রুড গুলিতের দেশে || শিহাব শাহরিয়ার
জার্মানি যাত্রার পূর্বেই ইচ্ছে ছিল ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, চেক রিপাবলিক, ইতালি, অস্ট্রিয়া ও বেলজিয়াম যাবো কিন্তু বার্লিন থেকে প্রাগ, প্রাগ থেকে আবার বার্লিন, বার্লিন থেকে প্যারিস, প্যারিস থেকে জুরিখ, জুরিখ থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে ক্যাসেলে যখন পৌঁছুলাম, তখন হাতে মাত্র তিন দিন সময় অর্থাৎ দেশে ফিরবার সময় হাতছানি দিচ্ছে বার বার। কী করা যায়? ভিয়েনা অথবা ব্রাসেলস? কোথায় যাবো? ক্যাসেলে যার আশ্রয়ে রয়েছি, আমার ভায়রা ভাই সাইদ মুক্তা বলল, শিহাব ভাই, চলেন নেদারল্যান্ড যাই।
তার যুক্তি হলো, এই অল্প সময়ের মধ্যে নেদারল্যান্ডে যাওয়া সহজ। সুতরাং এক দিনের ঝটিকা সফরের সিদ্ধান্ত নিলাম। আগেও একবার বলেছি, জার্মানির জিরো পয়েন্ট ক্যাসেল। সেই ক্যাসেল থেকে একটি চমৎকার রোদেলা সকালে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। মুক্তা, আমি আর হাসান ভাই। গাড়ি চালাচ্ছে মুক্তা। বিশাল হাইওয়ে। আসলে ইউরোপ আর আমেরিকার হাইওয়েগুলো দেখার মতো! কোনো যানজট নেই, প্রতিটি গাড়ি চলছে যার যার মতো। মহাসড়কের দু’পাশের দৃশ্য নান্দনিক। নান্দনিক এই কারণে যে, এই উন্নত দেশগুলো তাদের সব কিছুই সুপরিকল্পিত করে গড়ে তুলেছে। হাসান ভাই জানালেন, ক্যাসেল থেকে আমরা নেদারল্যান্ডের যে শহরে যাচ্ছি তার দূরত্ব প্রায় চার ঘণ্টা। আমরা যাচ্ছি, খাচ্ছি আর বাংলা গান শুনছি। বিশেষ করে হাসান ভাই নজরুল এবং পুরনো দিনের বাংলা গানের দারুণ ভক্ত। তার পছন্দ অনুযায়ী গানগুলো এক এক করে বাজছে। সত্যি বলতে কি, অসাধারণ লাগছে আমাদের- বিশেষ করে আমার।
জার্মান-নেদারল্যান্ডের হাইওয়ে, মিষ্টি রোদের সকাল আর আমাদের সঙ্গে বাংলা গান। এরচেয়ে প্রাণের অনুভূতি আর কি হতে পারে? ঘণ্টা তিনেক যাবার পর দেখতে পেলাম সীমান্ত। নেদারল্যান্ডের সীমান্তে পা রেখেই আমার মনে ভেসে উঠল একটি নাম- রুড গুলিত। ইউরোপীয় ফুটবলের পরাশক্তি নেদারল্যান্ডের বিশ্বকাপ আসরের খেলা দেখে প্রতিবারই মুগ্ধ হই। যে গুলিতের ছান্দসিক খেলা এখনো ভুলিনি, সেই তারই দেশে প্রবেশ করেছি। তারপর ছোটবেলা থেকে শুনেছি এই দেশের আলু আর বিশ্বের নামকরা একটি শহর আমস্টারডামের নাম। ভাবছি আর ভিতরে ভিতরে পুলকিত হচ্ছি।
আমস্টারডাম নেদারল্যান্ডের রাজধানী। ইউরোপের একটি অন্যতম দেশ এটি। ‘নেদারল্যান্ড’ ওলন্দাজ শব্দ। বাংলায় বললে এর মানে ‘নিম্নদেশ’। এই দেশের আরেক নাম ‘হল্যান্ড’। আসলে হল্যান্ড হলো একটি ঐতিহাসিক অঙ্গরাজ্যের নাম। তাদের ভাষা ওলন্দাজ। এর সরকারি নাম- নেদারল্যান্ডস রাজ্য। ১৮১৫ সাল থেকে দেশটিতে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রচলিত হয়। ১৮৪৮ সাল থেকে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয়। ২০১০ সালে ইকোনমিস্ট পত্রিকা দেশটিকে দশম শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। নেদারল্যান্ডের রাজনীতি একটি সংসদীয় প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র এবং একটি বিকেন্দ্রীকৃত ঐক্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠামো দ্বারা পরিচালিত। নেদারল্যান্ডস বারোটি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত। এদের প্রভিয়েন্স বলা হয়। প্রত্যেকটি প্রভিয়েন্স একজন গভর্নর দ্বারা শাসিত। দেশটি ইউরোপের ১১তম বৃহৎ জনসংখ্যাসমৃদ্ধ ও পৃথিবীর ৬১তম দেশ। এর প্রধান ধর্মগুলি হলো খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম। খ্রিস্টানদের বেশিরভাগই প্রোটেস্ট্যান্ট। মুসলমানদের বেশিরভাগ মানুষ তুর্কী, বসনীয়, মরক্কো, সোমালি ও ইরাকী বংশোদ্ভুত।
হাসান ভাই বললেন, ইউরোপের সবচেয়ে সমতল ভূমির দেশ নেদারল্যান্ড। অনেকটা বাংলাদেশের মতো। সমতল বলেই বিভিন্ন শস্য ফলে এখানে। বিশেষ করে আলুর চাষ হয় প্রচুর। আমরা যখন শহরটিতে প্রবেশ করলাম, তখন দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। দেখছি মহাসড়কের দু’পাশে শস্যখেত। প্রথমেই গেলাম শহরের বিশেষায়িত মিউজিয়াম দেখতে। বিশেষায়িত এজন্য বলছি যে, এটি একটি উন্মুক্ত জাদুঘর। জাদুঘরকে ওরা লিখেছে Maduroma. অত্যন্ত আধুনিক করে গড়ে তোলা হয়েছে জাদুঘর। মাটির লেবেল থেকে নিচে স্টেডিয়ামের মতো গোল ও খোলা জায়গায় নেদারল্যান্ডের ইতিহাসের নানা বাঁক এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে। ছোট ছোট মডেলের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, বিমান বন্দর, শিল্প কারখানা, কৃষি ব্যবস্থা, অবকাঠামো, রাস্তা-ঘাট, নদী থেকে শুরু করে একটি দেশের শুরুর নানা ইতিহাস প্রদর্শন করা হয়েছে। আমরা টিকিট কেটে ঘুরে ঘুরে অনেকক্ষণ ধরে দেখলাম। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বয়সের লোকেরা দেখছে এবং আনন্দ আহরণ করছে। দেখা শেষে পাশের স্যুভেনির শপ থেকে কিছু কেনাকাটা করে আমরা বেরিয়ে এলাম।
এরপর আমাদের গাড়ি চলল মূল শহরের দিকে। এর আগে ইউরোপের যে ক’টি শহর দেখে এসেছি, এই শহরের সঙ্গে সেগুলোর অনেক অমিল দেখলাম। এই অমিলটা নেদারল্যান্ডের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য মনে হলো। শহরে লোকজন খুবই কম। মুক্তা ও হাসান ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন শহরের পাশের সমুদ্র সৈকতে। এই সৈকতটি না দেখলে অনেক সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হতাম। কারণ একদমই অন্যরকম। খুবই পরিকল্পিত করে সৈকতটি গড়ে তোলা হয়েছে। হাসান ভাই ও মুক্তা এখানে আরো কয়েকবার এসেছে। তারা জানাল, সমুদ্রের ওপারেই ইংল্যান্ড। সৈকতের পাড় ধরে সারি সারি