ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

যে আন্দোলন ছড়িয়ে গেল সবখানে

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২০ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যে আন্দোলন ছড়িয়ে গেল সবখানে

অলোক আচার্য : গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের

জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট

উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়…

আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা

সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;

আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা ।

লাইন কয়েকটি কবি শামসুর রাহমানের বিখ্যাত কবিতা আসাদের শার্টের। আবার প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ৬৯ এর প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখা  ‘মাতাল হাওয়া’ বইটি উৎসর্গ করেছেন শহীদ আসাদকে। তিনি তার বইয়ের উৎসর্গপত্রে লেখেন, ‘কোনো মৃত মানুষ মহান কোনো আন্দোলন চালিয়ে নিতে পারেন না। একজন পেরেছিলেন। আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। তার রক্তমাখা শার্ট ছিল ঊনসত্তুরের গণআন্দোলনের চালিকাশক্তি।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে যে নামটি জ্বলজ্বল করে জ্বলছে সেটি শহীদ আসাদের নাম। যার রক্তমাখা শার্ট এ দেশের প্রাণের লাল পতাকার রঙে রাঙানো সেটি শহীদ আসাদের শার্ট। শহীদ আসাদ ১৯৪২ সালের ১০ জুন নরসিংদী জেলার শিবপুর থানার ধানুয়া গ্রামে জন্ম নেন। শিবপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬৭ সালে তিনি এম. এ ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের পরিক্রমায় বহু ঘটনা জড়িত। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র দুটির জন্ম হওয়ার পর থেকে বাঙালি জাতির প্রতি বিদ্বেষ আর ঘৃণার প্রকাশ করতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তান মূলত পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ডকে তাদের আয়ের উৎস হিসেবে ব্যাবহার করে। সেজন্য পূর্ব বাংলার মানুষকে যাচ্ছেতাইভাবে শোষণ করতে থাকে। শাসন ও শোষণের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়।

পূর্ব পাকিস্তানের ওপর ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র সফল না হওয়ায় তারা বিভিন্নভাবে বাঙালি জাতিকে দমিয়ে রাখার কৌশল অবলম্বন করে। তাদের ক্রমাগত ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রবণতা এবং বাঙালির দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার অবস্থা ক্রমেই স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধাবিত হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন সময়ে দেশে কয়েকটি বড় বড় আন্দোলন ঘটে। ১৯৬৯ সালের গণঅভূত্থান এবং শহীদ আসাদের নাম আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি রচনায় আন্দোলনের সঙ্গে শহীদ আসাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সরকারের বিরুদ্ধে এ দেশের ছাত্রসমাজের ১১ দফা কর্মসূচির মিছিলে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ছাত্রনেতা আসাদ। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ১১ দফা বাস্তবায়ন ও ইপিআরের নির্যাতনের প্রতিবাদে ধর্মঘট ডাকা হয়। সেই ধর্মঘট ও আন্দোলন পণ্ড করার উদ্দেশ্যে মোনায়েম খানের প্রাদেশিক সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। দুপুর ১২ টার দিকে হাজার হাজার মানুষের বিশাল মিছিল সেই ১৪৪ ধারা ভেঙে রাস্তায় নেমে আসে। এদিন একটি মিছিলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আসাদ। যার পুরো নাম আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। পুলিশ তাকে গুলি করে হত্যা করে। আসাদকে থামিয়ে ভেবেছিল আন্দোলন থামানো যাবে। কিন্তু ওরা ভাবতেও পারেনি সেই আন্দোলন সুনামির ঢেউয়ের মতো আছড়ে পরবে শাসকগোষ্ঠীর ঘাড়ে। আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে সেই সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো মানুষের মিছিল হলো। যে আন্দোলনে ভিত কেপে ওঠে পশ্চিম পাকিস্তানের। বাঙালিকে দমিয়ে রাখা যে বৃথা চেষ্টা ছাড়া কিছু নয় তা বোধহয় বুঝতে পেরেছিল।

আসাদের আত্মত্যাগকে স্মরণীয় করে রাখতে আসাদের শহীদ হওয়ার দিনটিকে শহীদ আসাদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আসাদের রাজপথে শহীদ হওয়া, গণঅভ্যুত্থান, সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরুঙ্কুশ বিজয়, ক্ষমতা হস্তান্তর না করা এবং সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাক, মুক্তিযুদ্ধ, অতঃপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ এসব ঘটনাই এক সুতায় গাঁথা।

আওয়ামী লীগের ছয় দফা ও ছাত্র সমাজের ডাকা ১১ দফা কেন্দ্র করে দেশে সর্বস্তরের মানুষের জোয়ার নামে। মনে তাদের একটাই স্বপ্ন। স্বাধীনতা। গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের পতন ঘটে আরেক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় বসেন। ঘোষণা করেন সাধারণ নির্বাচন। যে মুক্তির আশায় বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেছিল সেই মুক্তির চেতনা আরো দুই বছর আগেই বাঙালির হৃদয়ে স্থান পেল। আসাদের রক্তে রঞ্জিত লাল শার্ট তখন কোনো সাধারণ শার্ট ছিল না। তা ছিল আমাদের স্বাধীনতার রং, আমাদের স্বাধীন দেশের পতাকা।

১৯৬৮ সালে লেখা আসাদের ডায়রি থেকে তার বিপ্লবী চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। আসাদের চিন্তা চেতনা ছিল এ দেশকে ঘিরে। এ দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তির কথা তার অন্তরে লালন করেছেন তিনি। কে জানতো তার সেই চিন্তা একদিন লাখ লাখ মানুষের স্বপ্ন হয়ে মুক্তিযুদ্ধের রূপ নিয়ে এ দেশটাকে স্বাধীন করবে। স্বাধীনতার জন্য এ দেশের মানুষ বুকের রক্ত দিতে পারে তা শাসক গোষ্ঠীকে ১৯৫২ সালের পর আসাদ আবার বুঝিয়ে দিয়ে গেল। ছাত্রনেতা আসাদকে গুলি করে হত্যা করার মধ্যে দিয়ে দেশের আন্দোলনকে থামাতে চেয়েছিল। কবির কবিতায়, লেখকের লেখায় বাংলার মানুষের হৃদয়ে আজ শহীদ আসাদের নাম লেখা রয়েছে। আসাদের সাহস, স্বদেশ চেতনা মুক্তিকামী তরুণদের পথ দেখায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে আসাদের আত্মত্যাগ উজ্জীবিত করেছিল এ দেশের লাখ লাখ মুক্তিকামী আসাদকে। আসাদ তখন ঢুকে গেছে সেসব মুক্তির স্বপ্ন দেখা যুবকের হৃদয়ে। আসাদ তাই তখন কেবল একজন সাধারণ ছাত্রনেতা নন, আসাদের রক্তাত্ত শার্ট তাই কেবল সাধারণ একটি রক্তাত্ত শার্ট নয়। শহীদ আসাদের মতো আত্মত্যাগকারী স্বাধীনচেতা মানুষ যুগে যুগে স্বাধীনতার জয়গান গেয়ে যায়। পরাধীনতার গ্লানিকে তারা ঘৃণা করে এবং অন্যকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখায়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ জানুয়ারি ২০১৯/ইভা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়