ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই এবং

সাইফুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০২, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই এবং

সাইফুল ইসলাম : আবারও মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই শুরু হয়েছে। তালিকা থেকে যেন বাদ না পড়েন অথবা যারা এতদিন তালিকাভুক্ত হতে পারেননি তাদের অনেকেরই শুরু হয়েছে দৌড়-ঝাঁপ।

হওয়ারই কথা। কারণ, বাঙালির জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জনে ‘এক ফোঁটা শিশির’ দেওয়ার স্বীকৃতি কে না চায়! কিন্তু রাষ্ট্র কী আসলেই মুক্তিযুদ্ধের ছোট-বড় ঘটনাগুলি লিপিবদ্ধ করে রাখতে এবং সেই দামাল ছেলেদের স্বীকৃতি দিতে চায়? নাকি এটা কোনও রাজনৈতিক খেলা অথবা কিছু মানুষের ফায়দা লোটার ব্যবস্থা? কারণ, ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকবার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা হয়েছে, যা বিভিন্ন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ওই সব তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তুর্ভুক্তির পাশাপাশি ‘স্বাধীনতা বিরোধীদের’ নামও অন্তুর্ভুক্ত হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এবারের তালিকাও বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা  করেছেন অনেকেই। আসলে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী সংরক্ষণে অথবা মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রস্তুতে যে গবেষণা প্রয়োজন তা করার সামর্থ বা সময় এ তালিকা প্রস্তুতকারীদের আছে বলে মনে করেন না অনেকেই।

সেদিন দেশ মাতৃকার ডাকে সাড়া দেয় দামাল ছেলেরা। ‘স্বাধীনতা অথবা মৃত্যু’ স্লোগানটি লেখা থাকতো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। কোনও অর্থনৈতিক সুবিধা বা স্বীকৃতির আশায় তারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল এটা ভাবলে অবিচার করা হবে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। তখন পানির মতো জনগণের মধ্যে মাছের মতো মুক্তিযোদ্ধারা ঘুরে বেড়াতো নিশ্চিন্তে। পানি থেকে তুলে ফেলায় মাছের যে অবস্থা হয়, বর্তমানে গণবিচ্ছিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদেরও একই অবস্থা। তাই মুক্তিযোদ্ধারা তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য যে হন্যে হয়ে ঘুরবেন এটাই স্বাভাবিক। আর এ সুযোগে তাদের করুণা করার সুযোগও পাচ্ছেন কেউ কেউ।

স্বাধীনতার পরপরই কথা তোলা হলো, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর কোনও দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচিয়ে রাখা হয় না। বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে বড় ভুল করেছেন তাদের বাঁচিয়ে রেখে। তার উচিত, সকল মুক্তিযোদ্ধাকে জাহাজে তুলে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে মারা।’ এ সব কথা কারা তুলল, কেন এ কথা প্রচার হলো সদ্য স্বাধীন দেশে, তার রহস্য উন্মোচন করা হয়নি আজও। কিন্তু তখন থেকেই মাথা নত হতে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধাদের। এখন ‘পোষ্যদের চাকরি’, ‘মাসিক সম্মানী’, মৃত্যুর পর ‘গার্ড অব অনার’- এসবে সম্মান-সুবিধা পরিবারে, সমাজে মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে করুণা করা হচ্ছে তা একজন বিবেকবান মুক্তিযোদ্ধার কাছে কখনই সম্মানের হতে পারে না।