হোটেল-বিল্ডিং। প্রায় কয়েক কিলোমিটারজুড়ে এগুলো এবং অত্যন্ত উন্নত। অসংখ্য মানুষ বালুভূমিতে কেউ শুয়ে আছে, কেউ হাঁটছে, কেউ সমুদ্রের জলে অবগাহন করছে, কেউ কেউ রেস্টুরেন্টগুলোতে খাবার খাচ্ছে। আমরা সৈকতে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম, হাঁটলাম এবং পরে গাড়ি দিয়ে চক্কর দিয়ে ওখান থেকে বিদায় নিলাম। মনে মনে ভাবলাম, আমাদের কক্সবাজারের মতো সুন্দর না হলেও এই সৈকতটি আমার ভালো লাগল।
আমাদের গাড়ি চলল আবার মূল শহরের দিকে। তখন বিকেলের পূর্বলগ্ন। ওরা দু’জন আমাকে নিয়ে ঢুকল একটি রেস্টুরেন্টে। সেটির মালিক বাঙালি। আমাদের সমবয়সী এবং হাসান ভাইয়ের পরিচিত। এই মুহূর্তে ভদ্রলোকের নাম ভুলে গেলাম, যিনি আমাদের জন্য স্পেশাল বাংলা খাবারের ব্যবস্থা করলেন। খাবারের মূল্য তো নিলেনই না বরং আরো কিছু খাবার আমাদের দিয়ে দিতে চাইলেন। বললেন, ক্যাসেলে ফিরতে আমাদের রাত হয়ে যাবে। সুতরাং আমরা যাতে রাতের দিকে এই খাবার খেয়ে নেই। আমরা যেমন এই অপরিচিত শহরে একজন বাঙালিকে পেয়ে আনন্দিত, তিনিও তেমনি। সেখানেই শুনলাম, শহরে অনেক বাঙালি আছে, যারা রেস্টুরেন্টের ব্যবসা থেকে নানা পেশায় নিয়োজিত। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আবার শহর দেখতে লাগলাম। শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি খরস্রোতা নদী। নদীর দু’পাশে অনেক বড় বড় দালানকোঠা, যেখানে অফিস ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এর বাইরেই আবাসিক নিরিবিলি এলাকা। কোনো হৈচৈ নেই, নির্জন, ছিমছাম জীবন। আবহাওয়া, ভাষা আর মানুষের চেহারা ভিন্ন হলেও, জীবন ও রক্ত এক। ওদের গায়ের রং আমি দেখলাম, ওদের কেউ কেউ আমাকে দেখলো, যদিও এই দেখাদেখির কোনো রেখাচিহ্ন নেই, তবু একদিন দেখা হলো অচেনা নগর। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা হয়ে এলো। বাড়ি ফিরবার তাড়া, মানে জার্মানিতে, মানে আরেকটি দেশে ফিরতে হবে।
ফিরবার সময় মনে খেদ রইল, কারণ রাজধানী শহর আমস্টারডামে যাওয়া হলো না। আবার কবে আসা হবে? হয়তো আর আসাই হবে না। না জীবন অনেক সুন্দর, নিশ্চয়ই আবার আসবো। শহরের নিয়ন আলো ভেদ করে, সন্ধ্যার ছায়া মাথায় নিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলল জার্মানির পথে। সীমান্তে ইমিগ্রেশনের ঝামেলা নেই। কাঁটাতারের বেড়া নেই। কখন এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঢুকি, টের পাই না। দ্রুতগামী গাড়ির ভিতর বসে হারিয়ে গেলাম ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে। মনে মনে আবৃত্তি করলাম: ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে’। এবার দেশে ফিরতে হবে। মনের অজান্তেই উচ্চারিত হলো একটি বাক্য: বাংলাদেশ তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন