ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

মহাদেব সাহার কবিতায় প্রেম ও বিরহ

সাইফুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৯, ৫ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মহাদেব সাহার কবিতায় প্রেম ও বিরহ

সাইফুজ্জামান : মহাদেব সাহা বাংলা কবিতা ভুবনে উজ্জ্বল নক্ষত্রসম। স্বতন্ত্র তার পথ চলা। তিনি সতত বাংলার প্রকৃতি, প্রেম, বিরহ ও দ্রোহ সঙ্গী করে কবিতা রচনায় নিমগ্ন। এ জন্য বেছে নিয়েছেন কবিজীবন। তার কবিতায় গ্রাম, প্রকৃতি, নদী, নারী অবলীলায় প্রাণ পায়। 

তার আত্মজৈবনিক কবিতা ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিচ্ছবি শুধু নয়, যেন সমষ্টির সুখ-দুঃখ, যাপিত দিন যাপনের কড়চা। সামাজিক, রাজনৈতিক ব্যক্তি অনুভব কবিতাকে মহিমান্বিত করে। বাংলা কবিতায় মহাদেব সাহা এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ কবি। তিনি পাঠকপ্রিয় কবিও। তার কবিতার মূল শক্তি আবেগ। মানবিক এই আবেগ তিনি কবিতায় তুলে ধরেছেন। ফেসবুক, ইন্টারনেট, সেলফোন, ক্ষুদে বার্তা অর্থহীন হয়ে যায় তিনি যখন বলেন-

‘করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও

আঙুলের মিহিন সেলাই

ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,

এটুকু সামান্য দাবি চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো

অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।’

                          (চিঠি দিও)

ষাট দশকের কবিতা অজস্র প্রসু। এই দশকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কবিচিত্ত উদ্বেলিত। পঞ্চাশের ভাষা আন্দোলন, ষাট দশকের গণ-জাগৃতি, গণ-অভুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এই সময় কবি দেখেছেন। বলা চলে ষাটের দশকে মহাদেব সাহা কবিতা চর্চায় রত হয়েছেন। যে কারণে শৈশব, কৈশোর, যৌবনের দেখা মানুষ, মানুষের মনোজাগতিক তাড়না ও মুগ্ধতা তার কবিতায় সহজাত। তার কবিতায় বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা এক পর্যটকের ছবি দেখতে পাওয়া যায়। যিনি ধূসর জীবনের নানা উত্থান-পতন প্রত্যক্ষ করেন। অবশেষে এই জীবন তার কাছে মোহময় বলে মনে হয়। আর তখনই তার কবিতায় প্রেম, প্রকৃতি যুগলবন্দী হয়ে এক নতুন দ্যোতনা তৈরি করে।

চারপাশের দৃশ্যমান জগত সংসারের ঘূর্ণি, নর-নারীর প্রেম-বিরহ, দ্রোহ নিয়ত পথ চলার রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা মহাদেব সাহা কুশলতায় আত্মস্থ করে কবিতার উপাদান করেছেন। মাটির গন্ধ, জীবন রহস্য ও মানুষের মর্মযাতনা তার কবিতা বার বার উঠে এসেছে। তিনি বিশেষভাবে পাঠকপ্রিয় শুধুমাত্র কবিতা লিখে নয়, তার গদ্য সুখপাঠ্য। যদিও তিনি কম লিখেছেন। সেখানেও প্রেম, বিরহ, প্রকৃতিমগ্নতা ও দ্রোহ এক সূত্রে গাঁথা। তার হৃদয়বৃত্তি, বাংলা কবিতাকে  অসাধারণ দ্যুতিময় করে তোলে।


লাল ইটের ডাক বাংলো ফুলজোড় নদীতে বুঝি

ডুবিয়েছে পা

অইখানে কে শুয়ে আছে অমন খালি গা

আমি তাকে চিনতে পারি, নাও পারি, একই কথা

তাতে কারোর মনের ব্যথা

একটুও বাড়বে না, কমবে না

ডাক বাংলো তেমনি নদীর জলে

ডুবিয়ে রাখে পা

                 (ডাক বাংলো: প্রেম ও প্রকৃতি)


