ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বড় সাজা পেয়ে গেছি : ওসি মোয়াজ্জেম

নিজস্ব প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪০, ১৪ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বড় সাজা পেয়ে গেছি : ওসি মোয়াজ্জেম

ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেন দাবি করেছেন, থানায় নারী কর্মকর্তা না থাকায় তিনি নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন হয়রানির বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।

জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও তার মোবাইল ফোন থেকে চুরি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ‌্যমে ছড়ানো হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন মোয়াজ্জেম হোসেন।

বৃহস্পতিবার রাফিকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও ছড়ানোর মামলায় বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানিতে তিনি বলেন, আমি এ মামলার মাধ্যমে বড় সাজা পেয়ে গেছি। আমার ছেলে স্কুলে যেতে পারে না। আমার মেয়ে এবং মা শয‌্যাশায়ী। আমার পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি ১০টি খুন করলেও এমন সাজা বোধহয় আমার হতো না।

ওসি মোয়াজ্জেম নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন। তিনি আদালতে লিখিত বক্তব্যের পাশাপাশি মৌখিক বক্তব্য দেন।

দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে এ মামলায় আত্মপক্ষ শুনানি শুরু হয়। সে সময় ওসি মোয়াজ্জেম কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।

সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর নজরুল ইসলাম শামীম শুনানির শুরুতে ওসি মোয়াজ্জেমকে তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন এবং বাদীসহ ১১ জনের সাক্ষ্য ও অভিযোগ পড়ে শোনান। প্রসিকিউটর সাবেক ওই ওসিকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি দোষী না নির্দোষ? ওসি মোয়াজ্জেম নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন। ওসি মোয়াজ্জেমের কিছু বলার আছে কি না এবং সাফাই সাক্ষ্য দেবেন কিনা জানতে চান বিচারক। জবাবে মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, সাফাই সাক্ষ্য দেবেন না, তবে লিখিত বক্তব্য দেবেন। লিখিত বক্তব্যের কিছু তিনি মৌখিকভাবে বলতে চান। বিচারক অনুমতি দেন। এরপর তিনি মৌখিক বক্তব্য দেয়া শুরু করেন।

মৌখিক বক্তব্যে ওসি মেয়াজ্জেম বলেন, ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে আমার চাকরি হয়। কিন্তু বিএনপি সরকার আসার পর নিয়োগ স্থগিত করে দেয়। সে বিষয়ে রিট করি। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালে চাকরি ফিরে পাই। চাকরিজীবনে অনেক টপ টেরর আসামি ধরেছি। সুনামের সঙ্গে কাজ করায় ২০০ পুরস্কার পাই। গতবছর দুই বার চিটাগং বিভাগে বেস্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর আমি সোনাগাজী থানার ওসি হিসেবে যোগদান করি। আমার চাকরিকালীন প্রিন্সিপাল সিরাজ সম্পর্কে বিভিন্ন অভিযোগ শুনেছি। কিন্তু থানায় কেউ অভিযোগ করতে আসেননি। গত ২৮ এপ্রিল মাদ্রাসায় গণ্ডগোলের কথা শুনে পুলিশ পাঠাই। ওই এলাকার লোক ধর্মান্ধ। কোনো হুজুরের বিরুদ্ধে কিছু বলার উপায় নেই। আমার থানায় তখন কোনো নারী অফিসার ছিল না। তাই আমি মেয়র, আমার অফিসার ও মাদ্রাসার লোকসহ সবার সামনে নুসরাতকে জিজ্ঞাসা করি। সেখানে নুসরাতের দুই বান্ধবী ও মাদ্রাসার কর্মচারী নুরুল আমিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় ভিডিও করেছি।

