ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মিডিয়াবাজরাই মিডিয়ার ক্ষতি করছে

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৪, ১২ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মিডিয়াবাজরাই মিডিয়ার ক্ষতি করছে

|| মুম রহমান ||

আমার পরিচিত এক নাট্যাভিনেতা, নাম বলতে চাই না; খুবই বাটপার! নিজ স্বার্থের বাইরে বাপেরেও ‘বাপ’ ডাকেন না। অবশ্যই তিনি ব্যতিক্রম। এর বাইরে অনেক অভিনেতা-শিল্পীকে চিনি যারা যথেষ্ট উদার। যাই হোক, এই ব্যতিক্রমী নাট্যাভিনেতা বিভিন্ন ফেডারেশন, এসোসিয়েশন, সংগঠন করে বেড়ান।

সবলরা কাজ করে, আর অনেকগুলো দুর্বল একত্রিত হয়ে সমিতি, সংগঠন করে। তারপর তারা জনগণের মাথায় কাঠাল ভেঙে খায়। কিন্তু দিন তো চিরকাল এক রকম থাকে না। গ্রামের রাস্তা পাকা হয়। বিদ্যুৎ লাগে। শহর পায় নাগরিক চরিত্র। নগর হয়ে ওঠে বৈশ্বিক। আর ঝামেলা তখনই লাগে। ইন্টারনেট নামের একটা প্রযুক্তি ব্যবহার করে যখন মানুষ এক টানে বিশ্বের যেকোনো শ্রেষ্ঠ নাটক-সিনেমা-অনুষ্ঠান দেখে ফেলতে পারে, তখন এই এসোসিয়েশনঅলারা বড় ঝামেলায় পড়ে যান। কারণ এতোদিন যে পঁচা কাঁঠাল তারা ভেঙেছেন, সে কাঁঠাল এবং কাঁঠালের মালিকদের কেউ তাদের আর তখন গুরুত্ব দেয় না। ফলে যা হবার তাই হয়-দর্শক নাই, শ্রোতা নাই, চালাও ফাঁকা পর্দায় জারিজুরি।

এদিকে পর্দায় যখন পর্দাঅলী বা বেপর্দা কেউ চোখ রাখে না, তখন তারা ভাবেন-দুয়ারটাকে রুদ্ধ করে ভ্রমটাকে রুখি। তারা কণ্ঠ ছাড়েন জোরে-বিদেশি সিনেমা বন্ধ করো, বিদেশি নাটক বন্ধ করো।
এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে, আপনারা বিদেশি কাপড়-চোপর, সাবান-দাবান, খানা-পিনা এসবও বন্ধ করেন। তারা বুঝতেই চান না, চাইলেই আজকের দিনে সব কিছু বন্ধ করা যায় না। বাণিজ্য আর অর্থনীতির ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে বলা যায়, আজকের বাজার সংস্কৃতিতে আপোষে ঢুকতে না দিলে অবৈধ পথে ঢুকবে। তার ফল হবে আরো ভয়াবহ।

তাই বলে কি আমরা নিজস্ব সংস্কৃতির কথা বলবো না? চাইবো না আমাদের দর্শক-শ্রোতা আমাদের মূল স্রোতে ফিরে আসুক? চাইবো। কিন্তু তা আইন-কানুন আর আন্দোলন দিয়ে হবে না। মনে রাখতে হবে, মান, মানের কোনো বিকল্প নাই। মানসম্মত জিনিস সবাই চায়। গরুও চায় তার ভূষি-খইলে ঠিকমতো লবণ মাখানো হোক। একটা গরু পালতেও প্রাথমিক শিক্ষা লাগে। কিন্তু এ দেশে প্রায় কোনো শিক্ষা-দীক্ষা ছাড়াই শিল্পচর্চায় চলে আসেন অনেকে। অমুকের ভাই; হয়ে যাক টিভি সিরিয়াল, তমুকের গার্লফ্রেন্ড; তাহলে সেই সিনেমার নায়িকা। এই ভণ্ডামিটা ছেড়ে, চোখ বন্ধ করে নিজেকে প্রশ্ন করুন। দেখবেন, আপনার চারপাশে যোগ্য লোকগুলোকে পাশ কাটিয়ে সুবিধামতো সুবিধাবাদীদের আপনি আমিই ঠাঁই করে দিচ্ছি। এটা আপনার আমার লজ্জা যে, আমাদের রূপালি পর্দা আর ছোট বাক্স দর্শক টানছে না। কিন্তু এই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হিজাব পরলে হবে না, ওড়না দিয়ে ঢাকলে হবে না। এর মুখোমুখি হতে হবে। মূল্যায়ন করতে হবে সঠিক কারণ, খুঁজে বের করতে হবে অসুবিধাগুলো।