যারা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই করেন তারা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কতটুকু জানেন তার প্রশ্ন তোলা ধৃষ্টতা হতে পারে। কিন্তু যাচাইকারীদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকলে এ যাচাই-বাছাইয়ে ভুল তথ্য যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, যেমন অতীতে হয়েছে। কারণ এদের অধিকাংশই যুক্ত হয়েছেন পদাধিকার বলে, যাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না-ও থাকতে পারে। যাচাইকারীরা প্রথমেই প্রশ্ন করেন যে, আপনি কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন? কিন্তু তারা জানেন না যে, যুদ্ধের সময় সাধারণ মুক্তিযোদ্ধার কাছে ‘সেক্টর’ শব্দটি ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। উপর থেকে যুদ্ধটাকে সাজাতে সেক্টর ভাগ করে অস্থায়ী সরকার। প্রতিটি সেক্টরে সেক্টর কমান্ডারও নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু স্বতঃস্ফুর্তভাবে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ফলে ওই সব সেক্টর বা সেক্টর কমান্ডারের সঙ্গে কোনও যোগাযোগই ছিল না সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের। তারা প্রশিক্ষণ নিতেন, স্থানীয়ভাবে বা ভারত থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করতেন। যুদ্ধ করতেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধারা সেক্টর শব্দটি সঙ্গে পরিচিত হন যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে। তাই মুক্তিযোদ্ধারা আজকে এ প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের শেখা বুলিতে। যাচাই-বাছাইয়ে আরো একটি বড় ত্রুটি হলো, বাছাইকারীরা এমন একটি ভাব দেখান যে, তারা তালিকাভুক্ত করলেই একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়। তারা জানেন না যে, কে মুক্তিযোদ্ধা তা নির্ধারণ হয়ে আছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালেই। তাদের বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি খুঁজেই কেবল এ তালিকা করা সম্ভব। কিন্তু যাচাইকারীদের এমন আচরণে মেরুদণ্ডহীন মুক্তিযোদ্ধারা ঘাবড়ে গিয়ে তদবিরের পথ ধরেন। সুযোগ পান দুর্নীতিবাজেরা।

যাচাই-বাছাইয়ে প্রমাণ হিসেবে কাগজপত্র দেখাতে বলা হচ্ছে প্রায়শই। যারা বৈষয়িক তারা কাগজপত্র ফাইল বন্দি করে রাখেন। কিন্তু বৈষয়িক কারো পক্ষে কি ঘরবাড়ি, স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোন ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া সম্ভব? তারপরেও ধরে নিলাম যে বৈষয়িক অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে গেছেন, তারা কাগজপত্র গুছিয়ে রেখেছেন। কিন্তু যারা কাগজপত্র গুছিয়ে রাখেননি, অথচ মুক্তিযুদ্ধ করেননি, তারা কি মুক্তিযোদ্ধা নন? তাদের খুঁজে বের করার কোনও উদ্যোগ কী যাচাইকারীরা নিয়ে থাকেন? এ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক পেক্ষাপটে অনেককেই পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে, ওই সব মুক্তিযোদ্ধারা কি তাদের সার্টিফিকেট রক্ষা করবেন না জীবন বাচাবেন? যেমন রাজনৈতিক কারণে সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ থানার রায়দৌলতপুরের আনিছুর রহমান মামুনের বাড়ি খুঁড়ে পুকুর বানানো হয়েছিল ১৯৭৬ সালে, সে তার সার্টিফিকেট রক্ষা করবে কীভাবে? মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেটের ব্যাপারে বর্তমানে একটি কথা চালু আছে, তা হলো- একাত্তরের রাজাকার যারা মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হয়েছেন তাদের কাগজপত্রই সবচেয়ে সঠিকভাবে গোছানো আছে।

এ ছাড়া কোনো মুক্তিযোদ্ধা যদি যাচাই-বাছাই টেবিলে হাজির না হন, তালিকা থেকে কি তার নাম বাদ দেওয়া হবে? আর কোনও মুক্তিযোদ্ধার নাম যদি তালিকা থেকে বাদ পড়ে তাহলে কী ওই তালিকাকে সঠিক তালিকা বলা যাবে? আসলে কোনও মুক্তিযোদ্ধার নামই তালিকা থেকে বাদ যাওয়া উচিত নয়, কারণ, একজনের নাম বাদ পড়লেও মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় থেকে বঞ্চিত হবে জাতি।

যেমন, সিরাজগঞ্জ মহুকুমা মুক্ত হয় ১৪ ডিসেম্বর। এ সময় পাকিস্তানি প্রশাসনের মহুকুমা প্রশাসক মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অন্তরীণ হন। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নতুন মহুকুমা প্রশাসক যোগদানের আগে পর্যন্ত ওই পদে দায়িত্ব পালন করেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন। তিনি এখন আমেরিকা প্রবাসী। এখনও তার কথা উঠলে অনেকেই বলেন এসডিও ইসমাইল। স্বাভাবিক কারণেই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই বলে কি তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন? অথচ তালিকা থেকে তার নাম বাদ পড়লে মুক্তিযোদ্ধারা যে একটা প্রশাসন গড়ে তুলেছিল সে বিষয়টিই এক সময় ভুলে যাবে এ জাতি।

