ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

রাক্ষুসে মেঘনা গিলছে বাজার

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১২, ২৭ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রাক্ষুসে মেঘনা গিলছে বাজার

জুনাইদ আল হাবিব: মেঘনাতীরের পথ ধরে হাঁটছি। সময় পড়ন্ত বিকেল। নদীতে তখনো ভাটা। তবে ঢেউয়ের গতি জানান দেয় নদী এখন উত্তাল। নদী যে প্রতিনিয়ত মানুষকে ভিটেহারা করছে, তার প্রমাণ মেলে তীরের ভাঙনের দিকে তাকালে। দক্ষিণ দিক থেকে উত্তরে হাঁটতে হাঁটতে একটু সামনে এগিয়ে গেলে চোখে পড়ে নাছিরগঞ্জ বাজার থেকে দক্ষিণে বয়ে চলা জোয়ার রক্ষার বেড়িবাঁধ- যা নদীতে প্রায় বিলীন। বাজারের একেবারে গাঁ ঘেষে মেঘনা রাক্ষুসে ছোবলে গিলে খাচ্ছে চারপাশ।

দু’পা সামনে না বাড়াতেই দেখা শাহনূর বেগমের সঙ্গে। বয়স ৫০ ছুঁয়েছে। শাহনূর বেগম জানেন নদীতে তিনি বাড়ি হারাবেন। ইতিমধ্যে বাড়ির যে গাছগুলো নদীতে ভেঙে পড়েছে, সে গাছের শেকড় রান্নার জ্বালানি হিসেবে সংগ্রহ করেছেন। জানতে চাই, ঘর কোনটা? হাতের ইশারায় দেখালেন। অতঃপর প্রশ্ন, বাড়ি কোথায় করেছেন? জমি কিনেছেন? প্রশ্নটা করতে না করতেই শাহনূর বেগমের কণ্ঠস্বর ছোট হয়ে আসে। বললেন, এখনো কেনা হয়নি জমি, ঘেরা হয়নি বাড়ি। তার সঙ্গে কথা বলার মাঝে হাজির তাছনূর বেগম ও আয়েশা খাতুন। সবাই একই বাড়িতে থাকেন। চার বার নদী ভাঙনের শিকার। এখন সবশেষ ঠাঁই কোথায় হবে জানা নেই কারো! থেমে গেছে শিশুদের কোলাহলও। ভেঙে গেছে তাদের স্বপ্ন। বাড়ির অল্পকিছু অংশ রয়েছে, যা কিছুদিনের মধ্যেই নদীতে হারিয়ে যাবে।

তাদের সঙ্গে আলাপ শেষে চোখ যায় বাজারের পশ্চিম সীমানা বরাবর। মাত্র কয়েকমাস আগে এসেও এখানে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদটি দেখেছিলাম। কিন্তু যতদূর দৃষ্টি যায়, মসজিদের কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। তারপরও সেদিকে এগিয়ে যাই। পথে চর মার্টিনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবুল কাশেম হাওলাদারের সঙ্গে দেখা হয়। কথা বলার আগেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, দেখছেন আমার বাড়ির কিনারায় নদী!

বললাম, আপনার বাড়ির ওখান দিয়েই এসেছি। মনে হয়, বেশি দিন থাকবে না। মসজিদটা কই?

বললেন, সব ভেঙে নিয়ে গেছে। বাজারের পূর্ব মাথায় অস্থায়ীভাবে আবার মসজিদ বানানো হবে। এরপর বাজারের কিছু দৃশ্য নদীতে বিলীন হবার আগে ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করলাম।

 

 

পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে আসছে মেঘনা। মসজিদের দালান ছুঁযে নাছিরগঞ্জ বাজারের সীমানায় ভাঙন তীব্র। বিশাল এই বাজার চর কালকিনির প্রাণকেন্দ্র। দুই শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে বাজারে। কিন্তু নদী ভাঙনে বাজারের ব্যবসায়ীদের জীবনে নেমে এসেছে হতাশা ও দুশ্চিন্তা। তারা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন- এই ভাগ্য যেন মেনে নিয়েছেন। ভাঙনের করুণ গল্পে ভারী হয়ে উঠেছে এখানকার আকাশ-বাতাস। আগুনে পুড়লে অন্তত ভিটায় পুনরায় মাথা গোজার ঠাঁইটুকু থাকে, কিন্তু নদী ভাঙলে কিছুই থাকে না, নদী কোনো চিহ্ন রাখে না। নদীর পানিতে চোখ রাখলে ভেসে ওঠে হারিয়ে যাওয়া জমি-জমা, বসত-ভিটার কথা। অনেকের চোখ ভিজে ওঠে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, গ্রামের মানুষের স্মৃতি মনের ঘরে ভেসে ওঠে। সব হারানো নিঃস্ব এই মানুষগুলোর মলিন মুখে কেবলই অন্ধকার। বেঁচে থাকাটাও অনেকের পক্ষে দায় হয়ে উঠে।

