবে কিনা জিজ্ঞেস করতেই না-সূচক মাথা নাড়লো। ইরিন তাকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগুতেই রাস্তার ওপারে ছেলেটিকে দেখতে পেলো। রোজ সকালে ওখানেই দাঁড়ায় ছেলেটি। এই দাঁড়ানোটা ইরিনের ঘড়ির সাথে এতটা মেলানো যে বুঝতে সমস্যা হয় না অপেক্ষাটা কার জন্য। রোজ একই দোকানের সামনে একই ভঙ্গিতে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেটি। ইরিন যতক্ষণ থাকে চায়ে একবারও চুমুক দেয় না। এক মনে তাকিয়ে থাকে। তবে রাস্তা  পেড়িয়ে কখনও সামনে এসে দাঁড়ায়নি। প্রতিদিন আড়চোখে ছেলেটিকে দেখে ইরিন ভার্সিটিতে চলে যায়। মাঝে মাঝে ভাবে ছেলেটিকে ডেকে একদিন জিজ্ঞেস করবে উদ্দেশ্য কী? তাছাড়া ছেলেটিকে কেন যেন তার খুব চেনা মনে হয়।

ছেলেটির চিন্তা বাদ দিয়ে ইরিন রিকশা ঠিক করায় মনোযোগ দিল। হঠাৎ অচেনা কণ্ঠে নিজের নাম শুনে চমকে পেছনে তাকালো সে। ওই ছেলেটিই। কথা নেই বার্তা নেই দুম করে প্রশ্ন করে বসলো- কি রিকশা পাওনি আজ?
ইরিন রেগে উত্তর দিলো, নাহ! রিকশা খুঁজছি না। আজ ঠিক করেছি হেলিকপ্টারে যাবো। এরপরও ছেলেটি বেহায়ার মতো জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা তোমার কি আর কোনো ছোট নাম নেই, যে নাম ধরে টুপ করে ডাকা যায়? নিমিষেই ইরিনের রাগ চড়ে গেল। সে রেগে বললো, আমার নাম ছোট-বড় দিয়ে আপনার কী দরকার? আপনি আমার নাম জানলেন কী করে? আর রোজ আমাকে ফলো করেন কেন?
ছেলেটি অপরাধীর মতো মুখ কাচুমাচু করে বললো, আমি তোমাকে স্কুল থেকেই চিনি। পিরোজপুর জেলা স্কুলে আমরা পড়তাম। তুমি ছিলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে আর আমি দশম শ্রেণীতে।

ইরিন বললো, কবে কোন স্কুলে পড়তাম তাই বলে আপনি আমাকে ফলো করবেন?

‘আমি দুঃখিত’ বলেই ছেলেটি উল্টো পথে হাঁটতে থাকলে ইরিনও সামনে থাকা একটি রিকশায় উঠে দ্রুত চলে গেলো।
পরদিন ইরিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেলেটিকে দেখতে পেল না। ইরিন ভাবলো, যাক ধমকে কাজ হয়েছে। এর পরদিনও ছেলেটিকে দেখতে পেল না। একদিন দুদিন করে কিছুদিন পার হলে সে ছেলেটিকে এবার মিস করতে শুরু করল। এভাবে কয়েক মাস পার হলে ইরিন ছেলেটিকে খুঁজতে শুরু করল। পথে ওই ছেলের অবয়বে কাউকে দেখলেই তার সামনে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করে ওই ছেলেই কিনা।

সময়ের চাকা ঘুরতে ঘুরতে ইরিনের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হলো। সময়ের পলিতে ছেলেটির স্মৃতি অনেকটাই ঢাকা পড়লো। এরপর একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি হলো ইরিনের। প্রথম দিন অফিসে ঢুকতেই পিয়ন জিজ্ঞেস করলো, ম্যাডাম কার কাছে যাবেন?
ইরিন বললো, আমি এই অফিসে নতুন জয়েন করেছি। পিয়ন তাকে এইচআর বিভাগে নিয়ে গেলো। জয়েনিং লেটার জমা দিয়ে তার জন্য নির্ধারিত ডেস্কে গিয়ে বসলো ইরিন। তাকে তার রিপোর্টিং বস সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। অফিসের যে দিকটাতে ইরিনকে বসতে দেয়া হয়েছে সেটি একটি ভবনের বর্ধিত অংশ। আশেপাশে অনেক ডেস্ক থাকলেও সেগুলো ফাঁকা। দূরে দুটো ডেস্কে একটি মেয়ে ও ছেলে বসে কাজ করছিল। ইরিনের একা একা একটু ভয় করলেও ফাইল খুলে কাজগুলো বোঝার চেষ্টা করলো। একে তো নতুন চাকরির নার্ভাসনেস, তার ওপর বস এত দ্রুত সব বলে চলে গেলেন যে, কী করতে হবে ইরিন মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিল না। সে যখন খুব বিচলিত তখন একটি ছেলে এসে বললো, ইরিন, তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

ইরিন চমকে উঠে দেখলো, আরে এ তো সেই ছেলে! পিরোজপুর জেলা স্কুলের তার চার ব্যাচ সিনিয়র। যাকে একদিন পথে কিছুটা অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। অনেক খোঁজার পর আজ কাঙ্ক্ষিত ছেলেটিকে পেয়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিল ইরিন। কিন্তু ছেলেটি নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে দূরের ছেলেমেয়ে দুটিকে দেখিয়ে উচ্চস্বরে কথা বলতে নিষেধ করলো। ইরিন ফিসফিস করে বললো, কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন আপনি? আমি আপনাকে অনেক খুঁজেছি। কথাটি শুনে ছেলেটির ঠোঁটের কোণে একটু বেদনামাখা হাসি খেলে গেলো। বললো, তুমি এই অফিসে জয়েন করেছো বলে দেখা করতে এলাম।
ইরিন বললো, আপনিও কি এই অফিসে চাকরি করেন? ছেলেটি উত্তর না দিয়ে বললো, তুমি কি নিয়ে বিচলিত তাই বলো? ইরিন বললো, বস আমাকে কি সব বুঝিয়ে গেলেন তার কিছুই এখন মনে করতে পারছি না। আপনি কি আমাকে হেল্প করতে পারবেন? ছেলেটি হেসে বললো, হেল্প করতে পারি এক শর্তে। যদি তুমি আমার কথা কাউকে না বলো।
ইরিন গম্ভীর স্বরে বললো, আমি শর্ত মেনে কারো উপকার নেই না। বলেই হেসে ফেলল। এরপর বললো, আপনার হেল্প নিতে গেলে আমারো একটি শর্ত আছে। ছেলেটি বললো কী শর্ত? ইরিন বললো, কাজ না বুঝলে বকা দিতে পারবেন না। আর রোজ আমাকে চা খাওয়াবেন। অফিসের ক্যান্টিনে না। রাস্তার পাশের যে দোকানের সামনে আমার জন্য অপেক্ষা করতেন সেই দোকানে। ছেলেটি অনেক কষ্টমাখা চেহারা নিয়ে বললো, আমি যে এখন আর চা খেতে পারি না। বলেই হেসে ফেললো। বললো, এসব কথা বাদ দিয়ে কাজে মন দাও। আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারবোনা। এরপর ইরিনকে একে একে কাজগুলো বোঝাতে লাগলো সে। ইরিন যখন সব বুঝতে পারছিল তখন চাকরির প্রথম দিনের ভয় সরে গিয়ে শরতের কাশ ফুলের মতো দুলতে লাগলো। দূর থেকে ইরিনের বসকে আসতে দেখে আশিক দ্রুত সরে গেলো। বস এসে ইরিনের কাজের অগ্রগতি দেখে কিছুটা তাজ্জব হয়ে গেলেন। বললেন, মিস ইরিন প্রথম দিনই আপনি এত সুন্দর করে কাজগুলো করলেন কি করে? ইরিন মাথা নিচু করে মিটিমিটি হাসছিল। এরপর দিনের বাকিটা সময় আর আশিকের দেখা পেল না ইরিন। বিকেলে অফিস থেকে বের হয়ে রিকশা ঠিক করতে গিয়ে আবার আশিকের সাথে দেখা হলো ইরিনের। ইরিন মজা করে বললো, কি আবার ফলো করছেন নাকি? আশিক কিছুটা ঘাবরে গেলো। ইরিন বুঝতে পেরে হেসে বললো, আমার পাশে এসে বসুন। আর ফলো করতে হবে না। আশিক বললো, আজ না ইরিন। অন্য একদিন। বলেই সে দ্রুত কোথায় যেনো চলে গেলো।

