ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

উপকূলে নারী-৮

মজুরি বৈষম্যের শিকার নারী কৃষক

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৮, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মজুরি বৈষম্যের শিকার নারী কৃষক

রফিকুল ইসলাম মন্টু

ক্ষেতে ধান কাটায় ব্যস্ত নারী। পেছনে পাহারায় কয়েকজন পুরুষ। কাজে ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে কি না দেখার জন্য নজরদারি করছে তারা। ধানের মৌসুমে মাঠের পর মাঠ পাকা ধান। কাটার লোকের অভাব বলে নারীরা এই কাজে নিয়োজিত হয়। নিম্ন আয়ের পরিবারে আর্থিক টানাপোড়েন কাটিয়ে উঠতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কাজে যোগ দেন। আমন ধানের মৌসুমে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার তমরুদ্দি ইউনিয়নের বেজুগালিয়া গ্রামে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। উপকূলের আরও অনেক স্থানে ধান ক্ষেতে নারী কৃষকদের চোখে পড়ে।  সরেজমিনে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, শুধু ধান কাটা নয়, ধানের চারা রোপণ, ধান শুকানো, ধান মাড়াই, সবজি আবাদ, গরু-ছাগল পালনসহ বিভিন্ন ধরণের কাজে সম্পৃক্ত উপকূলের নারী। পুরুষের অনুপস্থিতিতে নারী প্রধান পরিবারের ব্যক্তি নারী প্রধানত কৃষি কাজের মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করছেন। শুধু উৎপাদন নয়, একাধারে ফসল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িত নারীরা। খাঁটুনি বেশি, কাজে ফাঁকির সুযোগ নেই, আবার কাজের সময়সীমাও বেশি- অথচ মজুরি কম। কৃষিতে নারীর অবদানের কোন স্বীকৃতিও নেই।

উপকূলীয় দ্বীপ হাতিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ফসলের মাঠে নারী কৃষকের দেখা মেলে। অন্যান্য স্থানে সবজি আবাদ, গরু-ছাগল পালন, মৎস্য খামার পরিচালনা, হাঁস-মুরগি পালন, ফসলের ক্ষেত নিড়ানি, মাঠের ফসল ঘরে তোলা ইত্যাদি কাজে অসংখ্য নারীদের দেখা যায়। নারী কৃষক সবিতা রাণী বলেন, পুরুষের চেয়ে আমরা বেশি কাজ করি। কাজে ফাঁকি দেই না। বিড়ি-সিগারেট টানতে আমাদের সময় অপচয় হয় না। সময় ধরে কাজে আসতে হয়, যেতে হয়। তবুও আমাদের মজুরি কম। মালিক বলে, আমরা নারী, আমরা পুরুষের মত কাজ পারি না। হাতিয়ার তমরুদ্দি, সুখচর, নলচিরাসহ বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এখানে নদী ভাঙনের কারণে বহু মানুষ বাপদাদার ভিটে হারিয়ে পথে বসেছেন। অনেকে হারিয়েছেন কাজের সুযোগ। ধারদেনা করে চলা এই অভাবী পরিবারগুলো চালিয়ে নিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও বাইরের কাজে নেমেছেন। নারীদের এই রোজগার পরিবারের অনটন ঠেকাতে সহায়তা করে। কিন্তু বাইরে নারীদের কাজের পরিবেশ নেই, তারা পাচ্ছেন না ন্যায্য মজুরি। কোথাও কোথাও পুরুষের অর্ধেক মজুরি দেয়া হয় তাদের। ভূমি মালিকদের অনেক লাঞ্ছনাও সইতে হয়।