তিনি আরো বলেন, আমি নুসরাতকে বলেছি, তুমি আমার মেয়ের মতো। আমার প্রমাণের প্রয়োজন ছিল। তাই জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও করি। প্রমাণ পেয়ে মামলা নিয়ে প্রিন্সিপালকে আটক করি। পরদিন ২৮ মার্চ হাজারখানেক লোক প্রিন্সিপালের মুক্তির জন্য মানববন্ধন করে। সেদিন কয়েজন সাংবাদিক আমাকে বলে, নির্দোষ সিরাজ উদ দৌলাকে কেন গ্রেপ্তার করেছি? সেদিন তাদের আমি ভিডিওটি প্রমাণ হিসেবে দেখাই। সে সময় সবাই ছিল নুসরাতের বিপক্ষে। সেদিন শুধু আমিই নুসরাতের পক্ষে ছিলাম। জিজ্ঞাসাবাদের দিন আমি নুসরাতের মাকে আমার মোবাইল নম্বর দিয়ে বলেছি, কেউ ডিস্টার্ব করলে আমাকে ফোন দিতে। ওর মা সেদিন আমার হাত ধরে বলেছিল, তোমার মতো এমন কেউ করবে না। মাদ্রাসায় পরীক্ষার দিন দুজন পুলিশ মাদ্রাসার গেটে ডিউটিতে ছিল। খবর পাই, মাদ্রাসার একজন ছাত্রী গায়ে আগুন দিয়েছে। আমি সোনাগাজী হাসপাতালে ছুটে গিয়ে নুসরাতকে দেখতে পাই। সেখান থেকে দ্রুত ফেনী হাসপাতালে নুসরাতকে পাঠাই। সেখান থেকে আমি অ্যাম্ব্যুলেন্স ভাড়া করে ঢাকা বার্ন ইউনিটে পাঠাই। শাহবাগ থানার ওসিকে ফোন করে বলে দেই ঠিকমতো চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। আগুন লাগানোর দিনই আমি ঘটনাস্থলে যাই। গত ৮ এপ্রিল পর্যন্ত নয়জন আসামিকে গ্রেপ্তার করি। ওই দিন সাংবাদিক সজল আমার সঙ্গে থানায় আসে। আমি মোবাইল টেবিলে রেখে নামাজ পড়তে গেলে সে ওই সুযোগে শেয়ারইটের মাধ্যমে ভিডিও নিজের মোবাইলে চুরি করে নিয়ে নেয়। গত ১০ এপ্রিল রাতে নুসরাত মারা যাওয়ার পর আমি মাটি দিতেও আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার ঊর্ধ্বতন অফিসাররা আমাকে নিষেধ করায় আসিনি। ১২ এপ্রিল ভিডিওটি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ায় চুরির বিষয়টি আমার নজরে আসে। আমি গত ১৪ এপ্রিল ভিডিও চুরি হওয়া নিয়ে থানায় জিডি করি। এরপর গত ১৫ এপ্রিল বাদী আমার বিরুদ্ধে এ মামলা করেন।

সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন আরো বলেন, আমি ভিডিওটি করেছি শুধু প্রমাণ রেখে সিরাজ উদ দৌলাকে আটকের জন্য।

এরপর বিচারক জিজ্ঞেস করেন, আপনার সময়কালে কয়টা নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা তদন্তাধীন ছিল? জবাবে তিনি বলেন, দুই-তিনটা হতে পারে। তারপর বিচারক প্রশ্ন করেন, মোট কয়টা মামলা তদন্তাধীন ছিল? জবাবে মোয়াজ্জেম বলেন, মামলার অর্ধেকের বেশি মাদকের মামলা, বাকিগুলোর অধিকাংশ পলিটিক্যাল মামলা।

এরপর মেয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আমি শুধু নয়জনকে গ্রেপ্তারই করিনি। গত ৬ এপ্রিল নুসরাতের ডাইং ডিক্লারেশন গ্রহণের ব্যবস্থা করি। কিন্তু বাদী (ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন) আমার বিরুদ্ধে শুধু মামলাই করেছে। তিনি নুসরাতের হত্যাকারীদের বিচারের জন্য কোনো ভূমিকা রাখেননি। উনি আওয়ামী লীগের একটি পোস্ট হোল্ড করেন। তাই প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসার জন্য শুধু রাজনৈতিকভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশে এ মামলা করেছেন।

তিনি বলেন, এ মামলার আইও (তদন্ত কর্মকর্তা) আমাকে ডাকলে আমি তাকে তদন্তে সহযোগিতা করেছি। আমি বলতে পারতাম, মোবাইল হারিয়ে গেছে। কিন্তু আমি তা করিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আইও সঠিকভাবে তদন্ত করেননি।

এরপর বিচারক প্রশ্ন করেন, কোন মামলা দায়ের বা তদন্তের জন্য বাদী বা সাক্ষীর বক্তব্য ভিডিও রেকর্ড করার আইনগত আবশ্যকতা আছে কি না? জবাবে মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আইনগত আবশ্যকতা নেই। তবে প্রযুক্তির উন্নতি হওয়ায় এখন প্রত্যেক থানায়ই এমন কাজ করে। তা শুধু আদালত চাইলেই দেখানো হয়। পাবলিশ হয় না।

সর্বশেষ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। আল্লাহর ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস আছে। আপনার (বিচারক) কাছেও আমি ন্যায়বিচার চাই।

তিনি বলেন, আমি এতই ঘৃণিত হয়ে গেছি যে, রংপুরে আমাকে ক্লোজ করার পর আমার বিরুদ্ধে জুতা মিছিল হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুল তথ্য ছড়ানোয় এমনটা হয়েছে।

মোয়াজ্জেম হোসেনের বক্তব্য শেষে আগামী ২০ নভেম্বর যুক্তিতর্কের দিন ধার্য করেন বিচারক।


ঢাকা/মামুন খান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়