বাসায় ফিরেও ইরিন শুধুই আশিকের কথা ভাবছিলো। তার মা অফিসের কথা জানতে চাইলেন। ইরনি বললো, জানো মা, আমি যে ছেলেটিকে খুঁজছিলাম সে তো ওই অফিসেই চাকরি করে। আমাকে আজ অনেক হেল্প করেছে। ও না হলে প্রথম দিনেই এত কাজ বুঝতে পারতাম না। মা হেসে বললেন, কোন ছেলেটা? যাকে বকা দিয়ে আমার মেয়ের কয়েক বছর যাবৎ মন খারাপ? ইরিন মার সাথে কপট রাগ করে বললো, আমি কি বকা দিয়েছিলাম নাকি? আমি তো শুধু ফলো করে কেন সেটাই বলেছিলাম। ওভাবে ফলো না করে আমার সাথে কথা বললেই তো পারতো। আর একটু কথাতেই অমন অভিমান করবে তা কি আমি জানতাম? আচ্ছা কাল ‘সরি’ বলে দেবো।
মা বললেন, সরি বলতে হবেনা। তুই ছেলেটিকে একদিন বাসায় আসতে বল। কথা বলে দেখি কেমন ছেলে। আচ্ছা বলে দেখবো- বলেই ইরিন নিজের ঘরে চলে এলো। ঘরে ঢুকেই সে তার ডায়েরিটা খুঁজে বের করলো। ৯ আষাঢ়, ২৫ জুন ২০১৪ তারিখটি বের করলো। সেখানে লেখা-

অচেনা আগন্তুক আজ আমার সাথে সাহস করে কথা বলতে এসেছিলো। হয়তো পুরোপুরি অচেনা নয়। তবুও ইচ্ছে করেই একটু বকে দিয়েছি। আসলে আমি তাকে একটু পরীক্ষা করে দেখলাম। আমি যে আশিককে চিনতাম সে তেমনই আছে কিনা। চুপচাপ, নিরীহ ভাবুক টাইপই আছে কিনা এখনো। কাল যদি আবার সে আসে তাহলে তাকে সব খুলে বলবো। পিরোজপুর জেলা স্কুলে পড়ার সময় থেকে যে তাকে আমার ভালো লাগে।

১০ আষাঢ়, ২৬ জুন ২০১৪

সে আজ আসেনি।

পরের দিনের পাতায় শুধু এটুকু লেখা। এরপর শুধুই শূন্য পাতা, কোন লেখা নেই। প্রায় চার বছর পর আবার ইরিন কলম নিয়ে ডায়েরি লিখতে বসলো।

২৫ চৈত্র, ৮ এপ্রিল ২০১৮

আজ অনেকদিন পর আবার তোমার দেখা পেলাম আশিক। এবার আর তোমাকে হারাতে দেব না। আসছে পহেলা বৈশাখে তোমাকে আমার সব কথা খুলে বলবো। অনেক তো অপেক্ষা করেছি তুমি, আমি। আর একটি সপ্তাহ অপেক্ষা করো আশিক। দুজনের অপেক্ষার ইতি টানবো আগামী ১৪ এপ্রিল। পুরোনো এই ডায়েরির এটাই শেষ লেখা। এরপর নতুন ডায়েরিতে লিখবো তোমার-আমার গল্প।

এটুকু লিখে ডায়েরি বন্ধ করে বারান্দায় গিয়ে বসলো ইরিন। হঠাৎ মনে হলো আশিকের ফোন নাম্বারই তো নেয়া হলো না। সেদিন সারারাত ইরিন ঘুমাতে পারলোনা। কখন সকাল হবে আর কখন অফিসে যাবে ভাবতে ভাবতেই রাত পার হয়ে গেলো। সকালে অফিসে ঢুকেই ইতিউতি আশিককে খুঁজতে লাগলো ইরিন। কিন্তু কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারলো না। কারণ আশিক তাকে আগেই তার কথা অন্যদের বলতে নিষেধ করেছিলো। বসের দেয়া ফাইলগুলো নিয়ে ইরিন যখন কাজ করছিল তখন আশিক এলো। হন্তদন্ত হয়ে একটি শাড়ির প্যাকেট রেখে বলল, আমার খুব জরুরি কাজ আছে। তুমি পহেলা বৈশাখের দিন এই শাড়ি পড়ে অফিসে আসবে। সেদিন সবাই লাল পোশাক পরে অফিসে আসবে। নতুন বলে হয়তো তোমাকে খেয়াল করে কেউ বলেনি। বলেই আশিক কোথায় যেনো চলে গেলো। এমন হুট করে কোথায় যে হারিয়ে যায় ছেলেটি।