মহাদেব সাহার কবিতায় বাংলার প্রকৃতি, মানুষের অন্তর্গত বোধ, সৌন্দর্য ও আর্তনাদ ক্রিয়াশীল। দয়িতার উদ্দেশ্যে তিনি রচনা করেন অসংখ্য পঙ্‌ক্তি। আবার মাধবী বন্দনার পাশাপাশি বর্ষার কান্না, প্রকৃতির উদাসীনতা নিয়ে ঘোরের মধ্যে তার বেদনার্ত উচ্চারণ:

ঢাকার আকাশ আজ মেঘাচ্ছন্ন, মাধবী এখন তুমি বাইরে যেও না

এই করুণ বৃষ্টিতে তুমি ভিজে গেলে বড়ো ম্লান হয়ে যাবে তোমার শরীর

এই বৃষ্টিতে ঝরে যদি কারো হৃদয়ের আকুল কান্না শোকের তুষরি

গলে গলে যাবে এই বৃষ্টির হিমে তোমার কোমল দেহের আদল

মাধবী বৃষ্টিতে বাইরে যেও না। মাধবী তুষার পাতে বাইরে যেও না

এই শহরে বৃষ্টি এলে আমি ভেসে যাই কান্নার করুণ ভেলায়

হাতে নিয়ে তোমার একদা দেয়া উপহারের গোপন এলবাম

এই তুষার বৃষ্টিতে যদি সব ছবি মুছে গিয়ে লাগে জলের গভীর চিহ্ন

শুধু জল আলোর কান্নার মতো করুণ কোমল সেই জল সেই তুষারের দাগ

আমি যদি ভেসে যাই এমনি অর্থে তুষার জলে তুমি তবু নিরাপদে থাকো

                                                                 (শহরে এই বৃষ্টিতে)


তার মানসপ্রতীমা মাধবী, সীতা, নীলা ও অন্যান্য। বিশুদ্ধ প্রেম বন্দনায় মুখর তার কবিতা পবিত্র ব্যাকুলতামগ্ন। কবির ঘুম ও স্বপ্ন দেখা এক সূত্রে গাঁথা। অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ স্বপ্নের মায়াবি পালকে আবৃত। তবু কবি অভিমানে বলেন:

স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি, আজ আমি নিঃশব্দে ঘুমাবো,

আর আমি কিছুই দেখবো না, কিছুই শুকবো না

ঘুমের সুগন্ধে আমি মজে থাকবো সহস্র বছর,

নক্ষত্রের ধূলো আর রাতের শিশির বিন্দু গড়াবে শরীরে

তার ও আগে সব সুখ দুঃখ ভীতি ও ভাবনা আমি চেক পোষ্টে জমা দিয়ে দেবো।

                                         (ভালোবাসা কেন আলো অন্ধকারময়)


মহাদেব সাহা আনন্দ বিষাদ, দুঃখ, বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা কবিতাবদ্ধ করেছেন। চলিষ্ণু সময় মহাকালকে স্পর্শ করে। নগর সভ্যতা, চলমান জীবনের ক্লান্তির বিপরীতে দাঁড়িয়ে তার কাছে মানুষ, তার বোধ ও প্রেম মুখ্য হয়ে যায়। তিনি জীবনবিমুখ নন, তার কবিতা অন্তহীন জীববৈচিত্র্য, মানবিক গুণাবলী এবং যাপিত দিন যাপনের টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। তার সুবোধ্য কবিতা শোক ও আকুলতায় দীর্ণ। যেখানে ব্যক্তিগত বলে কিছু থাকে না। তার কবিতা সমষ্টির আশা-আকাঙ্খার প্রতীক। স্বচ্ছ ও গভীর পর্যবেক্ষণ মহাদেব সাহার কবিতা হৃদয়গ্রাহী করেছে।

বাংলার কবিতা চিরকাল রূপ বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। কবি কলমে ফুল ফোটান, বর্ণনা করেন উপমা ও চিত্রকল্পে। সেই দিক থেকে মহাদেব সাহার দীর্ঘ পথ পরিক্রমা ঘটনাবহুল। প্রেম, বিরহ, স্বদেশ বন্দনা তার কবিতা প্রাণস্পর্শী ও পাঠকপ্রিয় করে তুলেছে। তার সৃষ্টি কুশলতার এই অভিনবত্ব বিদ্যমান থাকুক। ৫ আগস্ট কবি মহাদেব সাহার জন্মদিন। তাকে জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানাই।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ আগস্ট ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়