ভয়াল নদীতীরের গ্রাম তমরুদ্দিনের কোড়ালিয়া। এখানে বেড়িবাঁধের পাশে দেখা মেলে জলদাস সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে। এই সম্প্রদায়ের নারী সুলেখা জলদাস, শোভা জলদাস, সাবিত্রি জলদাসসহ আরও অনেকের সঙ্গে কথা হয়। কোড়ালিয়া বাজারে আলাপের সময় জলদাস সম্প্রদায়ের অনেক নারী-পুরুষ জড়ো হন। তারা বলেন, নদীতে মাছধরা আমাদের পূর্ব পুরুষের পেশা। বহুকাল আমাদের সম্প্রদায়ের লোকজন মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করে এসেছে। কিন্তু নদীর ভাঙনের  কারণে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। নদীতে আগের মত মাছও পাওয়া যায় না। ছেলেপেলে নিয়ে আমরা খাবো কী? তাই ঘরের নারীরা বাইরে কাজ করতে বাধ্য হয়। ক্ষেতখামারের কাজে আমরা অভ্যস্ত নই। তবুও করতে হয়। দ্বীপ হাতিয়ায় ঠিক কবে থেকে নারীরা মাঠের কাজ শুরু করেছেন, তা নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেননি। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে বলেছেন, সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ের পর দু’চারজন নারী মাঠে কাজ করতো। পর্যায়ক্রমে ফসলি মাঠে নারী কৃষকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর এই এলাকায় অনেক বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করে। তাদের বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়ে অধিকসংখ্যক নারী ঘরের বাইরে আসতে শুরু করে। হাতিয়া কিংবা অন্য কোন এলাকার নারী কৃষকদের প্রকৃত পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে অপেক্ষাকৃত কর্মহীন অভাবী এলাকাগুলোতে এই হার বেশি। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, হাতিয়ার কোন কোন এলাকায় শতকরা ৫০ শতাংশ নারী ঘরের বাইরের কাজে নিয়োজিত। কৃষি মাঠে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাসন্তী রাণী দাস কিছুটা ভিন্ন প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, কাজের মৌসুমে বাড়তি মজুরি পাওয়ার আশায় এই এলাকার পুরুষেরা ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় কাজে যায়। ফলে এলাকায় পুরুষ কৃষি মজুরের সংখ্যা কমে যায়। তখন ভূমি মালিকেরা মাঠের কাজে টানেন নারীদের। আবার সংসারের অভাব ঠেকাতে নারীরাও সেই ডাকে সাড়া দিয়ে কাজে নামেন। এভাবেই হাতিয়া অঞ্চলে নারী কৃষকের সংখ্যা বেড়ে যায়। পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম মজুরিতে পাওয়া যায় বলে ধান রোপণ, ফসলি ক্ষেতে নিড়ানি দেওয়া, ধানকাটা ইত্যাদি কাজে নারী শ্রমিকের চাহিদাও বেড়েছে।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চরলক্ষ্মী, বয়ারচর, লক্ষ্মীপুরের রামগতির আলেকজান্ডার, ভোলার দ্বীপ কাচিয়া, মদনপুরা, সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরাসহ উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় কৃষি ক্ষেতে নারীদের কাজ করতে দেখা যায়। কিন্তু কাজে নিয়োজিত নারীদের অভিযোগের অন্ত নেই। রেবা বেগম, মরিয়ম বেগম, অনিতা রাণীসহ আরও অনেকে বলেন, নারী হিসাবে আমরা কাজের যথাযথ মূল্যায়ন পাই না। যথাযথভাবে কাজ করলেও মজুরি পুরুষের তুলনায় কম দেয়া হয়। আবার বাজারে কৃষিপণ্য বিক্রি করতে গেলেও মূল্য পাই কম। সব ক্ষেত্রে নারীদের অবজ্ঞার চোখেই দেখা হয়। অথচ আমরাও তো কঠোর পরিশ্রমে কাজগুলো করি। উপকূল অঞ্চলে নারী কৃষকের অংশগ্রহণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন জরিপ নেই। তবে অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের গবেষণাসূত্র বলছে, বাংলাদেশের ৮৮ শতাংশ গ্রামীণ নারী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিকাজে জড়িত। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত বাংলাদেশ শ্রমশক্তি বিষয়ক এক জরিপ বলছে, কৃষি অর্থনীতিতে গ্রামীণ নারীর অবদান ৬৪.৪ শতাংশ এবং পুরুষের অবদান ৫২.৮ শতাংশ। বিবিএসের অপর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক দশকের ব্যবধানে দেশের কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ১০২ শতাংশ। সেখানে পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে ২ শতাংশ। ২০০০ সালে দেশের কৃষিতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩৮ লাখ। ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৫ লাখে। প্রতিবেদন বলছে, ১০ বছরের মধ্যে প্রায় ৭০ লাখ নারী কৃষিতে যুক্ত হয়েছেন। কৃষির বিভিন্ন পর্যায়ে শ্রমবিভাজনের কারণে নারী শ্রমিকের চাহিদা বেড়েছে। বেশিরভাগ পুরুষ পেশা পরিবর্তন করে অ-কৃষিকাজে নিয়োজিত হচ্ছেন, কিংবা গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছেন শহরে। এই প্রতিবেদনে উপকূল এলাকার প্রতিফলন রয়েছে।