আশিক চলে যাওয়ার পর প্যাকেটটি খুললো ইরিন। সুন্দর লাল শাড়ি! মনে মনে ভাবলো আজ অফিস থেকে ফেরার পথে আশিকের জন্য একটা লাল পাঞ্জাবি কিনতে হবে।
পহেলা বৈশাখের দিন সকালে আশিকের দেয়া লাল শাড়ি পরে অনেক সময় নিয়ে সাজলো। সাধারণত ইরিন এতো সাজে না। তবে আজকের দিনে সে অনেক কিছুই করতে চায় যা আগে কখনো করেনি। সাজগোজ শেষ করে অফিসের পথে ছুটলো। যদিও অফিসের কার্যক্রম আজ বন্ধ। তবে আজ সারাদিন অফিসে বৈশাখী অনুষ্ঠান হবে। সব ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকেই দেয়া হবে বৈশাখী মেলার স্টল। বিভিন্ন বাঙালি খাবারের অয়োজনের সাথে থাকবে বাউল গানের আসর। এসব আয়োজনের চেয়ে আশিককে মনের কথা খুলে বলার তৃষ্ণায় আজ ইরিন উড়ে অফিসে পৌঁছতে চাইছিল। সামান্য ট্রাফিক সিগনালও তার সহ্য হচ্ছিল না।

অফিসে এসেই সে নিজের ডেস্কে গেলো। সেখানে বৈশাখী শুভেচ্ছাসহ একটি খাম দেখতে পেল। নীল খামটা খুলতেই চারদিকে সুন্দর মিষ্টি কোনো অচেনা ফুলের গন্ধ। কার্ডে শুধু কয়েকটি শব্দ লেখা: ‘এমন হাসিখুশি ও সুন্দর থেকো’। নিচে কারো স্বাক্ষর নেই। এই ‘থেকো’র মধ্যে এমন একটি করুণ সুর ছিল যেনো কেউ তাকে বিদায় জানাচ্ছে। সে দৌড়ে অফিসের ছাদে যেখানে মেলা বসেছে সেখানে গেল কিন্তু আশিককে পেল না। এরপর ক্যাফেটেরিয়া, পেছনের লন সবখানে খুঁজে না পেয়ে আজ আর আশিকের নির্দেশ মেনে থাকতে পারলো না। যেহেতু আশিক মার্কেটিংয়ে কাজ করে সেহেতু প্রথমেই মার্কেটিংয়ের লোপাকে জিজ্ঞেস করলো, লোপা আপু তুমি কি আশিক ভাইকে দেখেছো। লোপা আকাশ থেকে পড়লো যেন! কোন আশিক ভাইয়ের কথা বলছো?- লোপা জানতে চাইলো।

ইরিন তখন অসহিষ্ণু, আরে আপু মার্কেটিংয়ের আশিক-পিরোজপুর বাড়ি। লোপা আবাক হয়ে বললো, তুমি কি কৌশিক আহমেদ আশিক ভাইয়ের কথা বলছো? ইরিন হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বললো, গত দুদিন যাবত তাকে আমি খুঁজছি। কিন্তু পাচ্ছি না। একটি পাঞ্জাবি দিয়েছিলাম তাকে। সেটা আজ আমার ডেস্কে একটি চিরকুটসহ ফেরত দিয়ে গেছে। লোপা বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ইরিনের দিকে তাকিয়ে বললো, চল তোমার ডেস্কে। দুজন ঝড়ের বেগে ইরিনের ডেস্কে গিয়ে পাঞ্জাবি আর নীল খামের চিরকুট পেলেও সেটি ছিল সাদা। কালির আঁচড়ে সেখানে কোনো কিছুই লেখা হয়নি। ইরিন ধপ করে নিজের চেয়ারে বসে কাঁদতে লাগলো। আর গত কয়েকদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো লোপাকে খুলে বললো। সব শুনে লোপাও কাছের একটি চেয়ারে বসল। লোপার চুপচাপ মূর্তি দেখে ইরিন বললো, বলো আপু আমার সাথে কেন সে এমন করলো? আমি না হয় একবার ভুল করে তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম। তাই বলে আমাকে আজ এমন করে অপমান করছে কেন? তুমি তাকে বলে দিও আর কখনো তার সাথে আমি কথা বলবো না। লোপা এবার নিজেই কেঁদে ফেললো। বললো চাইলেই তুমি কিংবা আমি কখনো আর তার সাথে কথা বলতে পারবো না। আজ থেকে চার বছর আগে মিরপুরে রোড এক্সিডেন্টে সে মারা গেছে। আশিক ভাইয়ের বাসা ধানমন্ডি হলেও কেন যেন রোজ মিরপুর হয়ে অফিসে আসতেন। আমরা সেটা নিয়ে মজা করতাম। সেই মিরপুরেই তাকে বাস চাপায় মারা যেতে হলো। কাঁদতে কাঁদতে ইরিন বললো, আপু তুমি কি আমাকে আশিকদের বাড়িতে নিয়ে যাবে?