সিরাজগঞ্জের আরো একজন মুক্তিযোদ্ধার কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, নাম তার কুয়াত-ইল ইসলাম। বাড়ি বেলকুচির ধুকুরিয়া বেড়া ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে। ১৯৬৯-৭০ এ তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদে (রাকসু) সহ-সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে একদল মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ফিরে আসেন নিজ এলাকায়। এলাকায় তখন স্থানীয় এবং ভারতে প্রশিক্ষণ নেওয়া বেশ কয়েকটি মুক্তিযোদ্ধা দল তৎপর। তিনি বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা দলের সমন্বয়, শীর্ষ নেতাদের দিকনির্দেশনা, রাজনৈতিক সচেতনতা, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ পরিচালনা এবং মনস্তাত্ত্বিক মাত্রা চাঙ্গা রাখার লক্ষ্যে একটি পত্রিকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। অক্টোবরে তার দলে এ নিয়ে আলোচনা হয়। কেউ কেউ পত্রিকা প্রকাশের দ্বিমত পোষণ করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠরা কমান্ডারের এ প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। পত্রিকার নাম দেওয়া হয় ‘বাংলার মুখ।’ তাঁত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত বেলকুচি এলাকায় সেকালেও কাপড়ের লেবেল ছাপানোর জন্য বেশ কয়েকটি ছাপাখানা ছিল। পত্রিকার জন্য একটি ছাপাখানার প্রয়োজনীয়তার কথা জানানো হয় দৌলতপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমানকে। তিনি এ পরিকল্পনা শুনে খুশি হন। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে আওয়ামী লীগের শতাধিক কর্মী নিয়ে পাশ্ববর্তী গ্রাম থেকে একটি ট্রেডল প্রেস নিয়ে আসেন এবং তা বসিয়ে দেন দৌলতপুর হাইস্কুলের পাশে। বাকি থাকে পত্রিকার প্রকাশের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির। দলের মধ্যে আলোচনা শেষে মুক্তিযোদ্ধা দলের কমান্ডার কুয়াত-ইল ইসলাম ও আরেক মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলম যান উল্লাপাড়া থানার রামগাঁতী গ্রামে অবস্থানরত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন প্রভাষক জুলফিকার মতিনের কাছে। তিনি সে সময় নিজ বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনার কথা জানান এবং পত্রিকাটি সম্পাদনার দায়িত্ব নেয়ার প্রস্তাব দেন। তিনি প্রেস জোগাড়ের কথা এবং কাগজ সংগ্রহের পরিকল্পনার কথা শুনে পত্রিকার দায়িত্ব নিতে রাজি হন। জুলফিকার মতিনের সম্পাদনায় শুরু হয় বাংলার মুখ প্রকাশের কাজ। ‘বাংলার মুখ’ ছাপা হয়ে বের হলে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে। ১৬ ডিসেম্বরের আগেই পত্রিকাটির দুটি সংখ্যা প্রকাশ করা হয়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা বেশ কয়েকটি সাইক্লোস্টাইল পত্রিকা বের হওয়ার খবর জানা গেছে। ছাপাখানা জোগাড় করে কোনও পত্রিকা বের করার ঘটনা আরো আছে কিনা তা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণারতরা বলতে পারবেন।

এখন এই ইসমাইল হোসেন, কুয়াত-ইল ইসলাম বা জুলফিকার মতিন যদি যাচাই-বাছাইয়ের টেবিলে হাজির হতে না চান তবে কী তারা মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ পড়বেন? আর যদি তাদের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায় তাহলে কি মুক্তিযুদ্ধের এই সব উল্লেখযোগ্য ঘটনা ইতিহাস থেকে বাদ পড়ে যাবে না? আর তারা যদি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত না হন তবে কি ওই তালিকাকে সঠিক তালিকা বলা ঠিক হবে?

আসলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বা মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রস্তুত একটি এলেবেলে ছেলেখেলা নয়। এটি একটি বিশাল গবেষণার ব্যাপার। এটি কোনও ক্রমেই তড়িঘড়ি করে একটি সময় বেধে দিয়ে করা সম্ভব নয়। যেহেতু বাঙালির জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধ একটি গৌরবজনক অধ্যায়, তাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে কোন কাজ মনযোগ দিয়ে দরদ দিয়ে করাই উচিত, কারণ এর ওপর নির্ভর করছে বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ পথচলা।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/সাইফুল ইসলাম/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়