গ্রামীণ জীবনযাত্রায় স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান বিষয়ক প্রতিবেদনের তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে মোট নারী শ্রমশক্তির পরিমাণ ১ কোটি ৬২ লাখ। এর মধ্যে ৭৭ শতাংশ গ্রামীণ নারী। যার ৬৮ শতাংশ কৃষিকাজ করে। কাজের মধ্যে রয়েছে পোল্ট্রি, বনায়ন, চাষাবাদ, মৎস্য খাতের বিভিন্ন কাজ ইত্যাদি। অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, কৃষি খাতে নিয়োজিত পুরুষের চেয়ে নারীর অবদান ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ বেশি। এছাড়া কর্মক্ষম নারীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োজিত কৃষি কাজে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) গবেষণায় বলা হয়েছে, গ্রামীণ ৪১ শতাংশ নারী চাষাবাদের সঙ্গে জড়িত। শ্রম জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, গৃহপালিত পশু, হাঁস-মুরগির খামার, ধান ভানা, সিদ্ধ করা, শুকানো, ঝাড়া, প্রক্রিয়াজাতকরণ, খাদ্য সংরক্ষণ ইত্যাদি কাজে জড়িত নারী। কৃষি তথ্য সার্ভিসের উপ-পরিচালক (গণযোগাযোগ) কৃষিবিদ ড. মো. জাহাঙ্গীর আলমের গবেষণায় উঠে এসেছে, ফসল উৎপাদনের ২১টি ধাপের ১৭টিতেই নারীর সরাসরি অংশগ্রণ রয়েছে। এত কাজ করার পরও নারীর কাজকে কাজ হিসেবে গণ্য করা হয় না। উপকূল অঞ্চলে কৃষি খাতে কর্মরত নারী কৃষকেরা সংগঠিত নয় বলে স্থানীয় পর্যায় থেকে কোন দাবি তোলা কিংবা দাবি আদায়ের সুযোগ নেই। তাদের দাবি যথাযথ মূল্যায়নের। তবে নারী কৃষকদের দাবি ওঠে ঢাকায় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড-বাংলাদেশ আয়োজিত জাতীয় নারী কৃষক সম্মেলনে। এতে বলা হয়, নারী কৃষক ও ক্ষেতমজুরকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা কোনোভাবেই নিশ্চিত ও দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব না। এ কারণে, নারী কৃষকের রাষ্ট্রীয় অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত এখন সময়ের দাবি। সম্মেলনে আগত নারী কৃষকেরা বলেন, উৎপাদন পর্যায়ে আমরা যথাযথ মূল্যায়ন পাই না। ন্যায্য মজুরি মেলে না। সামাজিক কারণে আমরা পণ্য নিয়ে বাজারে যেতে পারি না। গোটা বাজার ব্যবস্থা পুরুষের নিয়ন্ত্রণে। ফলে আমরা ন্যায্যমূল্য থেকেও বঞ্চিত হই।

নারী কৃষকদের অধিকার নিয়ে স্থানীয় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ হয়। তারা বলেন, জাতীয় কৃষি নীতিমালায় নারী কৃষকের সুস্পষ্ট সংজ্ঞা সংযুক্ত করে ‘কৃষক’ হিসেবে নারীদের কৃষি উপকরণ সেবা প্রাপ্তিতে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিতে হবে। তাদের কাছে কৃষি সংক্রান্ত সব তথ্য পৌঁছাতে হবে। প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থায় গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে যথাযথ সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তারা বলেন, স্থানীয় পর্যায়ের ভূমি মালিকেরা যাতে নারী কৃষকদের ন্যায্য মজুরি দিতে বাধ্য হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে নারী কৃষকদের সংগঠন গড়ে তোলাও জরুরি।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়