দুজন মিলে যখন আশিকদের ধানমন্ডির বাড়িতে গিয়ে তারা উপস্থিত হলো তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। একজন পৌঢ়া মহিলা দরজা খুলে বললো, আপনারা কাকে চান? লোপা বললো, আমরা আশিক ভাইয়ের অফিস থেকে খালাম্মাকে দেখতে এসেছি। তাদেরকে বসতে বলে প্রৌঢ়া ভেতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি ফিরলেন এক বৃদ্ধাকে নিয়ে-ইনি আশিকের মা। আমি আশিকের খালা।
লোপা আশিকের মাকে দেখে চমকে উঠলো। বললো, কি অবস্থা হয়েছে খালা আপনার? বৃদ্ধা কষ্টে হাসার চেষ্টা করলেন। বললেন, তোমরা তো আমাকে ভুলে গেছো। আগে তো ছুটির দিন মাঝে মাঝে সবাই মিলে আড্ডা দিতে আসতে। এরপর দেয়ালে ঝোলানো আশিকের ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন, ছেলেটা অভিমান করে চলে যাওয়ার পর আর তোমরা আসো না। বৃদ্ধা ইরিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ইরিন না? ইরিন চমকে উঠলো। কাঁপা কণ্ঠে বললো, আপনি কীভাবে চেনেন আমাকে? বৃদ্ধা উঠে ভেতরে গিয়ে কিছু ছবি আর একটি ডায়েরি নিয়ে এলেন। ছবিগুলো ইরিনের স্কুল ফাংশনের। কোনটাতে নাচছে, কোনটাতে গান গাইছে কিংবা আবৃত্তি করছে। আশিক প্রায় তার সব স্কুল ফাংশনের ছবি জমিয়ে রেখেছে। আশিকের মা ডায়েরিটার শেষ পাতা খুলে ইরিনের সামনে মেলে ধরলেন। মারা যাওয়ার আগের দিন এটাই ছিল ওর শেষ লেখা।

৮ আষাঢ়, ২৪ জুন ২০১৪

ইরিন তোমার কি ছোট কোনো নাম নেই? তোমাকে কাছে ডাকার জন্য তিনটি অক্ষর খরচ করতে যে আমার তর সইবে না। তাই আমি তোমাকে ‘ইরা’ বলে ডাকবো। জানো, আজ মাকে কথা দিয়েছি যেভাবেই হোক কাল তোমার মুখোমুখি হয়ে মনের কথা বলবো। রাজি থাকলে কোনো এক পহেলা বৈশাখে তোমাকে বউ করে ঘরে তুলবো। বাবা নাকি আমার বিয়ের জন্য পহেলা বৈশাখের দিনটিই ঠিক করে রেখেছিলেন। বাবা-মাও পহেলা বৈশাখে বিয়ে করেছিলেন কিনা। এসব লিখছি আর হাসছি। তোমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস পাই না। আর বিয়ের ভাবনা ভেবে ফেলছি। তবে কাল ঠিক তোমার সামনে দাঁড়াবো। এরপর অপেক্ষা শুধু বৈশাখের।

ঝাপসা চোখে লেখাটা পড়ে ডায়েরিটা মুখে ছোঁয়ালো ইরিন। অনুভব করতে চাইলো আশিকের স্পর্শ। অ্যাক্সিডেন্টের পরও ও দুদিন বেঁচে ছিল। আশিকের মায়ের কণ্ঠ শুনে সংবিত ফিরে এলো ইরিনের। ভেজা চোখের করুণ দৃষ্টিতে বৃদ্ধার দিকে তাকালো সে। বৃদ্ধা বললেন, তোমার কাছ থেকে বকা খেয়ে ও কিছুটা আনমনা হয়ে গিয়েছিল। এরপর রাস্তা পার হতে গিয়েই দুর্ঘটনাটা ঘটে। ইরিন সোফা থেকে নেমে বৃদ্ধার পায়ের কাছে গিয়ে বসলো। হুমড়ি খেয়ে কোলের উপর মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বললো, মা আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। আমি ইচ্ছে করে অমন করিনি। বৃদ্ধা তাকে টেনে তুলে পাশে বসালেন- শোন মা আশিক কিংবা আমি কেউ তোমাকে দায়ী করছি না। ওর ভাগ্যে যা ছিল তাই হয়েছে। মারা যাওয়ার আগে আশিক তোমাকে একটি চিঠি দিয়ে গেছে। লেখাটা ওর এক বন্ধুর, কারণ ওর তখন কথা বলাও কষ্ট হচ্ছিল, লিখবে কী করে? বৃদ্ধা চিঠিটি এগিয়ে দিতেই পরম মমতা নিয়ে ইরিন পড়তে লাগলো।

প্রিয় ইরা,

নামটা পড়েই তোমার বোধহয় রাগ হচ্ছে। কিন্তু আমি যে মনে মনে তোমাকে এই নামেই ডাকি। তুমি যখন এই চিঠি পড়বে তখন আমি এত দূরে থাকবো যে রাগ করলেও আমাকে তুমি কিছু বলতে পারবেনা। হয়তো আমার স্মৃতি তত দিনে তোমার কাছে মলিন হয়ে যাবে। তবুও এই চিঠি লিখছি একটি বিশেষ কারণে। তোমার সাথে আমার কথা হওয়া আর অ্যাক্সিডেন্টের যোগসূত্র খোঁজার লোকের অভাব নেই। তুমিও হয়তো এতক্ষণে অপরাধবোধে ভুগছো। শোনো ইরা, তোমার নিজেকে অপরাধী ভাবার কোনো কারণ নেই। আমি এর আগেও বেশ কবার গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি। আমার আনমনা স্বভাব এজন্য দায়ী। তুমি যখন আমাকে বকা দিচ্ছিলে তখন তোমার চোখের কোণে যে হাসি ছিল তা আমার চোখ এড়ায়নি। আর কষ্টটা এখানেই লাগছে। বেঁচে থাকলে আমি ঠিকই কোনো এক চৈত্রসংক্রান্তিতে তোমাকে হলুদ মাখিয়ে দিতাম। এরপর সারারাত তোমার সাথে কথা বলে পরদিন একেবারে আমার কাছে নিয়ে আসতাম। হলোনা ইরা। এই জীবনে আর তা হলো না। মৃত্যুর পর যদি অন্য কোনো জগৎ থাকে তবে সেখানে আমি তোমাকেই পাশে চাইবো।এই তুমি কাঁদছো? প্লিজ আমার জন্য কেঁদো না। মা যদি এখনো বেঁচে থাকেন তবে মাঝে মাঝে মায়ের খোঁজ নিও। আমি ছাড়া মার যে তেমন কেউ ছিলো না।

ইরিন লক্ষ্য করল চিঠির শেষে ‘তোমার আশিক’ লিখে আবার ‘তোমার’ শব্দটা কেটে দেয়া।

চিঠিটা শেষ করে ইরিন বাবাকে ফোন করলো। বললো, বাবা আমি বিয়ে করে ফেলেছি। আমার শ্বশুড়বাড়ির ঠিকানা পরে তোমাদের জানাবো। বলে ফোনটা কেটে দিলো। এরপর ইরিন আর কখনো বাড়ি ফিরে যায়নি। আশিকদের বাড়ি হয়েছে তার স্থায়ী ঠিকানা। ইরিনের বাবা আর আশিকের মায়ের অনেক অনুরোধে সাদা শাড়ি পরা বাদ দিলেও তাকে আর বাড়িতে ফেরানো যায়নি। আসলে কেউ কেউ কখনো ফেরে না। যেমন আশিক আর কোনো দিন ইরিনের জীবনে ফিরে আসেনি। কোনো এক পহেলা বৈশাখে ইরিন ঠিকই আশিকের বাড়িতে এলো। এভাবেই হয়তো পহেলা বৈশাখের অপেক্ষাটা শেষ হলো। হলো কি?




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়