বর্ষা এলেই ভাঙনের তাণ্ডব চলে লক্ষ্মীপুরের কমলনগরজুড়ে। জোয়ার আর ভাটার উত্তাল ঢেউয়ের আঘাত। অতঃপর ফসলি মাটির বড় বড় চাকা ভেঙে পড়ে নদীর বুকে। মাঝে মাঝে মাটির বিশাল অংশ নিয়ে ভাঙন তাণ্ডবে মেতে ওঠে নদী। এভাবেই চোখের সামনে তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নের বসতঘর, পৈতৃক সম্পত্তি হারিয়ে বিষণ্ন, বেদনাবিধুর প্রাণে জমা হয় কষ্টের দাগ। বাকরুদ্ধ হন নদীভাঙা মানুষগুলো। তবুও নদী ভাঙে। ওলট-পালট হয়ে যায় আঞ্চলিক মানচিত্র।

টানা ৩৫ বছর তীব্র গতির এ ভাঙনে কোনোভাবেই যেন ক্লান্ত হয়নি মেঘনা। ভাঙনে প্রতিনিয়তই বসত-ভিটা হারাচ্ছেন কেউ না কেউ। যুগ যুগ ধরে ভাঙনে বিলীন হয়েছে উপজেলার জনগুরুত্বপূর্ণ অসংখ্য স্থাপনা। ভাঙনে ক্ষত-বিক্ষত এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা। যাদের এক সময় ছিল কোটি কোটি টাকার সম্পদ, তাদের অনেকেই আজ অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। একটু জমিও নেই নিজেদের। খোলা আকাশের নিচে, বেড়িবাঁধ ও রাস্তার পাশে ঠাঁই নিয়ে কোনো মতে বেঁচে আছেন অনেকে।

 

 

সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের বিষয়, নদী ভাঙনের কারণে ভাঙন কবলিত এ অঞ্চলে আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে ভিক্ষুকের সংখ্যা। মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন বহু মানুষ। সামাজিকভাবেও ছোট হয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে অনেককে। নদীর অব্যাহত ভাঙনে হারিয়ে গেছে এ উপজেলার জনগুরুত্বপূর্ণ বহু হাট-বাজার। সেগুলো হচ্ছে- গোয়াল মার্কেট, সফিকগঞ্জ বাজার, জনতা বাজার, চৌমুহনী বাজার, সাইয়েদ মুরীর হাট, আজু ব্যাপারীর হাট, তালতলী বাজার, সাহেবের হাট, কাদির পন্ডিতের হাট, হাজিগঞ্জ বাজার এবং লুধুয়া বাজার। সর্বশেষ মেঘনায় ভাঙছে নাছিরগঞ্জ বাজার।

চর কালকিনির ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাস্টার সাইফ উল্যাহ বলেন, এখনো কোথাও বাজার স্থানান্তর করার ব্যবস্থা হয়নি। কোথায় সরাবো বাজার? আস্তে আস্তে এখানকার ব্যবসায়ীরা অন্য কোথাও তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ে যাবেন। এ ছাড়া উপায় নেই। নদী যেভাবে ভাঙছে  বাজার মনে হয় বেশিদিন টিকবে না।

 

 

চর কালকিনির কৃতি সন্তান আহমেদ উল্লাহ সবুজ বলেন, নদী ভাঙনের কারণে চর কালকিনি ইউনিয়নের ৮০ ভাগ বিলীন হয়ে গেছে। এখন কালকিনির সবচেয়ে বড় যে দুই বাজার আছে মতিরহাট ও নাছিরগঞ্জ, তার মধ্যে নাছিরগঞ্জ বাজার ভেঙে যাচ্ছে। এখানে বহু মানুষ ছিন্নভিন্ন হয়ে বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছে। বহু মানুষ বেড়িবাঁধের পাশে খুব কষ্টে বেঁচে আছেন।

আহমেদ উল্লাহ বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার কান্না সংক্রমিত হয় আশপাশের অনেকের মাঝে। কান্না ভেজা চোখ, হৃদয়ে পাথরসম চাপ- পরিবার নিয়ে তারা কোথায় যাবেন? আসছে যে জীবন সেই জীবন তাদের কেমন হবে জানেন না কেউ।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুন ২০১৯/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়