আর দয়া করে নেতাদের মতো ‘বাজেট নাই, বাজেট নাই’ বলবেন না। দুনিয়াতে কয়েক হাজার নাটক-সিনেমা আছে যেগুলো শুধু অল্প বাজেটেই হয়নি, নানা বাধার মধ্যে দিয়ে সেগুলো নির্মিত হয়েছে। ইরানের মতো একটি দেশ আজকে বিশ্ব চলচ্চিত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আফ্রিকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি এগিয়ে এসেছে। তাদের বাজেট আর সুযোগ সুবিধা যে আমাদের চেয়ে বেশি নয়, সেটি বোঝার মতো বুদ্ধি বোধহয় আমাদের মিডিয়া এক্সপার্টদের আছে। 

এসোসিয়েশন করে কোনো কাজ হবে না। যোগ্য নাট্যকার, পরিচালক লাগবে ভালো কাজের জন্য। যোগ্য লোকের যোগ্য সম্মান দিতে হবে। আর ফাউ ফাউ মিডিয়াতে কাজ করানো বন্ধ করতে হবে। যোগ্য লোককে নিতে যোগ্য সম্মান দিন। খালি চামড়ার জোরে দুই দিনের মডেলকে নায়িকা বানিয়ে তাদের মাথায় নিয়ে নাচলে হবে না। তাতে কেবল ভুল-ভাল ইন্টারভিউ দিয়ে লোক হাসানো কিছু মুর্খের জন্ম হবে। পৃথিবীর ইতিহাসটা দেখুন। নাট্য পরিচালক আর নাট্যকাররাই সব বড় বড় মতবাদ আর ঘরাণার সৃষ্টি করেছেন। আর আমরা খালি তারকা তৈরি করছি-ধলা সাবান তারকা, আজগুবি-বাসন-ঘটি তারকা; তেলেসমাতি- স্নো-শ্যাম্পু-জুস তারকা না-বানিয়ে চেষ্টা করুন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যোগ্য শিল্পী তৈরি করতে।

অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে আগে নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করুন। নিজেদের মধ্যে থেকে সেরা কাজ আর মানুষ বাছুন। তাদের সামনে আসার সুযোগ দিন। একজন ব্যক্তিকেও যদি আপনি অন্য কোনো স্বার্থে মিডিয়াতে কাজ দিয়ে থাকেন মনে রাখবেন, যোগ্য আরেক জনকে তাহলে আপনি বঞ্চিত করলেন। আজ যে দেশের নাটক, সিরিয়াল বন্ধ করতে চাচ্ছেন, কথায় কথায় তার সিরিয়াল নকল করা বন্ধ করুন। আপনার নিজের সংস্কৃতি তুলে ধরুন। অন্য দেশবাসী আপনার কাছ থেকে তাদের জিনিস দেখতে চায় না। এ দেশের লোকও তা চায় না। আপনার যা আছে সেই ঐতিহ্য তুলে ধরুন তাহলে বিশ্ব হাতের মুঠোয় অটোমেটিক আসবে।

সত্যজিৎ রায় নূন্যতম প্রযুক্তি দিয়ে গরিব ভারতীয় জীবনের সরলতা দিয়ে বিশ্বকে মুগ্ধ করেছেন। শেখ নিয়ামত আলী ও মশিউদ্দিন শাকের ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’তেও তাই করেছেন। সেলিম আল দীন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, আতিকুল হক চৌধুরীকে পরকীয়া প্রেম আর বউ-শ্বাশুড়ির ঝগড়া নিয়ে নাটক লিখতে হয়নি। আজকে বেঁচে থাকলেও তারা তা না-লিখেই চলতে পারতেন। আপনার হিনমন্যতাই আপনার অপরাধ।

আর ‘দর্শক খায়, দর্শক এমন চায়’-এ সব প্যাঁচাল বাদ দিন। দর্শককে আন্ডারএস্টিমেট করে যা বানাচ্ছেন তা আপনারা নিজেরাও দেখেন না। অতএব সংগঠন, এসোসিয়েশন, আন্দোলন যাই করুন না কেন, হয় নিজেদের কাজের মান বাড়ান, নতুবা যোগ্য লোকদের কাজের জায়গা করে দিন। আর তা না হলে বাড়ি গিয়ে এতোদিন যা কামিয়েছেন তা নিয়েই খুশি থাকুন।  
 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ জানুয়ারি ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়